শুক্রবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২১ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের পুত্রবধূ মাদকসহ যৌথ বাহিনীর হাতে আটক।
  •   মহাখালীতে ট্রেন থামিয়ে শিক্ষার্থীদের হামলা, শিশুসহ কয়েকজন রক্তাক্ত
  •   কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে শিক্ষক লাঞ্ছনা ও ভাংচুরের ঘটনা গৃদকালিন্দিয়া কলেজে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ॥ পাঠদান স্থগিত
  •   চট্টগ্রামে মধ্যরাতে ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিল থেকে অর্থদাতাসহ দুজন গ্রেপ্তার।
  •   রাষ্ট্রীয় পদে আসীন হচ্ছেন খবরে আসামিপক্ষে শুনানি করলেন না সমাজী।

প্রকাশ : ২৮ জুন ২০২১, ০০:০০

বিম্বিত বীক্ষণ

অধ্যক্ষ রতন কুমার মজুমদার

অনলাইন ডেস্ক
বিম্বিত বীক্ষণ

পর্ব-১২

শিক্ষা বিজ্ঞানীরা শিক্ষার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন, ‘শিক্ষা হলো আচরণের ইতিবাচক পরিবর্তন’। বার্ট্রান্ড রাসেল বলেছেন, ‘শিক্ষার উদ্দেশ্য হচ্ছে শিক্ষার্থীর উত্তম চরিত্র গঠন’। দার্শনিক সক্রেটিস বলেছেন, শিক্ষার উদ্দেশ্য হলো সত্যের লালন ও মিথ্যার অপনোদন। এককথায় পরিপূর্ণ শিক্ষা শুধু জ্ঞানের স্তরেই সীমাবদ্ধ নয়, জ্ঞানার্জনের পর তা কার্যকরভাবে ব্যবহারিক জীবনে প্রয়োগই হলো শিক্ষা।

শ্রেণীকক্ষে শিক্ষার্থীকে পাঠ বুঝিয়ে দিলেই শিক্ষকের দায়িত্ব শেষ নয়, পাঠ্য বিষয়ের বাইরে সমাজ ও রাষ্ট্রীয় মূল্যবোধের আলোকে শিক্ষার্থীর আচরণ নিয়ন্ত্রণ করা শিক্ষকের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। এ অর্থে বিদ্যালয়কে ‘সমাজের সংস্করণ বলা হয়’। অনেক সময় পরিবারের দীর্ঘদিনের লালিত সংস্কারেও আঘাত হানে শিক্ষক।

একজন শিক্ষক সমাজে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে, গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে। কারণ আমাদের সমাজ শিক্ষকদের শ্রদ্ধার চোখে দেখে, সম্মানের চোখে দেখে। একটা সময় ছিল যখন অভিজাত পরিবারের সন্তানরা শিক্ষকতা পেশায় আসতো সৌখিনতাবশত এবং সম্মান প্রাপ্তির জন্যে। কিন্তু সে ধারাটা দিনদিন কমে যাচ্ছে। এখন অনেকেই শিক্ষকতা পেশায় আসেন শুধুমাত্র কর্মসংস্থানের জন্যে। যখনই শিক্ষকতায় এমন মনোভাবের মানুষের আগমন ঘটেছে তখনই এ পেশা তার সৌন্দর্য, আভিজাত্য, সম্মান হারাতে শুরু করে।

একজন শিক্ষক হবেন তার ছাত্রের কাছে আইকন। একজন শিক্ষককে তার ছাত্ররা অনুসরণ করবে কথায়, আচার-আচরণ, চলনে বলনে নীতি নৈতিকতায়। তাই সেই সমস্ত লোককেই শিক্ষকতায় আবশ্যক। আমাদের সমাজে আশির দশকের পর থেকে শিক্ষক তার আভিজাত্য, নীতি নৈতিকতা হারাতে শুরু করে। কারণ এ পেশায় এমন কিছু লোকের প্রবেশ ঘটেছে, যাদের মধ্যে শিক্ষকতার বিন্দুমাত্র মানসিকতা নেই, নেই কোনো নৈতিকতাবোধ। বর্তমানে সরকারি বলি আর বেসরকারি বলি তা প্রকট আকার ধারণ করেছে। আমার জেঠু আমাদের প্রতিষ্ঠিত রামগঞ্জ হাই স্কুলের অনারারী হেড মাস্টার ছিলেন একমাত্র সৌখিনতার কারণে।

