বৃহস্পতিবার, ১৬ অক্টোবর, ২০২৫
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ১৬ অক্টোবর ২০২৫, ০৮:৫৩

রাসূল (সা.)-এর শানে সম্মানজনক শব্দ ব্যবহারের হুকুম

মুফতি মুহা. আবু বকর বিন ফারুক
রাসূল (সা.)-এর শানে সম্মানজনক শব্দ ব্যবহারের হুকুম

নবী করিম (সা.) হলেন মানবজাতির শ্রেষ্ঠতম ব্যক্তি। আল্লাহ তাআলা তাঁকে বিশ্বজগতের রহমত হিসেবে প্রেরণ করেছেন। তাঁর প্রতি ভালোবাসা, শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রকাশ করা প্রতিটি মুসলমানের ঈমানের অংশ। রাসূলুল্লাহ (সা:) এর শানে অসন্মান করা বা তাঁর নাম, পদবি, বা ব্যক্তিত্ব নিয়ে অবজ্ঞাসূচক শব্দ ব্যবহার করা শুধু গুনাহ নয় বরং কুফরী-এর কাছাকাছি ভয়ংকর অপরাধ। তাই তাঁর নাম ও সম্বোধনে সম্মানজনক শব্দ ব্যবহার করা ইসলামী শিষ্টাচারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক।

১. কুরআনের দৃষ্টিতে রাসূল (সা.)-এর শানে সম্মান

আল্লাহ তাআলা বহু আয়াতে নবীর সম্মান রক্ষার নির্দেশ দিয়েছেন। নিচে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ আয়াত ও তার ব্যাখ্যা দেওয়া হলো।

(ক) সূরা আল-হুজুরাতের নির্দেশ

“হে মুমিনগণ! তোমরা নবীর কণ্ঠস্বরের উপর তোমাদের কণ্ঠ উঁচু করো না এবং যেমন করে তোমরা একে অপরের সাথে উচ্চস্বরে কথা বলো, তেমনি করে তাঁর সঙ্গে উচ্চস্বরে কথা বলো না; এতে তোমাদের আমল ব্যর্থ হয়ে যেতে পারে অথচ তোমরা তা অনুভব করবে না।”(সূরা আল-হুজুরাত: আয়াত ২)

এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা রাসূল (সা.)-এর সামনে উচ্চস্বরে কথা বলা নিষিদ্ধ করেছেন। শুধু উচ্চস্বরে কথা বলা নয়, এমন আচরণ বা শব্দও ব্যবহার করা নিষিদ্ধ যা নবীর শানে অসম্মান বোধ করায়।

(খ) নাম ধরে না ডাকার আদব

“তোমরা নবীকে সম্বোধন করো না যেমন করে তোমরা একে অপরকে সম্বোধন করো।”(সূরা আন-নূর: আয়াত ৬৩)

আল্লাহ তাআলা শেখাচ্ছেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) কে ‘হে মুহাম্মদ!’ বলে ডাকা যাবে না। বরং বলা উচিত ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ’, ‘ইয়া নাবিয়াল্লাহ’, ‘ইয়া হাবীবাল্লাহ’ ইত্যাদি সম্মানসূচক শব্দে সম্বোধন করতে হবে।

(গ) আল্লাহর নিজস্ব সম্মানসূচক ভাষায় নবীকে ডাকা

কুরআনে আল্লাহ তাআলা অন্য নবীদের সাধারণভাবে তাদের নামে সম্বোধন করেছেন যেমন: “ইয়া আদম”, “ইয়া নূহ”, “ইয়া ইব্রাহীম”, “ইয়া মূসা”, “ইয়া ঈসা”।

কিন্তু রাসূল (সা.) কে কখনোই “ইয়া মুহাম্মদ” বলেননি। বরং সব জায়গায় বলেছেন (হে নবী), (হে রাসূল)।

