রবিবার, ১৩ এপ্রিল, ২০২৫  |   ২৮ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   হাইমচরে মাটি বোঝাই বাল্কহেডসহ আটক ৯
  •   কচুয়ায় কৃষিজমির মাটি বিক্রি করার দায়ে ড্রেজার, ভেকু ও ট্রাক্টর বিকল
  •   কচুয়ায় খেলতে গিয়ে আগুনে ঝলসে গেছে শিশু সামিয়া
  •   কচুয়ায় ধর্ষণের অভিযোগে যুবক শ্রীঘরে
  •   ১ হাজার ২৯৫ কেজি নিষিদ্ধ পলিথিন জব্দ করেছে কোস্ট গার্ড

প্রকাশ : ১২ এপ্রিল ২০২৫, ০৯:২৭

‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ থেকে ‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা’ : ঐতিহ্যের পিছু হটা না সংস্কৃতির প্রতিরক্ষা?

অনলাইন ডেস্ক
‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ থেকে ‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা’ : ঐতিহ্যের পিছু হটা না সংস্কৃতির প্রতিরক্ষা?

ভূমিকা : নাম নয়, মূল প্রশ্ন চেতনার

পহেলা বৈশাখ উদ্যাপনের অন্যতম প্রধান সাংস্কৃতিক অনুষঙ্গ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ আয়োজিত ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’, চলতি বছর থেকে নতুন নামে উদ্যাপিত হচ্ছে ‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা’ নামে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক নিয়াজ আহমেদ খান সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “আমরা নাম পরিবর্তন করছি না। আমরা পুরোনো নাম এবং ঐতিহ্যে ফেরত যাচ্ছি, যেটা দিয়ে চারুকলার এই কার্যক্রম শুরু হয়েছিল।”

এই বক্তব্য বহু বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। কারণ চারুকলার শিক্ষক-শিক্ষার্থী এবং দেশের সচেতন নাগরিকদের অনেকেই মনে করেন, এটি আদতে একটি নাম পরিবর্তনই এবং তা এক সাংস্কৃতিক প্রতীককে দুর্বল করার প্রয়াস।

চারুকলার শোভাযাত্রার সূচনা ও তাৎপর্য চারুকলা অনুষদ ১৯৮৯ সালে প্রথম ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ আয়োজন করে। সে সময় দেশ ছিল স্বৈরাচারী শাসনের অধীনে, সামাজিক-রাজনৈতিক দমনের বিরুদ্ধে একটি শিল্পভিত্তিক প্রতিরোধ আন্দোলনের প্রতীক হিসেবেই এই শোভাযাত্রার সূচনা।

নামকরণে ইতিহাস

শোভাযাত্রার নাম রাখা হয় ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’Ñএখানে ‘মঙ্গল’ শব্দটি হিন্দু ধর্মীয় নয়, বরং সংস্কৃতিগতভাবে শুভ ও অশুভের দ্বন্দ্বে শুভ শক্তির আহ্বানকে বোঝাতে ব্যবহৃত হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে চারুকলার সাবেক ডিন প্রফেসর আবুল বারক আলভী একাধিকবার বলেছেন, “মঙ্গল শোভাযাত্রা কোনো ধর্মীয় বিষয় নয়, এটি একটি সাংস্কৃতিক ও প্রতীকী প্রতিবাদ।”

উপাচার্যের বক্তব্য বিশ্লেষণ : সত্যতা কতটুকু?

ঢাবি উপাচার্য বলেছেন, “পুরোনো ঐতিহ্যে ফেরা হচ্ছে”Ñঅর্থাৎ চারুকলার এই শোভাযাত্রা পূর্বে ‘বর্ষবরণ শোভাযাত্রা’ নামে পরিচিত ছিলো। তবে কোনো ঐতিহাসিক রেফারেন্সেই এই দাবির সত্যতা নেই। বরং সকল প্রামাণ্য সূত্র (চারুকলার আর্কাইভ, সংবাদপত্র, সাক্ষাৎকার, শিল্পীদের বক্তব্য) অনুযায়ী, ১৯৮৯ সাল থেকেই এই শোভাযাত্রার নাম ছিলো ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’।

এমনকি এই নাম দিয়েই ২০১৬ সালের ৩০ নভেম্বর ইউনেস্কো একে ‘ওহঃধহমরনষব ঈঁষঃঁৎধষ ঐবৎরঃধমব ড়ভ ঐঁসধহরঃু’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।

তাহলে প্রশ্ন হচ্ছেÑপুরোনো ঐতিহ্যে ফেরত যাওয়া নাকি এক ধরনের নামমাত্র ‘রিব্র্যান্ডিং’?

‘মঙ্গল’ শব্দ নিয়ে বিতর্ক : ভাষা না ধর্ম?

সমালোচকদের অনেকেই ‘মঙ্গল’ শব্দকে ধর্মীয় রঙে রাঙানোর চেষ্টা করছেন। বলা হচ্ছে, এটি হিন্দুদের ধর্মীয় সংস্কৃতি।

কিন্তু বাস্তবে বাংলা ভাষায়Ñ

‘মঙ্গল হোক’

‘শুভ মঙ্গল কামনা’

‘মঙ্গল প্রদীপ’ এগুলো সম্পূর্ণ ধর্মনিরপেক্ষ প্রয়োগ।

বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীতেও আছেÑ

“আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি

মায়ের মুখের মধুর হাসি

মঙ্গলময় আলোতে...”