আমি চাঁদপুর সরকারি কলেজে শিক্ষকতা করার সময় যাদেরকে দেখেছি টেবিলের ওপর বই রেখে পরীক্ষা দিয়েছে, শিক্ষকদের সাথে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে কথা বলেছে, নকল করতে না দেয়ার কারণে দোতলা থেকে বেঞ্চ নিচে ফেলে দিয়ে ত্রাস সৃষ্টি করেছে, তাদের কেউ কেউ যখন দেখলাম এ পেশায় যোগ দিয়েছে, তখন মনে মনে ভাবলাম, এ পেশা পথ হারিয়েছে, এ পেশা পচে গেছে। আমি এ শহরেই এমন একজন বেসরকারি শিক্ষককে দেখেছি, যিনি শহরে রাজনৈতিক মিছিলে অংশ নিয়েছে কিরিচ হাতে। এ বিষয়টি আমাকে এতোটা পীড়া দিয়েছে যা আজো ভুলতে পারিনি। নব্বইর দশকে যে হারে অযোগ্য ব্যক্তিরা বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যোগ দিয়েছে শুধুমাত্র দুটি কারণে (এক) চাকুরির প্রয়োজনে কয়েকজন মিলে একটি প্রতিষ্ঠান খুলেছে। আমি সবসময় বলি এটি প্রতিষ্ঠান নয় এটি শিক্ষার দোকান। (দুই) রাজনৈতিক বিবেচনায় অযোগ্যদের নিয়োগ দেয়া হয়েছে। আজ যে শিক্ষায় দুর্বৃত্তায়ন দেখি, এটার একমাত্র কারণ এটি।

আশি এবং নব্বইর দশকে ঢাকার একটি কলেজে গণহারে স্নাতকের সার্টিফিকেট দেয়া হতো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় আমার ক’জন বন্ধু সেই প্রতিষ্ঠানে পড়ালেখা করতো। তাদের সাথে মাঝে মাঝে সেখানে যেতাম। গিয়ে দেখতাম ক্লাসে প্রায় ২৫০ থেকে ৩০০ শিক্ষার্থী উপস্থিত। রুমে জায়গা হয় না তাই বারান্দাতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ক্লাস করছে। আর আমরা যারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম, আমাদের ক্লাসে শিক্ষার্থী সংখ্যা ছিল ৬০ জন। স্যাররা আমাদের প্রত্যেককে চিনতো, নাম জানতো। মানের দিক থেকে পার্থক্যটা এখানেই। আর নব্বইর দশকে যারা শিক্ষক হিসেবে বিভিন্ন কলেজে যোগদান করেছেন তাদের ৯০% ছিল সেই প্রতিষ্ঠানের। শিক্ষকতার যে ইথিক্স তার কোনোটাই তারা মানতো না। সেখান থেকেই বেসরকারি কলেজগুলোর শিক্ষার মানের দৈন্যদশা শুরু হয়। আমার সরল উক্তির জন্যে যদি কেউ কষ্ট পেয়ে থাকেন আমি ক্ষমা প্রার্থী। শুধু বাস্তব চিত্রটা তুলে ধরলাম।

আমি এমন অনেক বেসরকারি কলেজের শিক্ষক দেখেছি, যাদের মূল পেশা নানা রকম ব্যবসা, শিক্ষকতাটা হলো পার্টটাইম চাকুরি। এ জিনিসটা আমি কোনোদিনই মেনে নিতে পারিনি। অদ্যাবধি আমার একই অবস্থা। একজন শিক্ষক হবেন পরিপূর্ণই শিক্ষক, মনেপ্রাণে শিক্ষক। তাঁর ৯৯% শিক্ষক হওয়ার সুযোগ নেই, তাঁকে ১০০% শিক্ষক হতে হবে। এ চাঁদপুর শহরেই আমি অনেক বেসরকারি কলেজের শিক্ষককে দেখেছি শুধুমাত্র কলেজে যান, ক্লাসটি করে বাকি সময় ব্যবসায় মনোযোগ দেন। আবার বেসরকারি কলেজে অফ ডে বলে একটা কথা আছে। যার সাথে আমি কোনোদিন পরিচিত ছিলাম না। সেটা হলো একটি বিভাগে দুজন শিক্ষক থাকলে একজন তিনদিন আসবেন, অপরজন বাকি তিনদিন আসবেন। কী অদ্ভুত, তাই না? এরাই শিক্ষকতার বারোটা বাজিয়েছে। অধ্যক্ষরাও নানা কারণে তাদের এ সুযোগটি দিয়ে থাকেন। অবশ্য সেটা নিয়েও মজার মজার কথা আছে। এমনও শুনেছি, বেতনের একটি অংশ অধ্যক্ষকে দিলে প্রতিষ্ঠানে গরহাজির থাকলে সমস্যা নেই। এ চিত্রটি কিন্তু দেশের সর্বত্র এখনো বিরাজমান। তাদের ন্যূনতম নৈতিকতাবোধ আছে বলে মনে করি না।

