বৃহস্পতিবার, ০৭ আগস্ট, ২০২৫  |   ৩০ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ০৭ আগস্ট ২০২৫, ০৯:১৬

শিক্ষকতা, সুর ও অভিনয়ে সমান মুগ্ধতা ছড়ানো এক গুণী শিল্পী আজাদ সুমন

কবির হোসেন মিজি
শিক্ষকতা, সুর ও অভিনয়ে সমান মুগ্ধতা ছড়ানো এক গুণী শিল্পী আজাদ সুমন

সংস্কৃতি ও সৃজনশীলতার ভুবনে চাঁদপুরের বহু গুণী মানুষের অবদান রয়েছে। এঁদেরই একজন গুণী, সৃষ্টিশীল ও পরিশ্রমী, যাঁর নাম আজাদ সুমন। জন্ম চাঁদপুরে হলেও দীর্ঘ বছর ধরে বসবাস করছেন শিল্প-সাহিত্যের শহর নারায়ণগঞ্জে। তিনি একাধারে একজন শিক্ষক, সুরকার, কণ্ঠশিল্পী ও অভিনেতা। নানা পরিচয়ের ভিড়ে তাঁর সবচেয়ে বড়ো পরিচয় হচ্ছে তিনি একজন সংস্কৃতিমনস্ক, মেধাবী ও নিরলস সাধক।

বর্তমানে তিনি নারায়ণগঞ্জের প্রখ্যাত হাজী মিসির আলী ডিগ্রি কলেজের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত। শিক্ষকতা পেশার মতো মহান দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি আজাদ সুমন মগ্ন থাকেন সুর ও কণ্ঠের জাদুতে। তাঁর সুর ও সঙ্গীতায়োজনে প্রকাশিত হয়েছে বেশ কিছু গান, যা শ্রোতাদের মধ্যে বেশ সাড়া ফেলেছে। তাঁর করা সুরে অনেক শিল্পীর কণ্ঠে গান প্রকাশ পেয়ে শ্রোতাদের মুগ্ধ করেছে।

শুধু গান নয়, অভিনয়েও তাঁর দক্ষতা প্রশংসনীয়। আজাদ সুমনের অভিনীত একাধিক নাটক, শর্টফিল্ম বিভিন্ন টিভি চ্যানেল ও ইউটিউবে প্রচারিত হয়েছে, যা দর্শকদের কাছে প্রশংসিত হয়েছে। অভিনয়ে তাঁর সহজাত প্রকাশভঙ্গি, অনুভূতির গভীরতা এবং চরিত্রে ডুবে যাওয়ার ক্ষমতা তাঁকে আলাদা করে চিনিয়েছে দর্শক মহলে।

বাংলাদেশ টেলিভিশনের তালিকাভুক্ত একজন সুরকার ও কণ্ঠশিল্পী হিসেবে তাঁর অবদান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই স্বীকৃতি তাঁর দীর্ঘদিনের পরিশ্রম ও শিল্পচর্চার এক অনন্য স্বীকৃতি বলা চলে।

চাঁদপুরের মতো একটি ঐতিহ্যবাহী জেলার সন্তান হয়ে নারায়ণগঞ্জের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে তিনি নিজেকে তুলে ধরেছেন সৃজনশীল এক শক্তি হিসেবে। শহরের মঞ্চ, টিভি পর্দা ও অনলাইন প্ল্যাটফর্মে তাঁর কাজগুলো প্রমাণ করেছে যে, এক মানুষ একইসঙ্গে শিক্ষক, শিল্পী, সুরকার ও অভিনেতা, সবই হতে পারে যদি থেকে যায় সৎ প্রয়াস ও নিরন্তর সাধনা।

এভাবেই নানা ব্যস্ততার মধ্যেও আজাদ সুমন নিজের সৃষ্টিশীলতাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। নতুন প্রজন্মের জন্যে অনুপ্রেরণার বাতিঘর হয়ে আছেন তিনি, যাঁরা বিশ্বাস করেন শিক্ষকতা আর শিল্পচর্চা একসাথে করে সমাজকে আলোকিত করা সম্ভব।

