প্রকাশ : ২৮ জুন ২০২৩, ১৮:৫৩
ঈদুল আযহার তাৎপর্য ও আমল
যে সব আনুষ্ঠানিক উৎসব মুসলিমদের অস্তিত্বের জানান দেয় ‘ঈদ’ তার অন্যতম। ‘ঈদ’ শব্দটি আরবি যা আওদ থেকে উৎকলিত। এর শাব্দিক অর্থ ঘুরে ঘুরে আসা, প্রবর্তন করা। প্রচলিত অর্থে ঈদ মানে আনন্দ বা খুশি। যেহেতু এ আনন্দ বছর ঘুরে ফিরে আসে এজন্য ঈদকে ‘ঈদ’ বলে নামকরণ করা হয়েছে। মুসলিমদের জাতীয় সংস্কৃতিক চেতনার প্রধান হাতিয়ার হচ্ছে ঈদ।
ঈদের সূচনা : ইসলামের ইতিহাস পাঠে জানা যায় মদীনাবাসী জাহেলী যুগ থেকে শরতের পূর্ণিমায় ‘নওরোজ’ এবং বসন্তের পূর্ণিমায় ‘মেহেরজান’ নামে দু’টো উৎসব পালন করতো। যা ছিল ইসলামের সাথে সামঞ্জস্যহীন। এ ব্যাপারে খাদিমুল রাসূল হযরত আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, “বিশ^নবী (সাঃ) যখন পবিত্র মক্কা নগরী থেকে হিজরত করে মদীনা মুনাওয়ারায় তাশরীফ আনলেন, তখন মদীনাবাসীদেরকে (বৎসরে) দু’দিন খেলাধূলা ও আনন্দ করতে দেখে জিজ্ঞাসা করলেন, এ দু’দিন কিসের? সাহাবাগণ জবাবে বললেন, জাহেলী যুগে আমরা এই দুই দিবসে খেলাধূলা বা আনন্দ প্রকাশ করতাম। অতপর রাসূলে পাক (সাঃ) এরশাদ ফরমালেন, আল্লাহ তা’আলা উপরিউক্ত দিন দু’টির পরিবর্তে তা অপেক্ষা উত্তম দু’টি দিন তোমাদের খুশি প্রকাশ করার জন্য দান করেছেন- এর একটি হচ্ছে- ‘ঈদুল আযহা’ এবং অপরটি হচ্ছে- ‘ঈদুল ফিতর’। (মুসনাদে আহমদ-১৩০৫৮)
এভাবে হিজরি দ্বিতীয় সনে অর্থাৎ ৬২৪ খ্রিষ্টাব্দে মুসলিমদের জন্য পৃথক উৎসবের সূচনা হলো। রাসূল (সাঃ) ঘোষণা করলেন, ‘সব জাতিরই ঈদ বা আনন্দের দিন থাকে, এটা (ঈদুল ফিতর ও আযহা) আমাদের ঈদ। (সহিহ বুখারি-৩৯৩১) এ উৎসব বা আনন্দের দিনগুলো যে কোনো জাতির স্বাতন্ত্র্য ও পৃথক পরিচয়ের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন ও প্রতীক। একটি জাতির স্বতন্ত্র পরিচয়-সত্তা নির্মাণ করতে, তাদের মধ্যে ঐক্যের চেতনা ও ভ্রাতৃত্বের মৈত্রী জাগ্রত করতে সম্মিলিত আনন্দ ও উৎসব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ইসলামী শরীয়তে ঈদ শুধু আনন্দ বা অনুষ্ঠানই নয়; বরং ইবাদত।
ঈদুল আযহার তাৎপর্য : বিশ^ মুসলিম আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য যিলহজ্জ মাসের দশ তারিখে যে ত্যাগের আনন্দে লিপ্ত হয় তাই ঈদুল আযহা। ‘ঈদ’ অর্থ পুনরায় আসা, ‘আযহা’ অর্থ ত্যাগ আর ‘কুরবানী’ অর্থ নৈকট্য লাভের জন্য ত্যাগ। অর্থাৎ আল্লাহর নৈকট্য ও সন্তুষ্টির অর্জনের জন্য যে ত্যাগের ক্ষণ বছর গুরে ফিরে আসে তাই ঈদুল আযহা।