এতে বোঝা যায় আল্লাহ নিজেও তাঁর প্রিয় নবীর প্রতি অতুলনীয় সম্মান দেখিয়েছেন। মুসলমানের উচিত আরও বেশি শ্রদ্ধার সাথে তাঁর নাম নেয়া।

২. হাদীসের দৃষ্টিতে নবীর প্রতি সম্মান

নবী করিম(সা.) নিজেও তাঁর প্রতি সম্মান প্রদর্শনের আদব শিক্ষা দিয়েছেন।

(ক) রাসূল (সা.)-এর প্রতি ভালোবাসা ঈমানের অংশ

“তোমাদের কেউ প্রকৃত মুমিন হতে পারবে না যতক্ষণ না আমি তার কাছে তার পিতা, সন্তান ও সকল মানুষের চেয়ে অধিক প্রিয় হই।”(বুখারী, হাদীস: ১৫)

অর্থাৎ নবীর প্রতি ভালোবাসা মানেই তাঁর সম্মান রক্ষা। নাম, পদবি, কথাবার্তা, এমনকি আলোচনা করলেও শ্রদ্ধা বজায় রাখতে হবে।

(খ) সাহাবাদের আচরণ

আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন “যখন নবী (সা.) সাহাবাদের সাথে বসতেন, তারা এমনভাবে তাঁর প্রতি চুপচাপ মনোযোগ দিতেন, যেন তাদের মাথায় পাখি বসে আছে।”

(আবু দাউদ: ৪৭৫১)

এর মানে তাঁর সামনে সাহাবারা বিনয়, নীরবতা ও শ্রদ্ধা বজায় রাখতেন; এমনকি কথা বলার সময়ও সাবধান থাকতেন যেন কোনো শব্দে অসম্মান না হয়।

(গ) রাসূল (সা.)-এর নাম শুনলে দরুদ পড়া.” “কৃপণ সেই ব্যক্তি, যার সামনে আমার নাম উচ্চারিত হয় অথচ সে আমার প্রতি দরুদ পাঠ করে না।”(তিরমিজি, হাদীস: ৩৫৪৬)

এটি নবীর সম্মান রক্ষার অন্যতম শিষ্টাচার। রাসূল (সা.) এর নাম শুনলেই দরুদ পাঠ করা তাঁর মর্যাদা প্রদর্শন।

৩. ইসলামী ইতিহাসে নবীর শানে অসম্মান ও তার পরিণাম

ইসলামী ইতিহাসে দেখা যায় যারা নবীর শানে অসম্মান করেছে, তারা কখনো রক্ষা পায়নি। (ক) মক্কার কাফেরদের পরিণতি

তারা রাসূল (সা/) কে পাগল, যাদুকর, অধ্যাত্মবাদী ইত্যাদি বলে অপমান করত। কিন্তু আল্লাহ তাআলা নিজেই তাদের মিথ্যা প্রমাণ করে বলেছেন

(সূরা কলম: আয়াত ২

“আপনি আপনার প্রতিপালকের অনুগ্রহে পাগল নন।”

আল্লাহ তাঁর নবীর মর্যাদা রক্ষা করেছেন এবং অপমানকারীদের ধ্বংস করেছেন।

(খ) মদীনায় হাদ্দাদ নামের এক মুনাফিকের ঘটনা

একবার সে রাসূল (সা,) কে ব্যঙ্গ করে বলেছিল, “আমরা এদের মতো মোটা লোকের কথা শুনতে এসেছি!” এ কথা শুনে সাহাবারা বললেন, “তুই কুফরি করেছিস।”সে বলল, “আমরা তো কেবল মজা করছিলাম।”

তখন আয়াত নাজিল হলো

“তারা বলে, আমরা তো শুধু মজা করছিলাম! বলুন, তোমরা কি আল্লাহ, তাঁর আয়াত ও তাঁর রাসূলকে উপহাস করেছিলে? তোমরা অজুহাত দিও না, তোমরা ঈমান আনার পর কুফরি করেছ।”(সূরা আত-তাওবা: ৬৫৬৬) নবীকে ব্যঙ্গ করা বা অসম্মানজনক শব্দ ব্যবহার করা ঈমান নষ্ট করে দিতে পারে।