চাঁদপুরের মাটির টান আর নারায়ণগঞ্জের সাংস্কৃতিক আবহ তাঁকে গড়ে তুলেছে এক পরিশীলিত, পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে। তাঁর এই যাত্রা চলুক আরো বহুদূর, এটাই সবার প্রত্যাশা।

সম্প্রতি দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠের ‘সংস্কৃতি অঙ্গন’ পাতার জন্যে তাঁর একটি সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা হয়। প্রাণবন্ত সেই আলাপে উঠে আসে তাঁর সুরের ভুবন, শিক্ষকতা, অভিনয় আর জীবনের নানা অভিজ্ঞতার কথা। কথা বলেন চাঁদপুরের শিকড়, বর্তমান ব্যস্ততা, ভবিষ্যৎ স্বপ্ন ও নতুন প্রজন্মকে নিয়ে তাঁর ভাবনা নিয়েও। নিচে তাঁর সাক্ষাৎকারটি তুলে ধরে হলো

সংস্কৃতি অঙ্গন : আপনার শৈশব ও বেড়ে ওঠার গল্পটি যদি সংক্ষেপে বলেন?

আজাদ সুমন : আমার শৈশবের পাতা খুললেই ভেসে ওঠে চাঁদপুরের ছবি নদীর তীরে দাঁড়িয়ে বিকেল কাটানো, ছেলেবেলার সাইকেল চালানো, স্কুল (তালতলার বিষ্ণুদী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়) ফাঁকি দিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে রেলস্টেশনে ঘোরা কিংবা মেলা দেখা। চাঁদপুর আমার শেকড়, আমার প্রথম ভালোবাসা। এখানেই আমি জীবনকে চিনেছি সরলভাবে, গায়ে মাটি লাগিয়ে, নদীর জলে পা ভিজিয়ে। এই শহরের প্রকৃতি, মানুষ, কাকডাকা ভোরের আওয়াজ সবকিছু এক অনন্য কোমলতা দিয়ে আমার ভেতর গড়ে তুলেছিল। সেই শৈশব পেরিয়ে একসময় জীবন আমায় নিয়ে এলো নারায়ণগঞ্জে এক নতুন শহর, নতুন গতি, নতুন সংগ্রাম। শুরুটা সহজ ছিলো না। সবকিছু নতুন, অপরিচিত; কিন্তু আমি ভেঙ্গে পড়িনি। বরং চেষ্টা করেছি নিজেকে এই শহরের ছন্দে মিশিয়ে নিতে। এখানেই আমি ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছি একজন মানুষ হিসেবে দায়িত্বশীল, পরিশ্রমী, স্বপ্নবাজ। নারায়ণগঞ্জে এসে আমি শিক্ষকতা শুরু করি, সংস্কৃতিচর্চায় জড়িয়ে পড়ি, মঞ্চ ও ক্যামেরার সামনে দাঁড়ানোর সাহস পাই। এই শহর আমাকে দিয়েছে প্ল্যাটফর্ম, পরিচিতি, আর নিজেকে বারবার নতুন করে গড়ার সুযোগ। চাঁদপুর আমাকে শিখিয়েছে কীভাবে হৃদয় দিয়ে ভালোবাসতে হয়, আর নারায়ণগঞ্জ শিখিয়েছে কীভাবে মাথা উঁচু করে বাস্তবের মাটি ছুঁয়ে চলতে হয়। আমি গর্বিত, আমার জীবনের শেকড় ও ডানার দুটি নাম চাঁদপুর আর নারায়ণগঞ্জ।

সংস্কৃতি অঙ্গন : কখন, কীভাবে সুর ও গানের জগতে পথচলা শুরু হয়েছিলো আপনার?

