প্রকাশ : ১৬ অক্টোবর ২০২৫, ০৮:৫৫
রাসুল (সা.) এর আদর্শ অনুসরণই ইসলাম

(শেষ পর্ব)
মহানবী (সা.) কেবল একজন নবী বা ধর্মপুরুষ ছিলেন না বরং তিনি একজন মহান নেতা ও সফল রাষ্ট্রনায়কও ছিলেন। তিনি একটি বৈরী পরিবেশকে পরাভূত একটি আদর্শ ও কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন। নবুওয়াত লাভের পর থেকেই তিনি ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা শুরু করেন। মক্কার সংকটময় দিনগুলোতেও সে প্রচেষ্টা অব্যাহত ছিল। তাঁর জীবনী এমন এক মহাসমুদ্র যে, লক্ষ লক্ষ লোকের আলোচনা সত্ত্বেও আজ পর্যন্ত এর কোনো কূল-কিনারা পাওয়া যায়নি। তাই এই মহামানবের জীবনের শিক্ষা ও আদর্শ সম্পর্কে এবং তাঁর জীবনের বিভিন্ন দিক ও ঘটনা সম্বন্ধে এত গবেষণা হওয়ার পরও যেন অনেকেরই নতুন কোনো কথা বলার থাকে।
মক্কায় তিন কর্মসূচি
আদর্শ রাষ্ট্রগঠনের প্রাক প্রস্তুতি হিসেবে মক্কায় মহানবী (সা.) তিনটি কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেন। তা হলো :
১. মানসিক গঠন : ইসলাম আগমনের পর নবীজি (সা.) মুসলমানদের মানসিক গঠনে মনযোগী হন। তিনি তা সম্পন্ন করেন ঈমানের দৃঢ়, ইবাদত তথা আল্লাহর আনুগত্য এবং রুহানিয়্যাত তথা আল্লাহর নৈকট্য লাভের দীক্ষা দানের মাধ্যমে। তিনি শিরকের বিপরীতে তাওহিদ, প্রবৃত্তির অনুসরণের বিপরীতে আল্লাহর আনুগত্য এবং পার্থিব মোহের বিপরীতে আল্লাহর নৈকট্যের শিক্ষা দেন। তাফসিরবিদরা বলেন, মক্কায় অবতীর্ণ সুরাগুলোতে পূর্ববর্তী জাতি-গোষ্ঠীর বর্ণনা তুলনামূলক বেশি এসেছে। বস্তুত এসব বর্ণনা মক্কায় চলমান অত্যাচার ও নিপীড়নের মুখে মুসলমানদের মনোবল অটুট রাখতে সাহায্য করেছে এবং তাদেরকে সুন্দর ভবিষ্যতের ব্যাপারে আশাবাদী করেছে। কেননা এসব ঘটনায় জালিমদের পতন, মুমিনের বিজয় এবং মুমিনদের প্রতি অত্যাচারের নানা চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।
২. সামাজিক গঠন : মহানবী (সা.) মক্কায় ইসলাম গ্রহণকারী মুসলমানদের নিয়ে একটি সমাজ (কমিউনিটি অর্থে) গঠন করেন। তিনি মক্কার মুসলিমদের মধ্যে এই বিশ্বাস স্থাপন করেন যে, একই সমাজে বসবাস করলেও মুসলমানরা স্বতন্ত্র সম্প্রদায়। তাঁরা ঈমান ও ইসলামের সুতোয় বাধা। বিপরীতে যারা আল্লাহ প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে না তাদের সঙ্গে মুসলমানরা সম্পর্কহীন। মুসলমানরা পরস্পরের সহযোগী এবং আশ্রয়দাতা। তারা যথাসম্ভব সংঘবদ্ধ থাকবে, তারা পরস্পরকে দ্বিন পালনে সাহায্য করবে এবং মুশরিকদের অত্যাচার থেকে রক্ষা করবে। গোপন অথচ পৃথক ও স্বতন্ত্র এই সামাজিক মূল্যবোধ জাতি হিসেবে মুসলমানদের আত্মপ্রকাশ সহজ করেছিল।
৩. অস্তিত্বের জানান দেওয়া : মহানবী (সা.) নবুওয়াতের তিন বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর প্রকাশ্যে দাওয়াত দেওয়া শুরু করেন। তিনি প্রাথমিকভাবে মক্কার ভেতরে দাওয়াত দিলেও ধীরে ধীরে দাওয়াতের পরিধি মক্কার বাইরে বিস্তৃত হতে থাকে। তিনি এই সময় হজ মৌসুমে মক্কায় আগমনকারী হাজিদের মাঝে, আরবের বিখ্যাত মেলাগুলোতে এবং তায়েফসহ মক্কার নিকটবর্তী গোত্রগুলোর কাছে ইসলামের দাওয়াত নিয়ে হাজির হন। এর ফলে মক্কার বাইরে যেমন ইসলামের আহ্বান পৌঁছে যায়, তেমন স্থানীয় নেতৃত্ব ও শক্তিগুলো ইসলাম ও মুসলমানের অস্তিত্ব সম্পর্কে অবগত হয়। যা পরবর্তীতে মদিনা রাষ্ট্রের রাজনৈতিক স্বীকৃতি লাভে সহায়ক হয়েছিল।
মদিনায় ছয় কর্মসূচি :
ইসলামী রাষ্ট্রগঠন ও তার বিকাশে মহানবী (সা.) মদিনায় একাধিক কর্মসূচি হাতে নেন। এর ভেতর মৌলিক ছয়টি কর্মসূচি তুলে ধরা হলো।