৪. ইসলামী ফিকহে নবীর শানে অসম্মানজনক শব্দ ব্যবহারের হুকুম

উলামায়ে কেরাম সর্বসম্মতিক্রমে বলেন

রাসূলুল্লাহ (সা.) এর প্রতি কোনো রকম অসম্মান কুফরি।

(ক) ইমাম নববী (রহ.) বলেন:

“রাসূল (সা.) এর শানে সামান্য অবজ্ঞা বা তুচ্ছতাও কুফরি।” (সহিহ মুসলিমের শরাহের ভূমিকায় বর্ণিত হয়েছে)

(খ) হানাফি ফিকহ অনুযায়ী: ইমাম তাহতাবী বলেন

“যে ব্যক্তি নবী ﷺ-এর নাম নিয়ে বিদ্রূপ বা অসম্মান করে, তার ঈমান নষ্ট হয়ে যায়, তার উপর তওবা ওয়াজিব।”

(হাশিয়ায়ে তাহাবী ৩/২৪৫)

৫. রাসূল (সা.)-এর নাম বা শব্দে সম্মান প্রদর্শনের উপায়

ক. রাসূল (সা.) এর নামের আগে সম্মানসূচক উপাধি ব্যবহার করা:

যেমন

“আমাদের প্রিয় নবী”, “রাসূলুল্লাহ”, “হাবীবুল্লাহ”, “সর্বশেষ নবী”, “বিশ্বের রহমত” ইত্যাদি।

খ. তাঁর নাম শুনলে দরুদ পড়া:

“সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম” অথবা “আলাইহিস সালাতু ওয়াস সালাম” বলা।

গ. কথায়, লেখায় ও আচরণে ভদ্রতা রাখা:

নবীর নাম নিয়ে রসিকতা, মজা করা হারাম।

ঘ. নবীর শানে কোনো বিতর্কে শালীনতা বজায় রাখা:

যদি কারও বক্তব্যে নবীর অবমাননা প্রকাশ পায়, সঙ্গে সঙ্গে তা নাকচ করা ও ক্ষমা না করা।

৬. সাহাবা ও সালাফদের নবীর প্রতি সম্মান প্রদর্শনের উদাহরণ

(ক) আবু বকর (রা.) তিনি নবীর নাম উচ্চারণ করতেন অত্যন্ত ধীরে, যেন কণ্ঠে কাঁপুনি লাগে। একবার নবী (সা.) মসজিদে বললেন, “কেউ যদি আমার ওপর জোরে কথা বলে, তার ঈমানে ঘাটতি আছে।” এরপর থেকে তিনি আর কখনো উচ্চস্বরে কথা বলেননি।

(খ) উমর (রা.) যখন নবী (সা.) এর নামে কথা বলতেন, তাঁর চোখে পানি এসে যেত। একবার বললেন, “আমার মা-বাবা, জান-মাল সবই আপনার জন্য কুরবান, হে আল্লাহর রাসূল!”

(গ) আনাস ইবনে মালিক (রা.) বলতেন, “আমি দশ বছর নবীর সেবা করেছি, কিন্তু তিনি কখনো বলেননি ‘তুমি কেন এটা করলে?’ বা ‘কেন করনি?’।” (বুখারী, মুসলিম) তাঁর প্রতি এমন ভালোবাসা ও সম্মান ছিল যে, নবীর নাম শুনলেই আনাস (রা.) কাঁদতেন।

৭. আধুনিক যুগে রাসূল (সা.)-এর সম্মান রক্ষার দায়িত্ব বর্তমানে মিডিয়া, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও সাহিত্যে কখনো কখনো নবীর নাম অবমাননাকরভাবে ব্যবহৃত হয়। মুসলমানদের উচিত এই বিষয়ে সতর্ক থাকা।