আজাদ সুমন : আমার গানের জগতে প্রবেশটা একটু অন্যরকম। চাঁদপুর থাকতে ছোটবেলায় আমার বড়ো বোনকে গান শেখানোর জন্যে একজন সংগীত শিক্ষিকা রাখা হয়। আমি তখন পাশ থেকে দেখতাম। তিনি বোনকে শিখিয়ে যাওয়ার পর কোনো কিছু না পারলে আমি বোনকে দেখিয়ে দিতাম। তখন মা বলতো, তুইও শিখ। কিন্তু তখন আর শেখা হয়নি, কিন্তু একটু আধটু হারমোনিয়াম এমনিতেই বাজাতে পারতাম। পরবর্তীতে ১৯৯৪ সালে বিটিভির শিল্পী বিন্দু আহমেদের কাছ থেকে তালিম নেই। পরবর্তীতে ছায়ানট সংগীত বিদ্যায়তন থেকে নজরুল গীতিতে ৫ বছরের কোর্স সম্পন্ন করি। পাশাপাশি বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে সংগীতের ওপর বিশেষ প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করি। তখন ২০০৫ সাল। আমি সবেমাত্র নায়ণগঞ্জের হাজী মিছির আলী ডিগ্রী কলেজে হিসাববিজ্ঞান বিভাগের একজন প্রভাষক হিসেবে যোগদান করি। যোগদানের পর থেকেই কলেজের সকল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের দায়িত্ব আমার ওপর পড়ে। সেই রেশ ধরেই কলেজের এক অনুষ্ঠানে ডিগ্রির ছাত্র কাজী ইমরুল কায়েস আমাকে বিটিভির তালিকাভূক্ত গীতিকার ও নাট্যকার চাঁদপুর মতলবের সৈয়দ আহমেদ দোলনের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। তখন সে আমাকে একটা গানের লিরিক্স দিয়ে বলে, এই গানটা সুর করে আপনি গাইবেন। তখন আমি একটু বিচলিত হই এবং চেষ্টা করা শুরু করি। এক পর্যায়ে গানটি সুর করে গাই। গানটি বেশ জনপ্রিয়তা পায় এবং এভাবেই আমার গানের জগতে সুর করার পথচলা শুরু হয়। তারপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। সিনেমা, নাটক ও বিভিন্ন অ্যালবামের জন্যে প্রায় ১২৫ টার মত গান সুর করেছি।

সংস্কৃতি অঙ্গন : শিক্ষকতা ও শিল্পচর্চা, এই দুই দায়িত্ব একসাথে সামলানো কতোটা কঠিন?

আজাদ সুমন : শিক্ষকতা আমার দায়িত্ব, আর সংস্কৃতিচর্চা আমার আত্মার প্রকাশ। এই দুটি পথ যেন আমার জীবনের দুটি ধারাকে বহমান করে রেখেছেÑএকটি জ্ঞানচর্চার, অপরটি সৃষ্টিশীলতার। প্রতিদিন আমি যখন শ্রেণিকক্ষে দাঁড়াই, তখন শুধু পাঠদান করি না; শিক্ষার্থীদের মনন, মূল্যবোধ ও সংস্কৃতির প্রতি ভালোবাসাও জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করি। শিক্ষকতার ভেতর দিয়েই আমি শুদ্ধ চিন্তা, শালীন আচরণ ও নৈতিকতা শেখানোর পাশাপাশি শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতির গুরুত্ব তুলে ধরার সুযোগ পাই।

সংস্কৃতিচর্চাÑহোক তা সংগীত, নাটক, আবৃত্তি বা সাহিত্যÑআমাকে নিজেকে প্রকাশের সুযোগ দেয়, আবার সেই অভিজ্ঞতা আমি ফিরিয়ে দিই আমার শিক্ষার্থীদের মাঝে। শিক্ষা ও সংস্কৃতি একে অপরকে আলোকিত করে; একটিতে মস্তিষ্কের বিকাশ, অন্যটিতে হৃদয়ের পরিপূর্ণতা।

এই দুই দায়িত্ব একসাথে পালন সহজ নয়। সময়ের সঙ্গে লড়াই করতে হয়, কিন্তু ভালোবাসা থাকলে কোনো কিছুই অসম্ভব নয়। সময় ভাগ করে, পরিকল্পনা করে এবং দায়বদ্ধতা নিয়ে আমি চেষ্টা করি প্রতিদিন এই দুটি দায়িত্বই নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করতে।

আমার বিশ্বাস, শিক্ষক হিসেবে যদি আমি সংস্কৃতিমনস্ক হতে পারি, তাহলে আগামী প্রজন্মও শুধু পরীক্ষায় ভালো ফল নয়, বরং মানুষ হিসেবেও বড়ো হয়ে উঠবে।

সংস্কৃতি অঙ্গন : বাংলাদেশ টেলিভিশনের তালিকাভুক্ত সুরকার ও কণ্ঠশিল্পী হওয়ার অভিজ্ঞতা কেমন ছিলো?