১. মসজিদভিত্তিক সমাজ গঠন : রাসুলুল্লাহ (সা.) মদিনায় আগমন করার পর সর্বপ্রথম মসজিদ নির্মাণ করেন। এই মসজিদই ছিল মুসলমানদের সকল কর্মকাণ্ডের প্রাণকেন্দ্র। ইবাদত-বন্দেগী, দ্বিনি শিক্ষা, সামাজিক কল্যাণ, সালিশ-বিচারসহ রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো মসজিদেই গ্রহণ করা হতো। মসজিদ মূলত মুসলিম সমাজকে একমুখী করেছিল, তাদেরকে একক নেতৃত্ব অধীনে একতাবদ্ধ করেছিল এবং তাদের মধ্যে সুদৃঢ় ঐক্য গড়ে তুলেছিল।
২. ভ্রাতৃত্ব বন্ধন : হিজরতের পর মহানবী (সা.) মুহাজির ও আনসার সাহাবিদের ভেতর ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করেন। এই ভ্রাতৃত্বের বন্ধন আগন্তুক মুহাজির সাহাবিদেরকে মদিনায় পুনর্বাসনের পথকে সহজ করেছিল এবং মুহাজির ও আনসারিদের মধ্যে মানসিক মেলবন্ধন তৈরিতে সাহায্য করেছিল। ফলে তারা পরস্পরের ভাই হয়ে দ্বিনি কাজে অংশগ্রহণ করেছিল।
৩. বিভিন্ন গোত্রের সঙ্গে চুক্তি : মদিনায় হিজরতের পর মহানবী (সা.) স্থানীয় ইহুদি সম্প্রদায়সহ পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন গোত্রের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হন। এসব চুক্তির ফলে মদিনায় সামাজিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠিত হয়। একই সঙ্গে মুসলিমরা একটি রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে।
৪. মদিনা সনদ : মদিনা সনদ মূলত বিভিন্ন গোত্রের সঙ্গে মহানবী (সা.)-এর সম্পাদিত চুক্তিগুলোর একটি সম্মিলিত রূপ। এসব লিখিত চুক্তি মদিনা রাষ্ট্র পরিচালনায় নীতিনির্ধারণী ভূমিকা পালন করায় তাকে মদিনা সনদ বলা হয়। মদিনা সনদ একই মদিনা রাষ্ট্রের মুসলিম ও অমুসলিম সম্প্রদায়ের সুরক্ষা নিশ্চিত করেছিল।
মদিনা সনদের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি ধারা হলো :
ক. বনু আওফের ইহুদিরা মুসলিমদের সঙ্গে মিলেমিশে এক উম্মতের মতো বসবাস করবে, কিন্তু উভয় সম্প্রদায়ের লোকেরাই নিজ নিজ ধর্ম পালন করবে।
খ. মুসলিম ও ইহুদি উভয় সম্প্রদায়ের লোক নিজ নিজ আয় উপার্জনের দায়িত্বশীল থাকবে।
গ. এ চুক্তির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পক্ষদ্বয়ের লোকেরা নিজেদের মধ্যে সহানুভূতি, সদিচ্ছা ও পারস্পরিক উপকারের ভিত্তিতে কাজ করে যাবে, কোনো অন্যায়-অনাচার কিংবা পাপাচারের ভিত্তিতে কাজ করবে না।
ঘ. কেউ কারো ওপর জুলুম করলে মজলুমকে সাহায্য করা হবে।
ঙ. এ চুক্তিভুক্ত সকলের জন্যই মদিনায় কোনো প্রকার হাঙ্গামা সৃষ্টি করা কিংবা রক্তপাত ঘটানো যাবে না।
চ. চুক্তিভুক্ত পক্ষগুলো কোনো নতুন সমস্যা কিংবা ঝগড়া-ফ্যাসাদে জড়িয়ে পড়ার উপক্রম হলে আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সা.)-এর মীমাংসা করবেন।
৫. বহির্বিশ্বে চিঠি পাঠানো : হুদাইবিয়ার চুক্তির পর মহানবী (সা.) প্রায় ১০ জন রাজা, বাদশাহ ও শাসকের কাছে ইসলামের আহ্বান জানিয়ে চিঠি লেখেন। তাদের মধ্যে ছিলেন, রোম সম্রাট কায়সার, পারস্য সম্রাট কিসরা, হাবশার বাদশাহ নাজ্জাসি, ইস্কান্দারিয়ার (মিসর) শাসক মুকাওকিস, ইয়ামামার শাসক সুমামা বিন উসাল, শামের শাসক হারিস বিন আবি শামার গাসসানি প্রমুখ। মাধ্যমে পৃথিবীর বেশির ভাগ অঞ্চলে ইষলামের দাওয়াত পৌঁছে দেন। এর ফলে সভ্য পৃথিবীর সর্বত্র আল্লাহ, তাঁর রাসুল ও ইসলামের পরিচিতি ছড়িয়ে পড়ে এবং বিশ্বময় ইসলামের আলোচনা শুরু হয়।
৬. সেনাবাহিনী গঠন : মহানবী (সা.) মদিনায় আগমনের পর একটি নিয়মিত ও শক্তিশালী সেনাবাহিনী গঠন করেন। তাঁর বাহিনী প্রচলিত বেতনভুক্ত বাহিনীর মতো না হলেও তাদের ভেতর পেশাদারিত্বের কোনো অভাব ছিল না। নবীজি (সা.) তাদেরকে নিয়মিত অনুশীলন ও অভিযানের মাধ্যমে সুদক্ষ বাহিনী হিসেবে গড়ে তোলেন। মক্কা বিজয়ের সময় নবীজি (সা.)-এর বাহিনীর সদস্য সংখ্যা ছিল ১০ হাজার। মক্কা বিজয়ের পর তা সংখ্যায় আরো বৃদ্ধি পায়।