(১) নবীর নাম কোনো কার্টুন, নাটক, বা হাস্যরসে ব্যবহার করা নিষিদ্ধ।

(২) লেখালেখি, বক্তৃতা, নাটক, বা শিক্ষায় নবীর নাম নেওয়ার সময় দরুদসহ সম্মানজনক ভঙ্গি বজায় রাখা জরুরি।

(৩) যারা রাসূল (সা.)-এর বিরুদ্ধে কটূক্তি করে, তাদের আইনগত ও সামাজিকভাবে প্রতিরোধ করা।

(৪) মুসলমানদের মধ্যে নবীর ভালোবাসা জাগাতে দরুদ পাঠ ও তাঁর জীবনী প্রচার করা।

৮. রাসূল (সা.)-এর সম্মান রক্ষার সুফল

১। ঈমান শক্ত হয়

২। আল্লাহর ভালোবাসা অর্জিত হয়।

৩। দুনিয়া ও আখিরাতে মর্যাদা লাভ হয়।

৪। রাসূল (সা.)-এর শাফাআতের অধিকারী হওয়া যায়।

‘তোমাদের মধ্যে যারা আমার ওপর বেশি দরুদ পাঠ করবে, কেয়ামতের দিনে তারাই আমার নিকটে থাকবে।”(তিরমিজি, ৪৮৪)

৯. রাসূল (সা.)-এর সম্মান রক্ষায় কোরআনের আরও দিকনির্দেশনা

কোরআনে শুধু কথায় নয়, মন ও আচরণে নবীর সম্মান রক্ষার আদেশ রয়েছে।

(ক) নবীর নির্দেশ মানার মাধ্যমে সম্মান প্রদর্শন

“যে রাসূলের আনুগত্য করল, সে নিশ্চয়ই আল্লাহর আনুগত্য করল।”(সূরা আন-নিসা: আয়াত ৮০)

নবীর প্রতি আনুগত্য মানেই সম্মান প্রদর্শন। আল্লাহ তাআলা তাঁর আনুগত্যকে নিজের আনুগত্যের সমান করেছেন। এর দ্বারা বোঝা যায় যে রাসূল (সা.)-এর নাম ও নির্দেশকে হালকাভাবে নেয়, সে আল্লাহকেও অবমাননা করছে।

(খ) নবীর কথা অগ্রাহ্য করা মানেই অসম্মান। “যারা নবীর আদেশের বিরোধিতা করে, তারা সাবধান হোক। কোনো ফিতনা বা কষ্টদায়ক শাস্তি যেন তাদের গ্রাস না করে।”(সূরা আন-নূর: আয়াত ৬৩) নবীর কথা অগ্রাহ্য করা শুধু অবাধ্যতাই নয়, তাঁর সম্মানের বিরুদ্ধাচরণও বটে।

১০. রাসূল (সা.)-এর সম্মান রক্ষার জন্য আল্লাহর বিশেষ নির্দেশনা।

(ক) নবীর নামের সঙ্গে নিজের নাম জোড়া দেওয়া।

আল্লাহ তাআলা বলেছেন

“আমি তোমার জন্য তোমার মর্যাদাকে উচ্চ করেছি।”(সূরা আল-ইনশিরাহ: আয়াত ৪)

মুফাসসিররা বলেন: “যেখানেই আল্লাহর নাম উচ্চারিত হয়, সেখানেই নবীর নামও উচ্চারিত হয়। আজানের মধ্যে, ইকামতে, শাহাদাতে, নামাজে, দরুদে।”

(তাফসির ইবন কাসির) অর্থাৎ আল্লাহ নিজেই তাঁর নবীর সম্মান অমর করেছেন। তাই এই সম্মান রক্ষা করা মুসলমানদের ওপর ফরজ।