আজাদ সুমন : বাংলাদেশ টেলিভিশনের তালিকাভুক্ত সুরকার ও কণ্ঠশিল্পী হওয়া আমার জীবনের এক গর্বিত অধ্যায় যা শুধু একটি অর্জন নয়, বরং একটি স্বপ্নপূরণের অনুভূতি।

এই যাত্রা খুব সহজ ছিলো না। দীর্ঘদিন ধরে সঙ্গীতের চর্চা, সাধনা, শেখা আর নিজেকে তৈরি করার মধ্য দিয়ে আমি এই জায়গায় পৌঁছেছি। অজস্র অনুশীলন, ব্যর্থতা ও সংশয় পেরিয়ে যখন একদিন আমার গাওয়া গান বা সুরায়োজিত সংগীত বাংলাদেশ টেলিভিশনের পর্দায় বাজলো, তখন মনে হয়েছিলো সেই এক মুহূর্তে সব কষ্ট সার্থক।

প্রাথমিকভাবে অডিশন প্রক্রিয়া, পরীক্ষা, মূল্যায়ন এসবই ছিলো বেশ কঠিন ও চ্যালেঞ্জিং। কারণ, এটি কেবল কণ্ঠ বা সুরের সৌন্দর্য নয়, বরং শুদ্ধতা, সময়জ্ঞান, গানের অনুভব ও পারফর্মিং স্কিলÑসবকিছু মিলিয়ে মূল্যায়িত হয়।

এই তালিকাভুক্তির মাধ্যমে আমি শুধু একটি স্বীকৃতি পাইনি, বরং দায়িত্বও পেয়েছি দেশের জাতীয় সম্প্রচার মাধ্যমে সঙ্গীত পরিবেশনার মাধ্যমে মানুষের হৃদয় ছোঁয়ার। আমার সুর বা কণ্ঠ যেন দর্শক-শ্রোতার মনে অনুভব তৈরি করে, সেটাই আমার সবচেয়ে বড়ো চাওয়া।

এ অভিজ্ঞতা আমাকে আরও আত্মবিশ্বাসী করেছে, আরও শৃঙ্খলিত করেছে। আমি শিখেছি সংগীত শুধু গলায় নয়, এটি হৃদয়ে ধারণ করতে হয়। আর সেই হৃদয়ের কথা যদি মানুষ শুনতে চায়, তবেই একজন শিল্পীর পথ সত্যিকার অর্থে সার্থক হয়।

বাংলাদেশ টেলিভিশন আমার শিল্পীজীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক, যা আমাকে আগামীর পথচলায় প্রেরণা জুগিয়ে যাচ্ছে।

সংস্কৃতি অঙ্গন : আপনার সুরে প্রকাশিত কোন্ গানগুলো আপনার কাছে সবচেয়ে বেশি বিশেষ মনে হয়?

আজাদ সুমন : আসলে আমার কাছে সব গানই বিশেষ মনে হয়। কারণ একটা গানের যখন সুর করি তখন তা আমার কাছে একেকটা সন্তানের মতো মনে হয়। তারপরও বলবো, বিশেষ করে গাজী মিজানুর রহমান মিলকীর কথায় জলসা ঘরের গান (সিনেমার জন্য নির্মিত) “আজ আবার ফিরে যাওয়ার জেদ করো না”, সৈয়দ আহমেদ দোলনের কথায় (সিনেমার জন্য নির্মিত) “নদীর আছে ঢেউ আমি আছি তোমার” এবং কবির হোসেন মিজির কথায় একজন সন্তানহারা বাবার আর্তনাদ সম্পর্কিত “এইতো পড়ার টেবিল আছে খাতা বই” ইত্যাদি আমাকে বেশি আবেগী করেছে।

সংস্কৃতি অঙ্গন : নাটক ও শর্টফিল্মে অভিনয়ের অভিজ্ঞতা নিয়ে কিছু বলবেন?

