প্রকাশ : ২২ মে ২০২৫, ০৮:৫৩
রাজপথের জবানবন্দি

মানুষের মধ্যে মেধার বিকাশ ঘটাতে হলেই নিশ্ছিদ্র আত্মবিশ্বাস-ভরপুর অধ্যবসায় প্রয়োজন। যেটি একটা মানুষকে সাত রঙের সমাহার সাদা মানুষে পরিণত করে। তখন তার মধ্যে হিংসা-ক্রোধ-ঘৃণা বিবর্জিত একটা মনুষ্যত্ব বোধ জাগরিত হয়। এটি মুখ্য। আর গৌণ পরিচয় হলো ধর্মীয় সংবিধিবদ্ধতা অর্থাৎ মানুষের জন্যেই ধর্ম, কিন্তু ধর্মের জন্যে মানুষ নয়।
আমি যখন বর্তমান সম্পর্কে জানতে চাই অথবা ভবিষ্যৎ সম্পর্কে, তখন অতীতের দিকে ফিরে তাকাই। কারণ যৌবনের মূল্য বুঝে বৃদ্ধ, স্বাস্থ্যের গুরুত্ব বুঝে অসুস্থ, সম্পদের প্রয়োজনীয়তা বুঝে অভাবী। অতীত হলো মৃত, ভবিষ্যৎ অনাগত আর অতীত হলো বর্তমানের সূতিকাগার অর্থাৎ নবিশিকাল।
বিশ্বের ইতিহাসে প্রস্তর যুগ বলতে মানব ও তার সমাজের বিবর্তন ধারায় একটা পর্যায়কে বোঝানো হয়। যখন মানুষের ব্যবহার্য হাতিয়ার ছিলো পাথর। এ যুগটা ৪০০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দ থেকে ২০০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দের মধ্যে শেষ হয়েছিলো। তারপরই মানব সভ্যতার বিবর্তনের ধারায় তাপোৎপাদী দহনশক্তি আগুন আবিষ্কৃত হয়ে মানব সভ্যতা বিকশিত হতে থাকে এবং বিভিন্ন বাস্তুতান্ত্রিক ব্যবস্থার উদ্ভব হতে হতে আজকের এই ডিজিটাল যুগের উন্মেষ ঘটেছে। তারপর সময়ের বিবর্তনের প্রয়োজনে মানুষের মাঝে জেগেছে সমাজবদ্ধতা এবং সংবেদনশীলতার অনুভূতি। যার প্রভাবে অতি প্রাচীনকাল থেকেই এই বাংলার যৌথ পরিবারের সদস্যদের মধ্যে গড়ে উঠে স্নেহ-মায়া-মমতা, ভালবাসা, সৌহার্দ্য এবং পারস্পরিক অটুট সম্পর্কের বন্ধন। যৌথ পরিবারই হলো শাশ্বত আত্মিক সম্পর্কের সূতিকাগার। তারপর মানুষ ক্রমশ বুঝতে লাগলো, বস্তুর ধর্ম যেমন পানির ধর্ম সমোচ্চশীলতা এবং প্রবহমানতা, চুম্বকের ধর্ম চৌম্বক পদার্থকে আকর্ষণ করা, তামার ধর্ম হলো সব চাইতে কম রোধক নিয়ে বিদ্যুৎ প্রবাহ করা ইত্যাদি। এসব কিন্তু চিরন্তনী।
আভিধানিকভাবে আকিদা শব্দের অর্থ ‘বিশ্বাস’ আর ঈমান শব্দটির অর্থ হলো ‘মেনে নেওয়া’। এ দুটোকে নিয়েই সুপ্রাচীনকাল থেকে মানব সমাজে মানব ধর্মের মধ্যে মনান্তর এবং মতান্তর সুস্পষ্টভাবে দানা বেঁধে আছে। ফলে জীব শ্রেষ্ঠ মানবকুলে যুগে যুগে পারস্পরিক কামড়াকামড়ি এবং রক্তারক্তিতে সুসভ্য মানব সমাজ আজ নিদারুণ অসভ্যতার চাদরে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। এই অসহিষ্ণুতার তলোয়ার কবে নাগাদ শান্ত হয়ে ভেদাভেদ মুক্ত মানব সভ্যতাকে আলিঙ্গন করবে! সভ্য সমাজ সেই অপেক্ষার প্রহর গুণছে। এ পবিত্র বঙ্গভূমিতে অজস্র অমিত বীর পুরুষের জন্ম এবং বিচরণ ক্ষেত্র! এই অনুপম চরম অবস্থার বঙ্গ ভূমির রাজপথ গুলো এর নীরব সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতন এবং ইংরেজ অপশক্তির উত্থান হয়েছিল ১৭৫৭ সালের ২৩ শে জুন ভাগীরথী নদীর তীরে পলাশী প্রান্তরে, একমাত্র নিজেদের মধ্যে মনান্তর-মতান্তর-ক্ষমতা পিপাসু ধূরন্দর মীর জাফর এবং তার অনুসারীদের বিশ্বাস ঘাতকতার কারণে পলাশীর রাজপথ রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল। তারপর ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে ঢাকার রাজপথ বাঙালির রুধিরে লোহিত হয়েছিল। ১৯৬৮ সালের ডিসেম্বর হতে ১৯৬৯ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাংলার ছাত্র সমাজ যে এক সুসংবদ্ধ ও সফল আন্দোলন গড়ে তুলেছিলো তা বাংলার ইতিহাসে বিরল। তখন ঐতিহাসিক এগার দফার বাতাবরণে এক গণ বিস্ফোরক ছাত্র-জনতার আন্দোলনে পাক হানাদারদের স্থিতিকে নড়বড়ে করে দিয়েছিল। তখন ঢাকার রাজপথ এবং বাংলাদেশের সর্বত্র এই দুর্বার আন্দোলন এক দুর্দমনীয় প্রতিবিশ্বে রূপান্তরিত হয়ে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ এক নিরঙ্কুশ স্বাধীনতা যুদ্ধে রূপান্তরিত হয়ে যায়। বাংলার অকুতোভয় ছাত্র-জনতা মিত্র বাহিনীর সহায়তায় মাত্র প্রায় নয় মাসের জল-স্থল-অন্তরীক্ষের ঘোরতর যুদ্ধেই পাক হানাদার বাহিনীকে একই বছরের ১৬ই ডিসেম্বর ৯৩ হাজার বিপুল পরাক্রমশালী সৈন্য নিয়ে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করা হয়। তখন পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি এবং সামরিক শাসক ছিলেন ইয়াহিয়া খান। তার পূর্বসূরি ছিলেন আইয়ুব খান আর উত্তরসূরি ছিলেন জুলফিকার আলী ভুট্টো।
এ সময়ে প্রায় ত্রিশ লাখ লোকের রুধির স্রোত বঙ্গোপসাগরে মিশেছিল। তারপর ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশে ২টি নারকীয় হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছিলো, যা নিতান্তই রাজনৈতিক জিঘাংসা প্রসূত। ১৯৭৭ সালে বিমান বাহিনীর অভুত্থান। সেখানে বিদ্রোহীদেরকে গণহারে ফাঁসিতে ঝুলানো হয়। ২০০৪ সালে ২১ শে আগস্ট নারকীয় গ্রেনেড হামলা। যেটি হয়েছে রাজনৈতিক বৈরিতা প্রসূত। এ ছাড়া সোনার বাংলায় শেখ হাসিনার তোঘলকী স্বৈরশাসন সৃষ্টি করেছিল দ্বি-চারিতা বহুল এক নিন্দিত ও বিতর্কিত শাসন ব্যবস্থা, যা স্পষ্টতই রাজনীতির ইতিহাসকে ভিন্নমুখী করার অপপ্রয়াস মাত্র।
তারপর বাংলাদেশে ছাত্রদের ‘কোটা আন্দোলনে’র বাতাবরণে বাংলাদেশে জুলাই অভ্যুত্থান নামে ছাত্র- জনতার যে বিপ্লব হয়েছিলো, তাতে শেখ হাসিনা এবং তার কতিপয় সহচর দেশ থেকে পলায়নপর হয়। এতে দেশে যে অগণিত নর হত্যাকাণ্ডের রক্তপাত হয়েছিলো তার ও প্রত্যক্ষসাক্ষী ঢাকা সহ বাংলাদেশের সকল জেলার রাজপথগুলো। হে বঙ্গ জননী! তুমিতো রক্তপিপাসু নও! অথচ তোমার বুকের জল-স্থল-অন্তরীক্ষ আজ নর রুধির স্নাত। তোমার অক্ষি সমক্ষে ঘটমান দ্বি-চারিতার কর্মকাণ্ড বেমালুম পরোক্ষ হয়ে সমপরিমাণ প্রাকৃতিক প্রতিক্রিয়ার অপেক্ষমান। বাংলার রাজপথই এর আগম-নিগমের প্রকৃষ্ট সাক্ষী হিসেবে রয়ে গেলো। কারণ ইতিহাস নিশ্চয়ই প্রতিশোধপ্রবণ। আড়াইশ’ বৎসরাধিককাল অবধি যুগে যুগে কোনো না কোনো অজুহাতে বাংলায় বন্ধ হোক রুধিরাসক্ত হোলিখেলা। আর বাংলা ফিরে পাক তার চিরশান্ত সৌম্য-সবুজ-আতিথেয়তা বিজড়িত আবেশ।
বিমল কান্তি দাশ : কবি ও প্রাবন্ধিক। অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র শিক্ষক, বলাখাল যোগেন্দ্র নারায়ণ উচ্চ বিদ্যালয় ও কারিগরি কলেজ, হাজীগঞ্জ, চাঁদপুর।