ইতিমধ্যে আমার শিক্ষকতা জীবনের দুই বছর হয়ে গেছে। দুই বছর পর একটি ইনক্রিমেন্ট হয়। সেটার জন্যে পরিচালনা পরিষদের সিদ্ধান্তসহ আবেদন করতে হয় ডিজি অফিসে। আমারও চাকুরি স্থায়ীকরণ হলো। রেজ্যুলেশন হলো। অধ্যক্ষ স্যারকে বল্লাম, কাগজপত্র ডিজি অফিসে পাঠাতে হবে। খবর নিয়ে জানলাম ইনক্রিমেন্ট পেতে উৎকোচ দিতে হয়। অবশ্য এটার রেট একটু কম। এগুলো শুনি আর মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে যায়। তখন মনে মনে ভাবি, ডিজি অফিসে কারা চাকুরি করেন। জানলাম দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চ শিক্ষা নিয়ে যারা সরকারি কলেজে যোগদান করেছেন, সেই সমস্ত অধ্যাপকই সেখানে কর্মরত। আশি এবং নব্বইর দশককে ডিজি অফিস ছিল বেসরকারি শিক্ষকদের জন্য এক আতঙ্কের নাম। সেখানে একজন পিয়নের যে দাপট তা একজন সরকারি কলেজের অধ্যক্ষেরও নেই। এই পিয়নরা হলো বিভিন্ন মাধ্যমিক স্কুল বা কলেজের অফিস কর্মচারী এবং পিয়ন। তারা মফস্বল থেকে যাওয়া শিক্ষকদের সাথে এমন কোনো দুর্ব্যবহার নেই যা করতো না। একজন অধ্যক্ষকে গিয়ে সেখানে কেরানীর সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে হতো। ঐ সময়ে একজন এডির দাপট ছিল রাজা বাদশার মত। তাদের সাথে কথা বলতে রীতিমত এপয়েন্টমেন্ট নিতে হতো। ঐ সময়ে যারা বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ছিলেন তারা এ ধরনের অপমান নীরবে সহ্য করতেন। শোনা যেত সেই সময়ে ডিজি অফিসে পোস্টিং-এর জন্যে প্রতিযোগিতা হতো।

সেই সময়টায় একটা কথা প্রচলিত ছিল। চাঁদপুরের কোনো শিক্ষকের ফাইল মুভ করতো না পদ্মার ইলিশ ছাড়া। রাজা বাদশাদের যেমন উপঢৌকন দেয়া হতো, তেমন না দিলে শিক্ষা ভবনে সার্ভিস পাওয়া দুরূহ ছিল। শুধু কর্তা ব্যক্তিদের নয়, তাদের পাইক পেয়াদাদের উপঢৌকন না দিলে তো আপনাকে অফিসারের সাথে সাক্ষাৎই করতে দিতো না। মফস্বল থেকে যে সমস্ত বেসরকারি শিক্ষক বিভিন্ন কাজে ডিজি অফিসে যেতেন তাদের কী পরিমাণ অপমান অপদস্থ হতে হতো তা শুধু ভুক্তভোগীরাই জানেন। মজার বিষয় হলো, যারা সেবা নিতে যান তারা শিক্ষক আর যারা সেবা দেবেন তারাই শিক্ষক। অবশ্য সেবা দাতারা সরকারি কলেজের শিক্ষক। মানে কুলীন শিক্ষক। কাকে কাকের মাংস খায় না, কিন্তু শিক্ষক শিক্ষকের মাংস খেতো।

সময়ের সাথে সে ধারাটা পাল্টেছে। বর্তমানে যারা ডিজি অফিসে বিভিন্ন কাজের জন্যে যান তারা চিত্রটা দেখেননি। সময়ের সাথে সাথে এখন এর অনেক পরিবর্তন হয়েছে। সেই চিত্রটা এখন একেবারেই নেই। ডিজি অফিস এখন শিক্ষকদের সেবা দেবার মানসিকতা পোষণ করে। স্বচ্ছতা এবং জবাদিহিতা অনেকটা নিশ্চিত হয়েছে। আসলে এগুলো নির্ভর করে অফিসারদের মানসিকতার উপর। উপরের দিকের অফিসাররা যদি সৎ হয় তবে নিচের দিকের কর্মচারীরা সঠিক কাজ করতে বাধ্য। আর সার্ভিস বিকেন্দ্রীকরণের কারণে ভোগান্তি নেই বল্লেই চলে। বর্তমানে ডিজি অফিস গ্রাহকদের সেবা দেয়ার জন্যে নানা রকম পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, যা সত্যিই প্রশংসনীয়। অফিসারদের কঠোর মনোভাবের কারণে নিচের দিকের কর্মচারীরা তাদেরও মানসিকতা পরিবর্তন করেছে।

লেখক : অধ্যক্ষ, পুরান বাজার ডিগ্রি কলেজ, চাঁদপুর।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়