আজাদ সুমন : অভিনয় আমার কাছে কেবল একটি শিল্প নয়, এটি আমার অনুভবের ভাষা। মঞ্চ নাটক থেকে শুরু করে ক্যামেরার সামনে শর্টফিল্ম প্রতিটি চরিত্র, প্রতিটি সংলাপ যেন আমাকে নতুন করে চিনিয়েছে নিজেকে এবং অন্যকে।

নাটকে অভিনয় করার সময় আমি অনুভব করেছি প্রাণের সরাসরি সংযোগ, দর্শকের চোখের ভাষা, মুহূর্তের প্রতিক্রিয়া। মঞ্চে ভুলের কোনো জায়গা নেই এখানে প্রস্তুতি, উপস্থিতি ও আবেগ সবকিছু একসাথে মিশে যায়। প্রতিটি প্রদর্শনী যেন এক নতুন জন্ম।

অন্যদিকে শর্টফিল্মে অভিনয়ের অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখানে প্রতিটি দৃশ্য, প্রতিটি অভিব্যক্তি অনেক বেশি সূক্ষ্ম ও নিয়ন্ত্রিত। ক্যামেরার চোখ অনেক গভীরÑতাতে মিথ্যার কোনো স্থান নেই। ছোট সময়ের ভেতরে একটি বড়ো কথা বলতে হয়, অনুভব করাতে হয়।

এই দুই মাধ্যমে কাজ করার ফলে আমি শিখেছি সময়ানুবর্তিতা, দলগত কাজের গুরুত্ব, সংবেদনশীলতা ও অধ্যবসায়। অভিনয় শুধু ক্যামেরা বা দর্শকের সামনে দাঁড়ানো নয়, এটি নিজেকে উপলব্ধি করা, অন্যের জুতায় নিজেকে কল্পনা করা এবং জীবনের বিভিন্ন রঙকে ধারণ করার এক অপূর্ব যাত্রা।

আমি কৃতজ্ঞ, আমি আনন্দিতÑকারণ অভিনয়ের এই পথ আমাকে আত্মপ্রকাশের সুযোগ দিয়েছে, পাশাপাশি মানুষ ও সমাজকে গভীরভাবে বুঝতে সাহায্য করেছে। আমার অভিনীত প্রায় ৩৫টি নাটক, টেলিফিল্ম ও শর্টফিল্ম বিটিভিসহ বিভিন্ন চ্যানেলে ও ইউটিউবে প্রচারিত হয়েছে। তার মধ্যে আঁধারের শেষে, অনিশ্চিত জীবন, মেগা সিরিয়াল প্রবাসীগ্রাম, কুয়ারা, ন্যায় বিচারক, ৭১-এর মধুমতি ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

সংস্কৃতি অঙ্গন : চাঁদপুর থেকে নারায়ণগঞ্জ, এই যাত্রাপথে কীভাবে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছেন?

আজাদ সুমন : জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপই একেকটি নতুন অভিযাত্রা। চাঁদপুরÑযেখানে আমার শেকড়, শৈশব, প্রথম শিক্ষা আর সংস্কৃতির হাতে-খড়ি। সেই চেনা মুখ, পরিচিত পরিবেশ, নদীর ধারে বেড়ে ওঠা জীবনের সরলতা। আর সেই চাঁদপুর ছেড়ে যখন নারায়ণগঞ্জে এলাম, তখন জানতামÑএই পথ সহজ হবে না, কিন্তু সম্ভাবনাময় হবে।