হযরত আয়েশা (রা)-এর একটি ছোট মন্তব্য নবী করীম (সা)-এর জীবনের বিশালতা সম্বন্ধে স্পষ্ট ইঙ্গিত দান করে। নবীচরিত্র সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হয়ে নবীর জীবনসঙ্গিনী হিসেবে তিনি জওয়াব দিলেনÑ কুরআনই তাঁর চরিত্র। প্রকৃত কথাও এই যে, কিতাব আকারে আমি কুরআন নামক যে গ্রন্থখানা পাঠ করি এ কিতাবী কুরআন মাত্র। আসল কুরআনই হলো নবীর জীবন। রাসূলপাকের জীবনে কুরআনের যে বাস্তব রূপ পাওয়া যায় তা থেকেই কুরআনের আসল পরিচয় মেলে। সুতরাং নবী জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন দৃষ্টি নিয়ে যদি কেউ কুরআন মজিদকে বুঝবার চেষ্টা করে তাহলে হয় কুরআন তার নিকট এক অর্থহীন গ্রন্থ বলে মনে হবে, আর না হয় পাঠক কুরআনের মনগড়া অর্থই করবে। নবীর জীবনে যারা কুরআনের বাস্তব অর্থ তালাশ করে না, কুরআন বুঝবার সব দুয়ারই তাদের নিকট রুদ্ধ। রাসূলের বাস্তব জীবনের সাহায্যে যেমন কুরআন বুঝতে হবে, তেমনি রাসূলের জীবনকেও কুরআনের আলোতেই দেখতে হবে।
রাসূলূল্লাহ (সা) এর বিশাল জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক সম্বন্ধে একটি মাত্র দৃষ্টিকোণ থেকে আমি এখানে আলোচনা করতে চাই। তাঁর রাজনৈতিক জীবনকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যেতে পারে। একটি আদর্শকে বাস্তবে রূপায়িত করার জন্য তাঁর আন্দোলনে যে রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার পরিচয় পাওয়া যায় সে বিষয়ে বহু যোগ্য লেখক দীর্ঘ আলোচনা করেছেন। রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে তিনি বিভিন্ন মত ও পথের লোকদের নিয়ে যেরূপ শান্তিপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সে দিকটিও দুনিয়ার মানুষকে চিরদিনই অনুসরণের প্রেরণা দিতে থাকবে। এভাবে তাঁর রাজনৈতিক জীবনের অনেক দিকই আলোচনার জন্য নিশ্চয়ই মূল্যবান বলে বিবেচিত হবে।
নবী করীম (সা.) কি শুধু একজন ধর্মীয় নেতা মাত্র ছিলেন? না তাঁর জীবনে রাজনীতিও ছিল, এখানে সে বিষয়েই আমি আলোচনা করব। রাজনীতিকে তিনি জীবনে কতটুকু স্থান দিয়েছিলেন, আল্লাহ পাক তাঁকে রাজনৈতিক কার্যকলাপের নির্দেশ দিয়েছিলেন কি না, সমসাময়িক রাজনীতিকদের সাথে তাঁর সংঘর্ষ বাধার কী কারণই বা ছিল। আলোচ্য বিষয়ের গুরুত্ব রাসূলুল্লাহর (সা) জীবনে রাজনীতির স্থান সম্বন্ধে আলোচনা করা আজ নানা কারণে অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। দীর্ঘ পরাধীনতার পরিণামে ধার্মিকদের মধ্যে আজ এমন লোক সৃষ্টি হয়েছেন, যারা দীনদার ও পরহেজগার বলে সমাজে পরিচিত হওয়া সত্ত্বেও ‘রাজনীতি’ করাকে নিন্দনীয় মনে করেন, অথবা অন্তত পক্ষে অপছন্দ করে। তাঁরা দেশের রাজনীতি থেকে পরহেজ করাকে (নিজেদেরকে নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে রাখাকে) দীনদারি ও তাকওয়ার জন্য জরুরি মনে করেন।ইসলামের সঠিক জ্ঞান থেকে বঞ্চিত থাকা অবস্থায় সে সব মুসলিম পাশ্চাত্যের শিক্ষা ও জীবনদর্শনে দীক্ষা গ্রহণ করেছেন, প্রধানত তারাই আজ স্বাধীন মুসলিম দেশগুলোর পরিচালক। ইসলামকে পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান হিসেবে সমাজ ও রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন মুসলিম রাষ্ট্রে যে ক’টি ইসলামী আন্দোলন দানা বেঁধে উঠেছে এর প্রত্যেকটিই ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী শাসকগোষ্ঠীর গাত্রদাহ সৃষ্টি করেছে। এভাবে কতক ধার্মিক রাসূলের সংগ্রামী জীবনের দিকে লক্ষ্য না করে তাঁকে এমনভাবে চিত্রিত করেন যেন আল্লাহর নবী সংসারত্যাগী কোনো বৈরাগী ছিলেন (নাউজুবিল্লাহ)। এদিকে মুসলিম নামধারী শাসকেরাও রাসূলকে (সা) শুধু ধর্মীয় নেতা হিসেবেই স্বীকার (গ্রহণ নয়) করতে প্রস্তুত। মহানবীর সামগ্রিক জীবনকে একক ও সে পূর্ণাঙ্গ সত্তা হিসেবে গ্রহণ না করার মনোভাবটি উদ্দেশ্যমূলক হলেও সরল মুসলমান এদের দ্বারা বিভ্রান্ত হয়ে থাকে।
রাজনীতির অর্থ কী?
