শনিবার, ০৩ মে, ২০২৫  |   ২৫ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য
ব্রেকিং নিউজ
  •   চাঁদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ইউসুফ গাজী গ্রেফতার

প্রকাশ : ২৭ এপ্রিল ২০২৫, ০১:৫১

লামিয়ার আত্মাহুতি: বিচারহীনতার বিরুদ্ধে এক জ্বলন্ত প্রশ্ন!

বিশেষ প্রতিবেদক :মো. জাকির হোসেন
লামিয়ার আত্মাহুতি: বিচারহীনতার বিরুদ্ধে এক জ্বলন্ত প্রশ্ন!
ছবি : প্রতীকী

আমার ভাগ্নির ধর্ষকরা জামিনে বেরিয়ে এসেছে। এখন আমার ভাগ্নি চলে গেছে। আমরা কার কাছে বিচার চাইবো?

— নিহত লামিয়া আক্তারের মামার এই করুণ প্রশ্ন গোটা জাতির বিবেককে নাড়া দিয়েছে।

পটুয়াখালীর দুমকি উপজেলার পাঙ্গাসিয়া ইউনিয়নের শহিদ জসীম উদ্দিনের মেয়ে লামিয়া আক্তার (১৭) ঢাকায় গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। শনিবার (২৬ এপ্রিল) রাত ৯টায় রাজধানীর শেখেরটেক ৬ নম্বর রোডের বি/৭০ নম্বর বাসায় এ মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে।

ধর্ষণের শিকার থেকে আত্মহত্যা পর্যন্ত: এক করুণ যাত্রা

গত ১৮ মার্চ, নলদোয়ানী এলাকায় বাবার কবর জিয়ারত শেষে নানাবাড়ি ফেরার পথে সাকিব ও সিফাত নামে দুই যুবক লামিয়াকে রাস্তা থেকে তুলে পাশের বাগানে নিয়ে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ করে। অভিযুক্তরা ধর্ষণের ভিডিও ধারণ করে তা সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখায়। ভুক্তভোগী কলেজছাত্রী নিজে দুমকি থানায় অভিযোগ দায়ের করেন।

পুলিশ প্রথমে অভিযুক্তদের মধ্যে একজনকে গ্রেপ্তার করলেও পরে জামিনে ছাড়া পায়। বাকি অপরাধীরা এখনো অধরা। দীর্ঘ সময় ন্যায়বিচারের আশায় অপেক্ষার পরও বিচার না পেয়ে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন লামিয়া।

শেষপর্যন্ত, বিচারহীনতার নির্মম পরিণতি — লামিয়ার আত্মহত্যা।


ধর্ষণের আসামিরা জামিন পেলো কীভাবে?

আইনি বিশ্লেষকরা বলছেন, ফৌজদারি মামলায় ধর্ষণের মতো স্পর্শকাতর অভিযোগে জামিন দেয়া আইনত কঠিন হওয়া উচিত। তবে বাস্তবে দুর্বল চার্জশিট, পুলিশি তদন্তের গাফিলতি, প্রভাবশালী মহলের তদবির, এবং রাষ্ট্রপক্ষের উদাসীনতার কারণে জামিন পেয়ে যায় অপরাধীরা।

  • পুলিশ দ্রুত তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেনি।
  • অপরাধের গুরুত্বের তুলনায় মামলার উপস্থাপনা দুর্বল ছিল।
  • স্থানীয় রাজনৈতিক প্রভাব কাজে লেগেছে।
  • ভিকটিমের পরিবার নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছিল, ফলে সাক্ষ্য প্রভাবিত হওয়ার শঙ্কা দেখা দেয়।

এইসব ফাঁকফোকরের সুযোগে ধর্ষকরা আদালত থেকে জামিন লাভ করে।


অপর আসামিরা এখনো অধরা কেন?

স্থানীয় সূত্র এবং লামিয়ার পরিবারের দাবি, বাকি চিহ্নিত অপরাধীদের বিরুদ্ধে যথাযথ অভিযান পরিচালনা করা হয়নি।

  • পুলিশের তদন্ত ও গ্রেপ্তারের গতি ছিল শ্লথ।
  • এলাকাভিত্তিক প্রভাবশালী মহল আসামিদের রক্ষা করছে।
  • ভুক্তভোগী পরিবারকে নানাভাবে হুমকি দেওয়া হচ্ছিল।

এখন পর্যন্ত সক্রিয় অভিযান এবং সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা না থাকার কারণেই অপর আসামিরা অধরা রয়েছে।


আত্মহত্যার দায়ভার কার?

আইনি বিশ্লেষণ ও মানবাধিকার কর্মীদের মতে:

  • ধর্ষণের অপরাধীদের দ্রুত বিচার না হওয়া।
  • জামিনপ্রাপ্ত অপরাধীদের দ্বারা ভিকটিমের ওপর মানসিক চাপ সৃষ্টির দায়।
  • তদন্ত ও আইনগত পদক্ষেপে প্রশাসনিক ব্যর্থতা।
  • ভিকটিমের মানসিক সাপোর্টের অভাব।

এইসব মিলিয়ে রাষ্ট্র, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও বিচার ব্যবস্থাই মূল দায়ভার এড়াতে পারে না।


এবার দায় যাদের উপর, তাদের শাস্তি কবে? কিভাবে?

মানবাধিকার আইন অনুযায়ী:

  • আত্মহত্যা প্ররোচনার অভিযোগে নতুন মামলা হওয়া উচিত।
  • পুলিশের গাফিলতি খতিয়ে দেখে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।
  • জামিন দেয়া বিচারক যদি তদন্তে অনিয়মে যুক্ত থাকেন, তাহলে বিচার বিভাগের উচ্চ পর্যায়ে তাদের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে।
  • ভিকটিমের পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।

সরকার যদি চায়, তাহলে বিশেষ ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে দ্রুত বিচার করে দায়ী ব্যক্তিদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করা সম্ভব।

তবে এ পর্যন্ত বাস্তবে দেখা গেছে, বিচার বিলম্বিত হয় — এবং সময়ের সাথে সাথে অপরাধীরা দণ্ড থেকে রেহাই পায়।

"এই আত্মহত্যা শুধু ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি নয় — এটি রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতার করুণ দলিল। এখনই দোষীদের আইনের আওতায় না আনলে, লামিয়ার আত্মাহুতি শুধু একটি সংখ্যা হয়েই থাকবে।"


লামিয়া আক্তারের আত্মাহুতির ঘটনা যেন আরেকটি "গুমরে মরা পরিসংখ্যান" হয়ে না যায়। এই মৃত্যু হোক বাংলাদেশের বিচারহীনতার বিরুদ্ধে এক সোচ্চার আন্দোলনের আলোকবর্তিকা।

ডিসিকে/ এমজেডএইচ

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়