নারায়ণগঞ্জে এসে প্রথমে পরিবেশটাই ছিলো ভিন্ন নগরজীবনের ব্যস্ততা, মুখভর্তি অপরিচিত মানুষ, আর নতুন এক কর্ম-পরিসর। তবে আমি বিশ্বাস করি, পরিবর্তনকে মেনে নেওয়া নয়, বুঝে নেওয়াই হলো মানিয়ে নেওয়ার প্রথম ধাপ। আমি চেষ্টা করেছি জায়গাটাকে আপন করে নিতে। আমি আমার অভ্যাসে নমনীয়তা এনেছি ভাষা, ভঙ্গি, কাজের ধরনে নতুনত্ব গ্রহণ করেছি। শিক্ষকতা, সংগীতচর্চা বা সাংস্কৃতিক অঙ্গনে নিজের অবস্থান তৈরি করতে চেয়েছি সম্মান, আন্তরিকতা ও শ্রম দিয়ে।

চাঁদপুরের শিকড়ের শক্তি আর নারায়ণগঞ্জের বাস্তবতায় আমার স্বপ্নগুলোকে নতুন রূপে গড়ে তুলেছি। এখানকার মানুষ, সহকর্মী, শিক্ষার্থী, শিল্পী সমাজ এরা আজ আমার আপন হয়ে উঠেছে। আমি শিখেছি, মানিয়ে নেওয়া মানে নিজের পরিচয় হারানো নয়, বরং নিজের স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে নতুন পরিবেশকে আলিঙ্গন করা। এই যাত্রাপথ আমাকে দিয়েছে সহনশীলতা, দিয়েছে ধৈর্য, আর শিখিয়েছেজীবনে আসল সফলতা শুধু পৌঁছানো নয়, বরং প্রতিটি পদক্ষেপে নিজেকে তৈরি করে নেওয়া।

সংস্কৃতি অঙ্গন : শিক্ষক হিসেবে শিক্ষার্থীদেরকে সংস্কৃতির চর্চায় কিভাবে উৎসাহিত করেন?

আজাদ সুমন : শিক্ষকতা শুধুমাত্র পাঠ্যবইয়ের জ্ঞান দেওয়ার সীমায় আটকে নেই এটি একজন মানুষকে সম্পূর্ণভাবে গড়ে তোলার একটি সুযোগ ও দায়িত্ব। আমি বিশ্বাস করি, পাঠ্যশিক্ষার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের মধ্যে নৈতিকতা, সৌন্দর্যবোধ এবং সৃজনশীলতা গড়ে তোলার অন্যতম উপায় হলো সংস্কৃতিচর্চা।

শিক্ষক হিসেবে আমি শুরু করি শ্রেণিকক্ষ থেকেই যেখানে শুধু বিষয়ভিত্তিক আলোচনা নয়, মাঝে মাঝে গল্প, কবিতা, গান বা নাটকের প্রসঙ্গ তুলে ধরে শিক্ষার্থীদের ভাবতে শেখাই। আমি তাদের বলতে চাই, “পৃথিবীটা শুধু অংক আর ব্যাকরণ দিয়ে নয়, গান, ছন্দ আর রঙ দিয়েও গড়া।”

প্রতিটি সাংস্কৃতিক দিবস, জাতীয় অনুষ্ঠান বা স্কুলের যে কোনো আয়োজনে আমি শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে উৎসাহ দিই। কেউ গান গাইতে চায়, কেউ কবিতা আবৃত্তি করতে চায়, কেউ আবার নাটকে অভিনয় করতে চায়Ñআমি তাদের পাশে দাঁড়াই, আত্মবিশ্বাস জোগাই এবং তাদের চেষ্টা ও আগ্রহকে সম্মান করি। অনেক সময় আমি নিজেও অংশ নিইÑগান করি, আবৃত্তি করি কিংবা শিক্ষার্থীদের সাথে মঞ্চে দাঁড়াই। এতে তারা বোঝে, শিক্ষক শুধু পড়ান নাÑশিক্ষকও অনুভব করেন, ভালোবাসেন, ও জীবনের সৌন্দর্যকে লালন করেন।

আমি সবসময় বলিÑসংস্কৃতিচর্চা মানুষকে নম্র করে, সংবেদনশীল করে, এবং সমাজের প্রতি দায়বদ্ধ করে তোলে। একজন শিক্ষার্থী যদি গান, নাটক, সাহিত্য বা চিত্রকলার ভেতর দিয়ে নিজের মনের প্রকাশ ঘটাতে শেখে, তাহলে সে কখনোই কেবল ‘ডিগ্রি’র পেছনে ছোটে না, বরং ‘মানুষ’ হওয়ার পথ খুঁজে পায়।