রাজার নীতিকেই হয়তো একসময় রাজনীতি বলা হতো। আসলে রাষ্ট্র পরিচালনা সংক্রান্ত নীতিটিই রাজনীতি বা রাষ্ট্রনীতি বলে পরিচিত। অবশ্য রাষ্ট্রনীতি ও রাজনীতি পরিভাষা হিসেবে বর্তমানে এক কথা নয়। রাষ্ট্র ও সরকারের যেরূপ পার্থক্য, রাষ্ট্রনীতি ও রাজনীতিতে তেমনি তফাত। অর্থাৎ রাষ্ট্রসংক্রান্ত বিষয়াদি হলো রাষ্ট্রনীতির অন্তর্ভুক্ত আর সরকার সম্বন্ধীয় কার্যকলাপকেই বলা হয় রাজনীতি।
রাজনৈতিক কার্যকলাপ
সরকারি ক্ষমতা যাদের হাতে থাকে তাদেরকে সংশোধন করা, তাদের কার্যাবলির সমালোচনা করা, সরকারি নীতির ভ্রান্তি প্রকাশ করে জনগণকে সচেতন করা এবং এ জাতীয় যাবতীয় কাজকেই রাজনৈতিক কার্যাবলি হিসেবে গণ্য করা হয়। কিন্তু সরকার পরিবর্তনের প্রচেষ্টাই হলো সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক কার্য। ভ্রান্ত নীতি ও আদর্শে রাষ্ট্র পরিচালিত হতে দেখে সরকারি কর্তৃপক্ষকে ক্ষমতাচ্যুত করে সঠিক শাসনব্যবস্থা চালু করতে চেষ্টা করাই প্রধান রাজনৈতিক কার্যকলাপ।
বিশ্বনবীর দায়িত্ব
এখন দেখা যাক, আল্লাহ পাক হযরত মুহাম্মদ (সা) কে যে বিরাট দায়িত্বসহ পাঠিয়েছিলেন তা পালন করতে গিয়ে তাঁকে রাজনৈতিক কাজ করতে হয়েছিল কি না। যদি তিনি নবী হিসেবে রাজনৈতিক কার্যকলাপে লিপ্ত হয়েছিলেন বলে জানা যায়, তাহলে রাজনীতি করা ইসলামের তাগিদই মনে করতে হবে। নবী বলে ঘোষিত হওয়ার পর থেকে তাঁর গোটা জীবনই যদি আমাদের জন্য আদর্শ হিসেবে বিবেচিত হয় তাহলে তাঁর রাজনৈতিক কাজগুলো অনুসরণের অযোগ্য হওয়ার কী কারণ থাকতে পারে? হযরতের ওপর কী দায়িত্ব অর্পিত হয়ছিল এবং তিনি কিভাবে তা পালন করেছিলেন তা আলোচনা করলেই বিশ্বনবীর জীবনে রাজনীতি কতোটা ছিল সে কথা স্পষ্টরূপে প্রকাশ পাবে।
আল্লাহ পাক তাঁর রাসূলকে কোন কর্তব্য দিয়ে পাঠিয়েছিলেন কুরআন মজিদের বহু স্থানে বিভিন্নভাবে স্বয়ং আল্লাহ তাআলা তা সুস্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করেছেন আল্লাহ বলেন, “তিনিই এ সত্তা যিনি তাঁর রাসূলকে হেদায়াত ও দীনে হকসহ পাঠিয়েছেন, যাতে আর সব দীনের ওপর একে (দীনে হককে) বিজয়ী করে তুলেন। এ বিষয়ে আল্লাহ তাআলার সাক্ষী হিসেবে যথেষ্ট।” (সূরা আল ফাতহ : ২৮)
এ আয়াতের শেষ অংশটুকু অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। আল্লাহ তাঁর রাসূলকে প্রধানত কোন কাজ করার দায়িত্ব দিয়েছিলেন সে সম্পর্কে আল্লাহর চেয়ে বেশি কারও পক্ষে জানবার উপায় নেই। সুতরাং সে বিষয়ে অন্য কারও সাক্ষ্যই গ্রাহ্য নয়। আল্লাহর সাক্ষ্যই সেখানে যথেষ্ট। রাসূলুল্লাহ (সা.) এর জীবনকে বিভিন্ন দিক থেকে বিচার করে কোন একটি দিক বা বিভাগকে নিজেদের রুচিমত প্রধান দিক বলে সাব্যস্ত করতে গিয়ে অনেক বিভ্রান্তির সৃষ্টি করা হয়েছে। সাত অন্ধের হাতি দেখার মতো, কেউ তাঁর বিশাল জীবনের এক অংশ থেকে শুধু হেরা গুহায় ধ্যানমগ্ন দিকটিকেই প্রধান বলে গ্রহণ করেছেন। কেউ তাঁর নামাজ রোজা, তাসবিহ তেলাওয়াত ও তাহাজ্জুদের দিকটিকেই প্রধান বলে গ্রহণ করেছেন। কেউবা তাঁকে একজন আরব জাতীয়তাবাদী নেতা হিসেবেই দেখেছেন। আবার কেউ শুধু সর্বহারাদের নেতা হিসেবে চিত্রিত করে নিজ নিজ মত ও পথের সমর্থনে রাসূলকে দলিল হিসেবে পেশ করার চেষ্টা করেছেন। এ জাতীয় সবাই রাসূলের গোটা জীবনধারাকে এক সাথে বিবেচনা করে রাসূলের জীবনের মূল লক্ষ্যটুকুকে বুঝতে সক্ষম হননি। তারা অন্ধের মতো হাতিটি যেটুটু দেখতে পেয়েছেন সেটুকুই রাসূলের গোটা জীবন বলে ধারণা করেছেন। এদের অনেকেই হয়ত সাত অন্ধের ন্যায় আন্তরিকতার সাথে নিজ নিজ সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন। কিন্তু আল্লাহ স্বয়ং রাসূলকে যে উদ্দেশ্যে পাঠিয়েছেন বলে ঘোষণা করেছেন তার সাথে এঁদের ধারণার কোনো মিল নেই।
হেরা গুহায় হযরত ধ্যানমগ্ন থাকা, নামাজ রোজায় মশগুল হওয়া, শেষ রাতে তাহাজ্জুদে নিমগ্ন হওয়া এবং সর্বহারাদের দুর্গতি দূর করার চেষ্টা চালানো এ সবই তাঁর জীবনে লক্ষ্য করা যায় সত্য। এগুলো তাঁর কর্মবহুল জীবনের বিভিন্ন ঘটনা হলেও এর কোনোটাই বিচ্ছিন্ন্ নয়। এ সবই হয়ত জীবনের মূল দায়িত্বের সাথে সংশ্লিষ্ট এবং তাঁর মূল লক্ষ্যে পৌঁছার উপযোগী। কিন্তু ঐ সব কাজের কোনোটাই রাসূূলকে পাঠাবার প্রধান উদ্দেশ্য নয়।
রাসূলের প্রধান দায়িত্ব
পূর্বোল্লিখিত আয়াতে আল্লাহ পাক তাঁর রাসূলকে পাঠাবার যে উদ্দেশ্য বর্ণনা করেছেন সেটাই নবীজীবনের প্রধান দায়িত্ব। উক্ত আয়াতে বলা হয়েছে যে, রাসূলকে একমাত্র দীনে হক দিয়ে দুনিয়ায় পাঠানো হয়েছে এবং মানবরচিত যাবতীয় দীনের ওপর আল্লাহর দীনকে বিজয়ী করে দেয়ার উদ্দেশ্যে তাঁকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। এতে স্পষ্টই বোঝা গেল যে, রাসূলকে শুধু একজন প্রচারক অথবা ধর্মনেতার দায়িত্ব দেয়া হয়নি। দীন ইসলামরূপ পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধানটিকে একটি বিজয়ী আদর্শ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করাই হযরতের প্রধান দায়িত্ব ছিল। দীন ইসলাম মানবসমাজে বাস্তবে প্রতিষ্ঠা করা নবীজীবনের মূল লক্ষ্য ছিল। তিনি যখন যা করেছেন একমাত্র সে লক্ষ্য পৌঁছার জন্যই করেছেন এবং সে চরম লক্ষ্য পৌঁছবার উদ্দেশ্যে এই একটি বিপ্লবী আন্দোলন পরিচালনা করেছেন।
রাসূলের বিপ্লবী আন্দোলন
মানবসমাজের কোন না কোন ব্যবস্থা কায়েম থাকেই। সামাজিক রীতিনীতি, আইন, শাসন, বিচার, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, ধর্মীয় প্রথা ইত্যাদি সমাজে প্রচলিত থাকে। যে সমাজব্যবস্থা পূর্ব থেকেই প্রতিষ্ঠিত থাকে তা যেমন আপনিই কায়েম থাকে না তেমনি তা আপনা আপনিই উৎখাত হয় না। রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় নেতৃত্বই প্রচলিত সমাজব্যবস্থাকে কায়েম রাখে। যখনই কেউ এ ব্যবস্থাকে উৎখাত করার আওয়াজ তোলে তখনই সর্বশ্রেণীর নেতৃত্ব একজোট হয়ে এর বিরোধিতা করে। কারণ এসব নেতৃত্বের স্বার্থ প্রচলিত সমাজব্যবস্থায়ই কায়েম থাকা সম্ভব। এগুলোই সমাজের কায়েমি স্বার্থে। প্রতিষ্ঠিত সমাজব্যবস্থাকে উৎখাত করার জন্য যখনই কোন প্রচেষ্টা চলে তখনই কায়েমি নেতৃত্বের সাথে সংঘর্ষ বাধে। ধর্মীয় ও সামাজিক রীতিনীতি, আইন ও শাসন এবং অর্থনৈতিক কাঠামো মিলে যে সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত থাকে তাকে সম্পূর্ণরূপে পরিবর্তন করে নতুন ধরনের নীতি ও আদর্শে সমাজকে গঠন করার আওয়াজ উঠবার সঙ্গে সঙ্গে কায়েমি নেতৃত্ব চঞ্চল হয়ে ওঠে এবং এ আওয়াজকে বন্ধ করার জন্য সর্বশক্তি প্রয়োগ করে। সমাজে এ ধরনের ব্যাপক পরিবর্তন আনয়ন করাকে বিপ্লব বলে। সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন ব্যতীত সরকারের উত্থান-পতন বা দলবিশেষের নাটকীয় ক্ষমতা দখলকে বিপ্লবী নাম দিলেও তাকে প্রকৃত বিপ্লব বলা চলে না। গোট সমাজের মৌলিক ও ব্যাপক পরিবর্তনকেই বিপ্লব বলে। এ ধরনের বৈপ্লবিক পরিবর্তনের জন্য যে আন্দোলন প্রয়োজন তারই নাম বিপ্লবী আন্দোলন।