এখন প্রশ্ন হলোÑযদি রাষ্ট্রীয় সঙ্গীতেও ‘মঙ্গল’ গ্রহণযোগ্য হয়, তবে কেন একই শব্দ একটি শোভাযাত্রার নাম হিসেবে গ্রহণযোগ্য হবে না?

‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা’ : একটি নির্বিষ নাম

‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ নামটি শুধুমাত্র একটি অনুষ্ঠান নয়, বরং এটি ছিলো একটি চেতনাগত প্রতিবাদের প্রকাশ। অন্যদিকে ‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা’ নামটি শুনতে নিরপেক্ষ ও মসৃণ হলেও এর মধ্যে প্রতিবাদ, প্রতিরোধ, শুভ-অশুভের দ্বন্দ্ব এবং কল্যাণের বার্তা অনুপস্থিত।

এটি মূলত ‘অরাজনৈতিক এবং আপোষমুখী সংস্কৃতির’ প্রতি এক ধরণের নমনীয়তা, যা বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় প্রশ্নবিদ্ধ।

ধর্মীয় মৌলবাদের প্রভাব?

গত এক দশকে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক উৎসবগুলোকে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে আক্রমণ করা হয়েছে। নববর্ষে পাঞ্জাবি-শাড়ি পরে মঙ্গল শোভাযাত্রা করা ‘নিষিদ্ধ’ ঘোষণা করতে চেয়েছে কিছু গোষ্ঠী।

এমনকি ২০২৩ সালে কয়েকটি মৌলবাদী সংগঠন একে ‘ভিন ধর্মীয় উৎসব’ বলে বর্জনের আহ্বান জানায়।

এ অবস্থায় মঙ্গল শোভাযাত্রার নাম পরিবর্তন কি মৌলবাদকে তুষ্ট করার প্রয়াস নয়?

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব কী? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শুধু একটি বিশ্ববিদ্যালয় নয়Ñএটি বাংলাদেশের সামাজিক-রাজনৈতিক সংস্কারের অগ্রভাগে থাকা প্রতিষ্ঠান। ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতা আন্দোলন, গণঅভ্যুত্থানÑসবই শুরু হয়েছিল এখান থেকেই। তাই এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাংস্কৃতিক ও চেতনার যে কোনো সংশোধন আসা মানেই তা জাতির মূল্যবোধে ধাক্কা দেওয়া।

আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ঝুঁকিতে?

ইউনেস্কো ২০১৬ সালে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’-কে বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ ঘোষণা করে। তখন বলা হয়েছিল :

“ঞযব গধহমধষ ঝযড়নযধলধঃৎধ ৎবভষবপঃং ঃযব ংবপঁষধৎ রফবহঃরঃু ড়ভ ইধহমষধফবংযর পঁষঃঁৎব.”

নাম পরিবর্তনের ফলে এই আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির স্থিতি কি টেকসই থাকবে? এটি কি ইউনেস্কো কর্তৃক প্রদত্ত মূল ‘আত্মা’ বদলানো নয়?

শিক্ষার্থী ও বুদ্ধিজীবীদের প্রতিক্রিয়া ঢাবি ছাত্র-ছাত্রীদের অনেকে এ সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে, ক্যাম্পাস আলোচনায় তারা বলছেন, “মঙ্গল শোভাযাত্রা শুধু নাম নয়, এটি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার উত্তরাধিকার।”

বাঙালি সংস্কৃতিবিদ সৈয়দ আবুল মকসুদ একবার বলেছিলেন,

“যেখানে সংস্কৃতি দুর্বল হয়, সেখানে মৌলবাদ মাথা তোলে।”

এই বক্তব্য এখন আরও তাৎপর্যপূর্ণ।

ভবিষ্যতের প্রভাব : একটি পরিবর্তনের বহুমাত্রিক ফলাফল

১. সাংস্কৃতিক কার্যক্রমে আত্মসংযম : অন্য উৎসব যেমন রবীন্দ্র-জয়ন্তী, বসন্ত উৎসব ইত্যাদিতেও হয়তো একই চাপ আসবে।

২. শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে মৌলিক চেতনা হ্রাস : শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ‘সেফ পজিশন’ নিতে শুরু করলে, প্রতিবাদের জায়গাগুলো ক্রমশ বিলীন হবে।

৩. রাজনৈতিক মেরুকরণে সংস্কৃতির ব্যবহার : যে কোনো সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এমন পরিবর্তন সংস্কৃতিকে রাজনৈতিক টাগ-অফ-ওয়ারে পরিণত করবে।

আমরা কোন্ পথে?

‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা’ নামটি আপাতত গ্রহণযোগ্য হলেও, এটি ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’-এর প্রতীকী শক্তি ও আন্তর্জাতিক গৌরবকে ছায়ায় ফেলে দেয়। এই পরিবর্তন আদতে একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলনের আত্মাকে দুর্বল করার নামান্তর।

শুধু নাম নয়, প্রশ্নটা হলোÑআমরা কি নিজের ইতিহাসকে ধারণ করবো, নাকি চাপের মুখে তা পাল্টে ফেলবো?

এ প্রশ্নে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সৎ আত্মসমালোচনা, বুদ্ধিজীবী সমাজের সোচ্চার অবস্থান এবং তরুণ প্রজন্মের সচেতনতার প্রয়োজন এখন।

মো. জাকির হোসেন : তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি), চাঁদপুর জেলা।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়