ঈদুল আযহার দিনটি আল্লাহর প্রিয় খলিল হযরত ইবরাহীম (আঃ) এর তাকওয়া ও আনুগত্যের স্মারক। আল্লাহর নির্দেশে তিনি প্রিয় পুত্র ইসমাঈল (আঃ) কে কুরবানী করতে নিয়ে যান; কুরআন কারীমে আল্লাহ তা’আলা তা উল্লেখ করেন, “অতঃপর সে (ইসমাঈল আঃ) যখন তার পিতার সাথে চলাফেরা করার মতো বয়সে উপনীত হলো, তখন ইবরাহীম (আঃ) বললেন, হে বৎস! আমি স্বপ্নে দেখেছি যে আমি তোমাকে কুরবানী করছি; এখন তোমার অভিমত কী? ইসমাঈল (আঃ) বললেন, হে আমার পিতা! আপনি যা আদিষ্ট হয়েছেন তাই করুন। আল্লাহর ইচ্ছায় আপনি আমাকে ধৈর্যশীল পাবেন। যখন তারা উভয়ে আনুগত্য প্রকাশ করলো এবং ইবরাহীম তার পুত্রকে কাত করে শায়িত করলো, তখন আমি তাকে ডেকে বললাম, ‘হে ইবরাহীম! তুমিতো স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করেছো। এভাবেই আমি সৎকর্মশীলদের পুরুস্কৃত করে থাকি। নিশ্চয়ই এটা সুস্পষ্ট পরীক্ষা। আমি তাকে মুক্ত করলাম এক মহান কুরবানীর বদলে।” (সূরা সাফফাত: ১০২-১০৭)
যে দিন ইবরাহীম (আঃ) তাঁর পুত্র ইসমাঈল (আঃ) কে কুরবানী করতে নিয়ে গিয়েছিলেন, সেই দিনটিকেই আমরা ঈদুল আযহা বা কুরবানীর ঈদ হিসেবে পালন করি। প্রতি বছর দিনটি আমাদেরকে আল্লাহর নিঃশর্ত আনুগত্য ও ত্যাগ তিতীক্ষার শিক্ষা দিয়ে যায়। পাশাপাশি এটি উৎসব ও আল্লাহর আতিথেয়তার দিন। আল্লাহর জন্য কুরবানী করে ওই পশুর গোশত আল্লাহর মেহমান হিসেবে আমরা খাই। কুরআন কারীমে আল্লাহ তা’আলা কুরবানীর পশুর গোশত নিজে খেতে ও অন্যদেরকে খাওয়াতে বলেছেন। (সূরা হজ্জ-২৮)
কুরবানী দিতে হবে আল্লাহর নামে, আল্লাহর উদ্দেশ্যে। আল্লাহ তা’আলা বলেন, “আমি প্রত্যেক জাতির জন্য কুরবানীর নিয়ম করে দিয়েছি; এজন্য যে, আল্লাহ তাদেরকে যে সকল চতুষ্পদ জন্তু রিযিক হিসেবে প্রদান করেছেন সেগুলির উপর তারা আল্লাহর নাম যিক্র করতে পারে।” (সূরা হাজ্জ-৩৪) কাফির- মুশরিকরা তাদের দেব-দেবী, বিভিন্ন কবর ও বেদীতে পূজা দেয় এবং মূর্তির উদ্দেশ্যে কুরবানী করে থাকে। তার প্রতিবাদ স্বরুপ আল্লাহ তা’আলা মুসলিমদেরকে আল্লাহর জন্য সালাত আদায় ও কুরবানী করার হুকুম দিয়েছেন। আল্লাহ তা’আলা বলেন, “সুতরাং তোমার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে সালাত আদায় কর এবং কুরবানী কর।” (সূরা কাউসার-২) তাইতো মহানবী (সাঃ) বলেছেন, ‘সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যে ব্যক্তি কুরবানী করল না, সে যেন আমাদের ঈদগাহের নিকটবর্তী না হয়।’
ঈদুল আযহার কিছু আমল : ১. গোসল, সুগন্ধি ও উত্তম পোশাক পরিধান করা- ঈদের দিন গোসল করা, সুগন্ধি ব্যবহার করা এবং সামর্থ্যানুযায়ী উত্তম পোশাক পরিধান করা সুন্নাত, পায়ে হেটে ঈদগাহে যাওয়া, এক রাস্তা দিয়ে যাওয়া অন্য রাস্তা দিয়ে ফিরে আসা, কিছু না খেয়ে ঈদগায়ে যাওয়া সম্ভব হলে কুরবানীর মাংস দিয়ে আহার করা সুন্নাত।