রাসূলুল্লাহ (সা.) আরব ভূমিতে যে ব্যাপক বিপ্লব সৃষ্টি করেছিলেন তা হঠাৎ সংঘটিত হয়নি। আরবের প্রচলিত সমাজব্যবস্থাকে সম্পূর্ণরূপে বদলিয়ে দেয়ার জন্য রাসূলকে কালেমায়ে তাইয়্যেবার ভিত্তিতে এক বিপ্লবী আন্দোলন শুরু করতে হয়। দীর্ঘ ২৩ বছরে অবিরাম চেষ্টায় সে বিপ্লব সফল হয়। দুনিয়ার ইতিহাসে এরূপ কোন নজির পাওয়া যায় না যে, কায়েমি নেতৃত্ব কোনো বিপ্লবী আওয়াজ শুনে নতুন সমাজব্যবস্থা গড়বার জন্য খুশি হয়ে নেতৃত্বের আসন ত্যাগ করে সরে দাঁড়িয়েছে। বরং সব সমাজে সব কালেই দেখা গেছে যে, কায়েমি নেতৃত্বের অধিকারীরা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ক্ষমতা আঁকড়িয়ে থাকারই চেষ্টা করেছে এবং বিপ্লবী আন্দোলন ক্রমে ক্রম শক্তি সঞ্চয় করে তাদেরকে উৎখাত করেছে।
রাসূলুল্লাহ (সা.) এর বেলায়ও এ ব্যতিক্রম হয়নি। ইসলামী আদর্শে সমাজব্যবস্থাকে গড়ে তুলবার যে দায়িত্ব তাঁর ওপর ন্যস্ত ছিল তা পালন করার প্রথম পদক্ষেপেই মক্কার নেতৃত্ব অস্থির হয়ে উঠলো। পয়লা লোভ দেখিয়ে তাঁকে এ পথ থেকে নিবৃত্ত করতে চেষ্টা করলো। কালেমায়ে তাইয়্যেবার বিপ্লবী দাওয়াত থেকে। সমাজের কায়েমি স্বার্থের অধিকারীরা বুঝতে পারল যে, এ আওয়াজ তাদের বিরুদ্ধেই স্পষ্ট বিদ্রোহ। নেতৃত্বের লোভ, অর্থসম্পদ, নারী লালসা ইত্যাদির (যা তাদের জীবনের চরম লক্ষ্য) বিনিময়ে তারা হযরতকে এ পথ থেকে ফিরাবার চেষ্টা করলো। হযরত সে প্রস্তাব গ্রহণ করতে রাজি হলে তাদের প্রচলিত সমাজব্যবস্থাকেও মেনে নিতে বাধ্য হতেন। কিন্তু আদর্শভিত্তিক আন্দোলন যারা করেন তাদের পক্ষে এ ধরনের প্রস্তাবে রাজি হওয়া সম্ভবই নয়। তাই এ ধরনের আন্দোলনের সাথে প্রতিষ্ঠিত নেতৃত্বের সংঘর্ষ অনিবার্য। দীর্ঘ ও কঠোর সংগ্রামের পর নবী করীম (সা.) বিজয়ী হন এবং ইসলামী আদর্শে সমাজব্যস্থাকে গড়ে তুলতে সক্ষম হন।
ইসলামী আন্দোলন ও রাজনীতি
অনৈসলামী সমাজব্যবস্থাকে পরিবর্তন করে ইসলামী আদর্শের ভিত্তিতে মানবসমাজকে পুনর্গঠনের উদ্দেশ্যে আল্লাহর নবী যে আন্দোলন পরিচালনা করেন তাই হলো আদর্শ ইসলামী আন্দোলন। এ ধরনের আন্দোলন রাজনৈতিক কার্যকলাপ ব্যতীত কী করে সম্ভব হতে পারে? সমাজবিজ্ঞান, রাষ্ট্রব্যবস্থা ও আদর্শবাদী আন্দোলনের ইতিহাস যারা কিছুটা চর্চা করেন এবং মানবসমাজের সমস্যা নিয়ে যারা একটু চিন্তাভাবনা করেন তাদের পক্ষে এ কথা বোঝা অত্যন্ত সহজ। যারা স্থূল দৃষ্টিতে ইসলামকে দেখেন তারা এটাকে একটা ধর্ম মাত্র মনে করে রাজনীতিকে ইসলাম থেকে আলাদা করতে চান। তারা হয় আন্দোলনের অর্থই বুঝেন না, আর না হয় আন্দোলনের সংগ্রামী পথে চলার সাহস রাখেন না। ইসলামকে একটা জীবনবিধান হিসেবে বুঝে যারা রাজনীতি করা পছন্দ করে না, তারা নিশ্চয়ই পার্থিব কোন স্বার্থের খাতিরে অথবা কায়েমি নেতৃত্বের নির্যাতন থেকে আত্মরক্ষা করার জন্য এরূপ নিষ্ক্রিয় পন্থা অবলম্বন করেন।