(খ) নবীর শানে অসম্মান করলে ঈমান নষ্ট হয়। “যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে কষ্ট দেয়, আল্লাহ তাদের উপর দুনিয়া ও আখিরাতে অভিশাপ দিয়েছেন এবং তাদের জন্য অপমানজনক শাস্তি প্রস্তুত রেখেছেন।”(সূরা আল-আহযাব: আয়াত ৫৭) কষ্ট দেওয়া শুধু শারীরিক নয়, মৌখিক অসম্মানও এর অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং যে কেউ নবীকে অবমাননাকর শব্দে সম্বোধন করে, সে এই অভিশাপের অধিকারী।

১১. রাসূল (সা.)-এর সম্মান রক্ষার শিক্ষা সাহাবায়ে কিরাম থেকে। (ক) হযরত আবু সুফিয়ান (রা.)-এর ইসলাম গ্রহণের ঘটনা

হযরত আবু সুফিয়ান (রা.) ইসলাম গ্রহণের আগে মক্কার নেতা ছিলেন। একবার রোমের বাদশাহ হেরাকলিয়াস তাঁকে ডেকে নবী (সা.) সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন “তুমি কি কখনো তাঁকে মিথ্যা বলতে দেখেছ?” তিনি বললেন, “না, তিনি কখনো মিথ্যা বলেননি।”

ইতিহাসে এটি প্রমাণ করে। শত্রুরাও নবীর চরিত্র ও মর্যাদা সম্মান করত।

(খ) উরওয়া ইবনে মাসউদের সাক্ষ্য

হুদায়বিয়া চুক্তির সময় উরওয়া (তখনো মুসলমান হননি) নবীর সাথে সাক্ষাৎ করে বলেছিলেন “আমি রাজা-কায়সার, কিসরা ও নাজাশির দরবার দেখেছি; কিন্তু তোমার সাহাবিদের মতো কেউ কোনো নেতাকে এত শ্রদ্ধা করে না। তোমার সাহাবিরা যখন তোমার থুথু পড়তে দেখত, তখন সেটি ধরত ও মুখে লাগাত। তোমার ওযুর পানি তারা সংগ্রহ করত। তুমি কথা বললে তারা চুপ থাকত।”

(বুখারী, হাদীস ২৭৩১)

এটি নবীর প্রতি সাহাবাদের অসীম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার প্রমাণ।

১২. ইসলামী সমাজে নবীর শানে অসম্মানকারীর শাস্তি

(ক) ইসলামী শরীয়তের অবস্থান:

১। নবীকে গালি দেওয়া বা তুচ্ছ করা কুফরি

২। এমন ব্যক্তির উপর তওবা ও ঈমান নতুন করে আনয়ন ওয়াজিব

৩। ইসলামী রাষ্ট্রে এমন ব্যক্তিকে কঠোর শাস্তি দেওয়া হয়

ইমাম মালিক (রহ.) বলেন: “যে ব্যক্তি নবীকে গালি দেয় বা তাঁকে অবমাননা করে, তার জন্য দুনিয়ায় মৃত্যুদণ্ড এবং আখিরাতে জাহান্নাম।”

(আশ শিফা, খণ্ড ২)

১৩. রাসূল (সা.)-এর প্রতি সম্মান রক্ষার আধুনিক চ্যালেঞ্জ

আজকের যুগে রাসূল (সা.)-এর সম্মান রক্ষার ক্ষেত্র নতুন রূপে চ্যালেঞ্জের মুখে

(ক) মিডিয়া ও কার্টুন অবমাননা: ইউরোপে নবী (সা.)-কে নিয়ে ব্যঙ্গচিত্র প্রকাশ করা হয়েছে। এগুলো মুসলিম সমাজে গভীর আঘাত হানে। এসবের জবাবে মুসলমানদের উচিত শান্তিপূর্ণ উপায়ে নবীর ভালোবাসা প্রচার করা, তাঁর চরিত্র তুলে ধরা।

(খ) সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অসতর্ক আচরণ:

অনেকে অনিচ্ছাকৃতভাবে “মজা করে” নবীর নাম ব্যবহার করে, রসিকতা করে। এটি ঈমানের জন্য ভয়ংকর।

(গ) রাজনৈতিক বক্তৃতা ও সাহিত্যিক লেখায় অবমাননাকর শব্দ:

রাসূল (সা.)-কে তুলনামূলকভাবে সমালোচনার মধ্যে আনা বা সাধারণ মানুষদের মতো উপস্থাপন করা হারাম।

আলেমদের মতে, “যে ব্যক্তি নবীর মর্যাদাকে সাধারণ মানুষের স্তরে নামায়, সে অন্তরে কুফরি পোষণ করে।”

(ফতওয়ায়ে হিন্দিয়া, ২/২৭৬)

১৪. রাসূল (সা.)-এর প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের ভাষাগত শিষ্টাচার

(১) নবীর নাম নেওয়ার আদব: শুধু “মুহাম্মদ” বলা উচিত নয়, বলা উচিত “নবী মুহাম্মদ (সা:)”, “রাসূলুল্লাহ (সা.)”, “হাবীবুল্লাহ (সা.)” ইত্যাদি। নাম লিখলে সর্বদা “(সা.)” লিখতে হবে।

নাম শুনলে সঙ্গে সঙ্গে দরুদ পড়তে হবে।

(২) নবীর কাহিনি বলার সময় শব্দ নির্বাচন:

নবীর জীবনের কোনো ঘটনাকে গল্প, নাটক, রসিকতা বা সিনেমার ভাষায় প্রকাশ করা অনুচিত বরং সম্মানজনক ভাষা ব্যবহার করতে হবে যেমন : “ঘটনা”, “সীরাত”, “ইতিহাস”।

(৩) আলোচনা বা বক্তৃতায়:

বক্তা বা শিক্ষক যখন নবীর কথা বলেন, তখন কণ্ঠে বিনয় ও গাম্ভীর্য থাকা উচিত। হাস্যরস, তুচ্ছতা বা সাধারণ ভঙ্গি ঈমানের ক্ষতি করতে পারে।

১৫. রাসূল (সা.)-এর শানে সম্মান প্রদর্শনের উপকারিতা

(১) আল্লাহর ভালোবাসা অর্জন “বলুন, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবাসো, তবে আমার অনুসরণ করো, তাহলে আল্লাহও তোমাদের ভালোবাসবেন।”(সূরা আলে ইমরান: ৩১)

নবীর প্রতি সম্মান ও অনুসরণ আল্লাহর ভালোবাসার মাধ্যম।

(২) নবীর শাফাআতের অধিকারী হওয়া

“যে ব্যক্তি সকালে দশবার ও সন্ধ্যায় দশবার আমার ওপর দরুদ পাঠ করে, সে কেয়ামতের দিন আমার শাফাআত পাবে।”(তাবরানী)

(৩) গুনাহ মাফ ও মর্যাদা বৃদ্ধি

দরুদ পাঠকারীর আমল বৃদ্ধি পায়, গুনাহ ক্ষমা হয় এবং আল্লাহর কাছে তার মর্যাদা উঁচু হয়। “যে আমার ওপর একবার দরুদ পাঠ করে, আল্লাহ তার ওপর দশবার রহমত বর্ষণ করেন।”(মুসলিম)

১৬. রাসূল (সা.)-এর প্রতি সম্মান প্রদর্শনের বাস্তব আমলসমূহ

১। প্রতিদিন নির্দিষ্ট পরিমাণ দরুদ শরীফ পাঠ করা।

২। নবীর নাম শুনলে সম্মান প্রদর্শন পারে দুরুদ পড়া।

৩। মিলাদ, সীরাত অধ্যয়ন ও প্রচার করা।

৪। নবীর আদর্শ অনুযায়ী জীবন গঠন করা।

৫। নবীর শত্রু ও অপমানকারীদের বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ করা।

৬। নবীর নাম লেখা বা বলার সময় যথাযথ সম্মানজনক ভঙ্গি বজায় রাখা।

১৭. নবীর প্রতি ভালোবাসা ও সম্মান: সাহাবাদের আবেগময় উদাহরণ

(ক) বিলাল (রা.)-এর কান্না

রাসূল (সা:) ইন্তেকাল করলে বিলাল (রা.) আজান দিতে পারছিলেন না। যখন “আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহ” বলার সময় আসত, তিনি হাউমাউ করে কাঁদতেন। এটি নবীর নামের প্রতি তাঁর ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার নিদর্শন।

(খ) খালিদ ইবনে ওয়ালিদ (রা.) তিনি নবীর ব্যবহৃত চুলের একটি অংশ হেলমেটে রাখতেন এবং বলতেন, “যতক্ষণ এটি আমার সঙ্গে থাকবে, আমি যুদ্ধক্ষেত্রে পরাজিত হব না।”

সাহাবারা নবীর শরীরের অংশ, জিনিস, এমনকি ধূলোকণাকেও সম্মান করতেন।

(গ) উম্মে আমারা (রা.) উহুদ যুদ্ধে নবী (সা.) আহত হলে তিনি নিজের দেহ ঢাল করে নবীকে রক্ষা করেন এবং বলেন, “হে আল্লাহর রাসূল, আমার প্রাণ আপনার জন্য কুরবান।”

নবীর সম্মান রক্ষা মানেই নিজের জীবন উৎসর্গ করা। এমনই ছিল তাঁদের ঈমান।

১৮. নবীর শানে অবমাননা প্রতিরোধে মুসলমানদের ভূমিকা

শিক্ষা: শিশুদের ছোটবেলা থেকেই নবীর নামের আদব শেখানো।

প্রচার:

দরুদ ও মিলাদ শরীফ পাঠের মাহাত্ম্য প্রচার করা, রাসূলের জীবনী শেখানো।

আইনি উদ্যোগ: যেখানে নবীর অবমাননা হয়, সঠিক ইসলামী ও আইনগত পদ্ধতিতে প্রতিবাদ করা।

সাহিত্য ও মিডিয়ায় মর্যাদা রক্ষা:

নবী (সা.)-এর চরিত্র, কথা, নাম ব্যবহার করার সময় ইসলামী ভাষার সৌন্দর্য বজায় রাখা।

১৯. রাসূল (সা.)-এর নাম ও ভাষাগত আদব নিয়ে উলামায়ে কেরামের উপদেশ

ইমাম শাফেয়ী (রহ.) বলেন:

“নবীর নাম উচ্চারণ করলে বিনয় ও ভক্তি সহকারে উচ্চারণ করা উচিত; কারণ তাঁর নামেই বরকত।”

ইমাম গাযালী (রহ.) বলেন: “যে ব্যক্তি নবীর নাম শুনে দরুদ না পড়ে, সে আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত।”

ইমাম কাদী আইয়্যাদ (রহ.) বলেন: “রাসূল (সা.)-এর প্রতি সামান্যতম অসম্মান ঈমান নষ্ট করে দেয়; তাই তাঁর নাম, শরীর, পরিবার, সহচর সবকিছু সম্মান করতে হবে।”

নবী করিম (সা.) কেবল ইসলামের বার্তাবাহক নন তিনি মানবতার শিক্ষক, বিশ্বজগতের রহমত, আল্লাহর প্রিয়তম বান্দা। তাঁর নাম, শব্দ, কণ্ঠ, ইতিহাস সবই আমাদের জন্য মর্যাদার বিষয়। তাঁর নামের সঙ্গে শ্রদ্ধা না দেখানো মানে নিজের ঈমানকে ঝুঁকিতে ফেলা।

তাই আমরা যেন নবীর নাম শুনলে সাথে সাথে বলি “সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।” তাঁর প্রতি ভালোবাসা, দরুদ ও অনুসরণই আমাদের ঈমানের পরিচায়ক।

লেখক: ইমাম ও খতিব, বিষ্ণুপুর মনোহরখাদী মদিনা বাজার বাইতুল আমিন জামে মসজিদ, চাঁদপুর সদর, চাঁদপুর।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়