২.তাকবীর বলা- ৯ই যিলহজ্জ ফযর থেকে ১৩ই যিলহজ্জ আসর পর্যন্ত প্রত্যেক ফরয নামাযের পর তাকবীর বলা ওয়াজিব। পুরুষগণ উঁচু আওয়াজে আর নারীগণ নিম্ন আওয়াজে ফরয নামাযের পর একবার বলা সুন্নাত। আর তাকবীরের পদ্ধতি হলো: “ আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ; ওয়াল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার ওয়ালিল্লাহিল হামদ।”
এছাড়া মুসলিমগণ ঘরে, বাজারে এবং মসজিদে অর্থাৎ সকল জায়গায় আল্লাহর মহত্বের ঘোষণা দিয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে। কতইনা সুন্দর ঈদের দিনে মুসলমানের অবস্থা! তাদের আনন্দ উৎসবে তারা সর্বত্র তাকবীর ধ্বনী দ্বারা আল্লাহর বড়ত্ব ও মহত্ব প্রকাশ করে এবং তারা আল্লাহর তাকবীর, প্রশংসা ও একত্ববাদের ঘোষণা দিয়ে আকাশ-বাতাস মুখরিত করে তোলে। তারা আল্লাহর রহমতের আশাবাদী এবং তাঁর আযাবের ভয়ে শঙ্কিত।
৩. ঈদের সালাত আদায় করা- ঈদের সালাত আদায় করা। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা ঈদে বান্দাকে ঈদের সালাতে হুকুম দিয়েছেন। রাসূল (সাঃ) এ বিষয়ে তাঁর উম্মতের নারী-পুরুষ সকলকে আদেশ করেছেন। রাসূল (সাঃ) নারীদের ঈদের সালাদ আদায়ের জন্য ঈদগাহে যেতে বলেছেন। যদিও তাদের জন্য ঈদের সালাত ব্যতীত অন্যান্য সালাত ঘরে পড়াই উত্তম।
উম্মে আতীয়া (রাঃ) বর্ণনা করেন, রাসূল (সাঃ) আমাদেরকে ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহাতে সালাতের উদ্দেশ্যে বের হতে বলেছেন। এমনকি ঋতুবর্তী নারীদেরকেও। ঋতুবর্তী নারীগণ সালাতে অংশগ্রহণ করবে না। ঈদগাহে একপাশে থাকবে এবং দো’আয় শরিক হবে। তিনি বলেন, আমি আরজ করলাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের প্রত্যেকের পর্দা করার মতো চাদর নেই। রাসূল (সাঃ) ঈদুল ফিতরের সালাতে খেজুর না খেয়ে বের হতেন না এবং তিনি বিজোড় সংখ্যায় হিসাব করে খেতেন। (বুখারী ও আহমদ)
তবে আমাদের দেশে মহিলাদের জন্য ঈদগাহে আলাদা ব্যবস্থা থাকা সাপেক্ষে তারা অংশগ্রহণ করবেন।
৪. ঈদের পর শুভেচ্ছা বিনিময় করা- রাসূল (সাঃ) এর সাহাবাগণ সাধারণত শুভেচ্ছা বিনিময়ে বলতেন, ‘তাকাব্বাল্লাহু মিন্না ওয়া মিনকুম।’ অর্থাৎ আল্লাহ আমাদের ও আপনার আমল কবুল করুন। আমরা সাধারণত ঈদ মুবারক বলি; তবে সাহাবাদের বাক্যগুলি ব্যবহার করাই উত্তম।
৫. কুরবানী করা- সামর্থ্যবানেরা ঈদের সালাতের পর কুরবানী দিবেন। ঈদের দিনে কুরবাননীর পশুর রক্ত প্রবাহিত করার চেয়ে উত্তম কোন আমল নেই। কুরবানীর পশুর গোস্ত নিজেরা খাওয়া এবং অন্যদেরকে খাওয়ানো।
আল্লাহ তা’আলার কাছে প্রার্থনা তিনি যেন কুরবানীসহ আমাদের সকল ইবাদত কবুল করেন; এবং তাঁর সান্নিধ্য ও নৈকট্য লাভকারীদের সারিতে আমাদেরকে শামীল করেন। আমিন।
লেখক : নূর মোহাম্মদ, প্রভাষক (ইসলাম শিক্ষা), বলাখাল মকবুল আহমেদ ডিগ্রি কলেজ, বলাখাল, হাজীগঞ্জ, চাঁদপুর।