নবী করীম (সা.) যে আন্দোলন চালিয়েছিলেন তাতে প্রকৃত পক্ষে চরম রাজনৈতিক কার্যকলাপ অপরিহার্য ছিল। দেশের নেতৃত্ব যদি অনৈসলামিক লোকদের হাতে থাকে, তাহলে ইসলাম একটি বিজয়ী আদর্শ হিসেবে কিছুতেই প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ এতে পারে না। তাই ইসলামী আদর্শের বিজয় মানেই নেতৃত্বের পরিবর্তন এবং নেতৃত্ব পরিবর্তনের প্রচেষ্টাই চরম রাজনীতি। রাজনীতি করাকে যারা দীনদারির খেলাপ মনে করেন তারা রাসূলুল্লাহ (সা.) এর এ চরম রাজনীতিকে কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন? যারা এ নীতি অবলম্বন করেন তারা কি নিজেদেরকে রাসূলের চেয়েও বিশেষ দীনদার বলে মনে করেন? তারা নিশ্চয়ই তা করেন না। প্রকৃতপক্ষে তারা রাজনীতি অর্থই বুঝেন না এবং দীনের দাবি সম্পর্কে পূর্ণ চেতনা রাখেন না।
রাসূলের রাজনীতির বৈশিষ্ট্য
আজকাল রাজনীতি করাকে যে কারণে নেক লোকেরা ঘৃণা করেন তা অত্যন্ত স্পষ্ট। পাশ্চাত্য গণতন্ত্রের অনুকরণে বিভিন্ন মুসলিম দেশে যে রাজনীতির প্রচলন হয়েছে তা কোন ভদ্রলোকের পক্ষেই পছন্দ করা সম্ভব নয়। ব্যক্তি ও দলীয় স্বার্থকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করে ক্ষমতা দখলের জঘন্য কোন্দলই এক শ্রেণীর লোকের নিকট রাজনীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেউ টাকার জোরে, কেউ ভোটের বলে, আর কেউ অস্ত্রের দাপটে ক্ষমতা দখল করতে সর্বপ্রকার অন্যায় পন্থা অবলম্বন করে রাজনীতি করে থাকেন। এসব লোক জঘন্য রাজনৈতিক কার্যকলাপের মাধ্যমে গদি দখল করার পর তাদের বিরুদ্ধে সমালোচনার অধিকারটুকুও হরণ করে তাকে নীতি ও আদর্শের ভিত্তিতে জাতিগঠনের প্রচেষ্টাকেও এরা রাজনৈতিক কার্যকলাপ বলে দমন করতে চান। শেষ নবীর ইসলামী আন্দোলনকে এ মনোভাব নিয়েই দমন করোর চেষ্টা চলেছিল। শুধু শেষ নবীই নয়, হযরত ইব্রাহিম (আ), হযরত মূসা (আ) ও অন্যান্য নবীর আন্দোলনের সাথেও একই ব্যবহার করা হয়েছে। কেননা নবীদের আন্দোলনের পরিণতি যে নেতৃত্বের পরিবর্তন সে কথা ক্ষমতাসীনদের বুঝতে বাকি ছিল না।
কিন্তু নবীদের রাজনীতির প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো, তাঁদের চারিত্রিক ও নৈতিক শক্তি। বিপ্লবী আন্দোলন শুরু করার পূর্বে নবীদের নিষ্কলঙ্ক দীর্ঘজীবন যে নিঃস্বার্থপরতার পরিচয় বহন করে তা ইসলাম ব্যতীত আর কোন আদর্শবাদী আন্দোলনে সমপরিমাণে পাওয়া যায় না। সমাজে এ নৈতিক প্রতিষ্ঠাই তাঁদের আন্দোলনের প্রধান মূলধন। শেষ নবী রাজনীতিতে এ নিঃস¦ার্থপরতা ও নৈতিকতার বৈশিষ্ট্য সমুজ্জ্বল ছিল। এ জন্যই তাঁর বিরুদ্ধে কোন সস্তা শ্লোগান কার্যকরী হয়নি। তাঁর নিঃস্বার্থ চরিত্রের প্রভাবকে শুধু রাজনৈতিক কার্যকলাপের দোহাই দিয়ে প্রতিরোধ করা সম্ভব ছিল না।
