প্রকাশ : ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১০:৪০
বাবাহীন ১৩ বছর

দিন যায়, রাত যায়, কেটে যায় সব অনাথের সাজে,
আমি বসে আছি দূর প্রবাসে,
বাবা ফিরে আসবে বলে
সবাই ফিরে আসে, কই বাবা ফিরে আসে না....
দাদা, দাদী, নানা, নানী, ফুফা, ফুফি সবাই গেলো,
কেউ ফিরে আসেনি।
অবশেষে বাবা গেলেন,
তারও ফেরা হয়নি।
বাবাহীন কেটে গেলো ১৩ বছর। ২০১২ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর প্রিয় বাবা দুনিয়ার সকল মায়া ত্যাগ করে আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন।
একটি পরিবারের সুখ, শান্তির জন্যে বাবা নামক মানুষগুলো ছুটে চলেন ক্লান্তহীনভাবে, আয় রোজগার করে এনে তা তুলে দেন সংসারের মূল চালিকাশক্তি সুখ-দুঃখের প্রধান মা নামক নারীর হাতে, যিনি সন্তানের লেখাপড়া, আত্মীয় স্বজন, পাড়া, প্রতিবেশী সবাইকে মোকাবিলা করেই সংসার এগিয়ে নেন। সেই মাও নেই। এতিম করে ১০ জুন ২০২০ তারিখে তিনিও চলে গেলেন না ফেরার দেশে।
স্মৃতিময় মুহূর্তগুলো
আমাদের পরিবারে আমরা ৩ বোন, ৫ ভাই, বাবা, মা সহ ১০ জন তার সাথে আত্মীয় স্বজনÑসবাইকে সুখে রাখার জন্যে বাবা একাই লড়াই চালিয়েছেন। সরকারি একজন কর্মকর্তা ছিলেন, মাস শেষে বেতন আর যে রেশন পেতেন, তা দিয়েই কাটিয়েছেন জীবন অনেক আনন্দে।
বাবার সাথের অনেক বন্ধু রাতারাতি বড়ো হওয়ার স্বপ্ন দেখেছেন, অনেকেই সম্পদের মালিক হয়েছেন। বাবার সাথে চট্টগ্রামে টেকনিক্যাল সরকারি স্টাফ কোয়ার্টারে ছিলাম আমি। আমার বাবা সবসময় বলতেন, আদর্শগত শিক্ষা জীবন, অন্যের উপকার, সততার সাথে জীবন-যাপন, হালাল ইনকাম, নামাজ, রোজা সহ সকল ভালো কাজের সাথে থাকার নামই জীবন। তুমি অসৎ উপায়ে হয়তো অনেক কিছু করতে পারবে, তবে তা মনের সুখ এনে দেবে না। যত পাবে, মন চাইবে আরও কিছু করি। আর তুমি যদি সৎ উপায়ে আয় করে মানুষের কল্যাণে কাজ করে যেতে পারো, তবেই তুমি সফল।
মনে রাখবে, ফুল ঝরে রেখে যায় বৃতি, আর মানুষ মরে রেখে যায় স্মৃতি। ক্ষণিকের জীবনে ভালো কাজের বিকল্প কিছুই নেই।
বাবার শেখানো কথাগুলো পুঁজি করেই আমরা ভাই, বোন সবাই চলছি সেই পথে। আজ সবাই যার যার জায়গায় আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। অনেক টাকা বা অনেক সম্পদ নেই, তবে আমাদের সকলের মাঝে আছে একে অন্যের প্রতি সম্প্রীতি, ভালোবাসা আর আন্তরিকতা।
বাবা ছিলেন বটবৃক্ষের ছায়া, নিজের জন্যে কিছুই কিনতেন না। তখন আমরা কেউ বুঝতে পারিনি বাবা নিজের জন্যে না কিনে শুধু নতুন জামা কাপড় আমাদের কিনে দিয়েছেন। আমরা নতুন জামা হাতে পেয়ে আনন্দে ভুলে গেছি সব, কেউ বলিনি, বাবা তোমার জন্যে কী কিনেছো? মা জিজ্ঞাসা করলে মুচকি হেসে বলতেন, আমার আছে, আমাকে নিয়ে তোমাদের ভাবতে হবে না।
বাবা সবই করেছেন, সবই বলেছেন, সবই দিয়েছেন। বাবাকে যখন আমরা একটু সুখ-শান্তিতে রাখার চিন্তা করেছি, আমাদের সেই অবস্থান হয়েছে, তখনই মহান আল্লাহর হুকুমে বাবা চলে গেলেন না ফেরার দেশে। যেখান থেকে আর ফিরে আসবেন না। আজ চিৎকার দিয়ে কান্না করতে ইচ্ছে করে ‘বাবা, বাবা’ বলে।
আজ বাবাকে নতুন জামা ক্রয় করে দেয়ার ক্ষমতা হলেও কিছুই করতে পারছি না, অথচ বাবা আমাদের পাশের বাড়িতে ঘুমিয়ে আছেন নিঝুম নিরালায়, ডাকলেও ঘুম ভাংবে না।
বাবাহীন জীবন যে কতো কষ্টের তা আমার মতো যারাই বাবাকে হারিয়েছেন, শুধু কেবল তারাই বুঝবেন। বাবা হলেন একটি পরিবার ও সন্তানের জন্যে মাথার ওপর ছায়া।
যে সকল সন্তান বাবাকে অন্তর থেকে ভালোবাসতে পারেনি তারা বুঝবেনা বাবা কী। আজ নিজেও বাবা হয়েছি, সন্তানের কথা প্রতিটি মুহূর্তে দূরপ্রবাসে বসে মনে পড়ে।
বাবাকে নিয়ে লিখলেও শেষ হবে না, আর মায়ের কথা তো বলে-লিখে শেষ করা যাবে না। শুধু সকলের প্রতি একটিই দাবি ও অনুরোধ, বাবাকে ভালোবাসুন, মায়ের খেদমত করুন, তাদের সম্মান দিন, তাদের যত্ন নিন। সন্তানের জন্যে তারাই পীর। ঘরে পীর রেখে অন্যকে পীর মেনে অভিশপ্ত জীবন পরিহার করুন। বাবা, মায়ের চাইতে বড়ো আপন আর কেউ হবে না, হয় না, হতে পারেও না।
হে আল্লাহ আমার মতো যাদের বাবা দুনিয়ায় বেঁচে নেই, তাদের জান্নাতবাসী করুন। আমিন।
লেখক পরিচিতি : সাংবাদিক, নাট্যকার, লেখক, কবি; মার্কেটিং ডিরেক্টর, রিয়াদ প্রবাসী সেবা কেন্দ্র-ইডিসি (রিয়াদ বাংলাদেশ দূতাবাস অনুমোদিত), সৌদি আরব; সিনিয়র সহ-সভাপতি, বাংলাদেশ প্রবাসী সাংবাদিক ফোরাম, সৌদি আরব।