এই কারণেই শিক্ষক হিসেবে আমি শুধু পাঠদানের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে শিক্ষার্থীদের মাঝে সংস্কৃতির বীজ বপনের চেষ্টা করি যেন তারা একদিন বড়ো হয়ে সুন্দর মন ও সংবেদনশীল চিন্তা নিয়ে সমাজকে আলোকিত করতে পারে।

সংস্কৃতি অঙ্গন : আপনার নতুন কোনো সুর বা প্রজেক্ট আসছে কি?

আজাদ সুমন : বর্তমানে সৈয়দ আহমেদ দোলনের সিনেমা ‘নদী’র ৫টি ও কবির হোসেন মিজির কথায় ১ টি দেশের গানের সুর প্রক্রিয়াধীন আছে।

সংস্কৃতি অঙ্গন : তরুণ প্রজন্ম যারা সঙ্গীত ও অভিনয়ে আগ্রহী, তাদের জন্যে আপনার পরামর্শ কী?

আজাদ সুমন : সঙ্গীত ও অভিনয় এই দুটি ক্ষেত্রই যেমন সৃজনশীল, তেমনি কঠিন ও প্রতিযোগিতামূলক। যারা এই পথে হাঁটতে চায়, তাদের প্রতি আমার আন্তরিক কিছু কথা আছে।

প্রথমত, ভালোবাসা ছাড়া এই পথে টিকে থাকা যায় না। আপনি যদি সত্যিকারের ভালোবাসেন গান কিংবা অভিনয়, তবে সময়, শ্রম আর অধ্যবসায় আপনাকে বাধা দিতে পারবে না। জনপ্রিয়তা নয়, আপনাকে প্রথমে খুঁজে নিতে হবে নিজের সত্যিকারের আগ্রহ।

দ্বিতীয়ত, নিয়মিত চর্চা আর শেখার মানসিকতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিভা থাকলেও পরিশ্রম না করলে তা ঝলসে যায়। গান শেখার জন্যে যেমন একজন ভালো গুরুর প্রয়োজন, তেমনি অভিনয়ের জন্য দরকার পর্যবেক্ষণ, আত্মবিশ্লেষণ ও চর্চা। ইউটিউব, অনলাইন কোর্স, নাটকের দল, কর্মশালাÑএই সবকিছুই হতে পারে শেখার মাধ্যম।

তৃতীয়ত, সমালোচনাকে ভয় না পেয়ে গ্রহণ করুন। কেউ প্রশংসা করবে, কেউ সমালোচনা এইটাই স্বাভাবিক। গঠনমূলক সমালোচনা থেকে শিখুন, আর নেতিবাচকতাকে অনুপ্রেরণায় রূপ দিন।

চতুর্থত, মানবিক গুণাবলি লালন করুন। শিল্পী মাত্রই সংবেদনশীল। বিনয়, শ্রদ্ধা ও সহানুভূতি একজন শিল্পীর সবচেয়ে বড়ো শক্তি।

সবশেষে, মনে রাখবেন, সফলতা রাতারাতি আসে না। ধৈর্য রাখুন, নিজের ওপর বিশ্বাস রাখুন এবং কখনো হাল ছাড়বেন না। নিজেকে সময় দিন, নিজেকে তৈরি করুন।

এই পথ হয়তো সহজ নয়, কিন্তু তৃপ্তিকর। কারণ একদিন আপনার কণ্ঠে বা অভিনয়ে যদি একজন মানুষও আবেগ ছুঁয়ে যায় তবেই আপনি একজন সত্যিকারের শিল্পী।

সংস্কৃতি অঙ্গন প্রতিবেদক : চাঁদপুরের সাথে আপনার বর্তমান যোগাযোগ ও স্মৃতির কোনো বিশেষ গল্প শেয়ার করবেন?

আজাদ সুমন : চাঁদপুর এই নামটি শুধু একটি স্থান নয়, এটি আমার আত্মার ঠিকানা। এখানেই আমার শৈশব কেটেছে, প্রথম স্কুলে যাওয়া, প্রথম গান শেখা সবকিছু শুরু এখান থেকেই। আজ আমি যত দূরেই থাকি, যত ব্যস্তই থাকি চাঁদপুর আমার মধ্যে প্রতিদিন বেঁচে থাকে।

বর্তমানে আমি নারায়ণগঞ্জে থাকলেও চাঁদপুরের সঙ্গে আমার যোগাযোগ কখনো ছিন্ন হয়নি। সময় পেলেই ছুটে যাই নদীর পাড়ে, সেই পুরোনো স্কুল মাঠে, কিংবা পরিচিত গলির চায়ের দোকানে। যাদের সঙ্গে বড়ো হয়েছি, এখনো তাদের সঙ্গে গল্প হয়, হালকা হাসি হয়, মনে পড়ে যায় ফেলে আসা দিনগুলো।

একবার, খুব ব্যস্ত একটা সময়েও ঈদের ছুটিতে ঠিক করলাম এইবার চাঁদপুর যাবো। লঞ্চে করে খুব ভোরে পৌঁছাই। শহরটা তখনো ঘুমন্ত, কিন্তু আমার মনে হচ্ছিল সবকিছু আমার জন্যে জেগে আছে।

চাঁদপুর আমাকে শিখিয়েছে সরলতা, সংস্কৃতির সৌন্দর্য আর হৃদয়ের ভাষা। আজ যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, তার অনেকটাই সম্ভব হয়েছে এই মাটির স্পর্শে।

আমার এখনকার সৃষ্টিশীল পথচলার পেছনে চাঁদপুরের স্মৃতি, পরিবেশ আর মানুষ সবসময় এক অলিখিত শক্তি হয়ে পাশে থেকেছে।

সংস্কৃতি অঙ্গন : ব্যক্তিগত ও পেশাগত জীবনে আগামী দিনের স্বপ্ন বা লক্ষ্য কী?

আজাদ সুমন : প্রতিটি মানুষ বাঁচে স্বপ্ন নিয়ে, আর স্বপ্নই মানুষকে এগিয়ে রাখে। আমারও রয়েছে কিছু ব্যক্তিগত এবং পেশাগত লক্ষ্য যা আমি প্রতিদিন একটু একটু করে গড়ে তুলছি।

ব্যক্তিগত জীবনে, আমি চাই নিজেকে একজন পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে মনের দিক থেকে শান্ত, মূল্যবোধে অটল, এবং মানবিক গুণে সমৃদ্ধ। পরিবারের প্রতি দায়িত্ব পালন, সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা এবং আত্মউন্নয়নের পথে অগ্রসর হওয়াই আমার মূল লক্ষ্য। আমি চাই জীবনকে সাদামাটা হলেও অর্থবহ করে তুলতে যেখানে ভালোবাসা, সততা ও সহানুভূতি থাকবে প্রতিটি পদক্ষেপে।

পেশাগত জীবনে, আমি নিজেকে একজন দক্ষ, সৃজনশীল ও দায়িত্বশীল শিক্ষক ও সংস্কৃতিচার্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চাই। আগামী দিনে আমি শিক্ষার্থীদের জন্যে আরও কার্যকর ও অনুপ্রেরণাদায়ী হয়ে উঠতে চাই। পাশাপাশি সাহিত্য, নাটক, সংগীত কিংবা শর্টফিল্মের মতো সংস্কৃতি চর্চার ক্ষেত্রেও আমি আরও গভীরভাবে যুক্ত থাকতে চাই যাতে সমাজে ইতিবাচক বার্তা পৌঁছে দিতে পারি।

আমার লক্ষ্য শুধু নিজের উন্নয়ন নয় আমি চাই আমার কাজের মাধ্যমে অন্যদের জীবনেও আলো পৌঁছে যাক। আগামী দিনগুলোতে আমি এমন কিছু করতে চাই, যা সময় পেরিয়ে গেলেও মানুষের মনে জায়গা করে নেবে।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়