হযরতের রাজনীতির দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হলো, উপায় উপকরণের পবিত্রতা। তিনি কোন অন্যায় ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী পন্থা অবলম্বন করে রাজনীতি করেননি। তাঁর রাজনৈতিক দুশমনদের সাথে তিনি ব্যক্তিগত আক্রোশও পোষণ করতেন না। কঠিন রাজনৈতিক শত্রুও যদি ইসলামের আদর্শ গ্রহণ করে তাঁর নেতৃত্ব মেনে নিতে রাজি হতো তাহলে তিন পূর্বের সব দোষ মাফ করে দিতেন। তাঁর রাজনীতির তৃতীয় বৈশিষ্ট্য হলো উদ্দেশ্যের পবিত্রতা। ইসলামের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠাই তাঁর কাম্য ছিল। ব্যক্তি প্রতিষ্ঠা যদি তাঁর উদ্দেশ্য হতো তাহলে আন্দোলনের শুরুতেই তিনি মক্কার নেতৃত্বের প্রস্তাব মেনে নিয়ে বাদশাহ হতে পারতেন। চারিত্রিক পবিত্রতা, উপায় ও পন্থার পবিত্রতা এবং উদ্দেশ্যের পবিত্রতা এ তিনটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য রাসূলের রাজনীতিকে স্বার্থপর ও দুনিয়াদারদের রাজনীতি থেকে পৃথক মর্যাদা দান করেছে। যদি কেউ ইসলামী রাজনীতি করতে চায় তাহলে তাকে মহানবীর এ তিনটি রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্যকে মূলধন হিসেবে গ্রহণ করতেই হবে। যাদের চরিত্র, কর্মপন্থা ও উদ্দেশ্য অপবিত্র বলে বোঝা যায়, তারাও যদি ইসলামের নামে রাজনীতি করে তা হলে ইসলামের উপকারের চাইতে অপকারই বেশি হয়। এদের রাজনীতির সাথে রাসূলের রাজনীতির কোনো সম্পর্ক নেই। বরং এদের রাজনীতি অন্যান্য স্বার্থবাদী রাজনীতির চেয়েও জঘন্য।
এ দৃষ্টিভঙ্গিতে বিচার করলে নবীজীবন কুরআনের মতই ব্যাপক ও বিশাল। কুরআন পাককে যেমন ব্যাখ্যা করে শেষ করার উপায় নেই, রাসূলের জীবনী আলোচনা করার ব্যাপারেও কারও পক্ষে চূড়ান্ত কথা বলার ক্ষমতা নেই। চিরদিনই মানুষ এ মহামানবের জীবনসমুদ্র থেকে প্রয়োজন পরিমাণ শিক্ষা ও উপদেশ গ্রহণ করবে। এমনকি তাঁর এক একটি কথা ও ঘটনা থেকে অগণিত আলো বিচ্ছুরিত হবে। কোন দিনই মহাসাগরের অথৈ পানি নিঃশেষ হবে না।
আলোচ্য বিষয়
শেষ কথা
বিশ্বনবীর দায়িত্ব পালন করার জন্য রাজনৈতিক কার্যকলাপ যে অপরিহার্য ছিল তা ঐতিহাসিক সত্য হিসেবে প্রমাণিত। রাজনৈতিক চূড়ান্ত পর্যায় পর্যন্ত না পৌঁছতে পারলে তিনি ইসলামকে বিজয়ী দীন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষমই হতেন না। আজ যদি কেউ দীন ইসলামকে বাস্তবে প্রতিষ্ঠিত করতে চায় তাহলে রাজনীতির পথে অগ্রসর হওয়া ছাড়া তার আর কোনো বিজ্ঞানসম্মত পন্থা নেই। কিন্তু স্বার্থপর, পদলোভী ও দুনিয়া পূজারীদের রাজনীতি ইসলামের জন্য কোনো দিক দিয়েই সাহায্যকারী নয়। ইসলামের নামে যারা এককালে পাকিস্তান আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তারা রাজনীতির ক্ষেত্রে নবীর নীতি ও কার্যক্রম অনুসরণ করেননি বলেই পাকিস্তানে ইসলামী নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি। স্বার্থপর ও আদর্শভিত্তিক রাজনীতি যেমন ইসলামবিরোধী, নবী অবলম্বিত রাজনীতি থেকে পরাক্সমুখ হওয়াও তেমনি অনৈসলামী। বরং রাসূল যে ধরনের রাজনীতি করেছেন তা মুসলমানদের জন্য প্রধানতম ফরজ। এ ফরজটির নাম হচ্ছে জিহাদ। জিহাদ মানেই ইসলামী আন্দোলন এবং রাজনীতিই আন্দোলনের অন্যতম প্রধান অবলম্বন। সুতরাং কতক লোক পরহেজগারির দোহাই দিয়ে রাজনীতি করা অপছন্দ করলেও রাসূলের খাঁটি অনুসারীদের পক্ষে তা পছন্দ না করে কোনো উপায়ই নেই।
[মুহাদ্দিস, ফরিদগঞ্জ মজিদিয়া কামিল মাদ্রাসা, খতীব কালেক্টরেট জামে মসজিদ, চাঁদপুর, পিএইচডি গবেষক, আরবি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী।