প্রকাশ : ১৩ এপ্রিল ২০২৫, ১৬:০৫
ফ্যাসিবাদের মুখ ও শান্তির পায়রা ভস্মীভূত!
চারুকলায় আগুন নাশকতা: পহেলা বৈশাখ উদযাপনের পেছনে কারা?

ঢাকা: পহেলা বৈশাখ বাঙালির চেতনা, সংস্কৃতি ও অসাম্প্রদায়িক মূল্যবোধের প্রতীক। সেই উৎসবকে কেন্দ্র করে ঢাকার চারুকলা অনুষদ প্রাঙ্গণে নির্মিত দুটি প্রতিকৃতিতে আগুন লাগানোর ঘটনা শুধু একক অপরাধ নয়, বরং এর পেছনে থাকতে পারে বৃহৎ কোনো ষড়যন্ত্র—এমনটাই ধারণা করছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং সংশ্লিষ্ট পর্যবেক্ষক মহল।
|আরো খবর
গতকাল শনিবার (১২ এপ্রিল) ভোর ৪টা ৪৫ মিনিটের দিকে মুখে মাস্ক পরা এক যুবক চারুকলার তিন নম্বর গেটের দেয়াল টপকে ভিতরে প্রবেশ করেন। তার পরনে ছিল কালো টি-শার্ট ও খাকি রঙের প্যান্ট। সিসিটিভি ফুটেজ অনুযায়ী, তিনি ভেতরে ঢুকে কিছুক্ষণের মধ্যেই ‘ফ্যাসিবাদের মুখাকৃতি’ এবং ‘শান্তির প্রতীক পায়রা’ মোটিফে আগুন লাগান। ২৩ সেকেন্ডের এই ঘটনা ভিডিওর মাধ্যমে ধরা পড়ে।
ভোর ৫টা ৪ মিনিটে ফায়ার সার্ভিসে খবর গেলে সিদ্দিকবাজার ফায়ার স্টেশনের দুইটি ইউনিট দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছায় এবং ৫টা ২২ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে।
প্রাথমিক তদন্তে কী পাওয়া গেছে?ডিএমপি কমিশনার এস এম সাজ্জাদ আলী জানিয়েছেন, ভিডিও ফুটেজ বিশ্লেষণের মাধ্যমে সন্দেহভাজনকে শনাক্ত করা হয়েছে। প্রযুক্তিগত সহায়তা নিয়ে দ্রুত তদন্ত চলছে এবং শোভাযাত্রা শুরুর আগেই তাকে গ্রেপ্তারের আশা প্রকাশ করা হয়েছে।
ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা বলছেন, “চারুকলা চত্বরে অনেক মোটিফ তৈরি করা হলেও শুধু দুটি নির্দিষ্ট মোটিফে আগুন লাগার বিষয়টি অত্যন্ত সন্দেহজনক।”
সাংস্কৃতিক হামলার আলামত?চারুকলা অনুষদের শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও সাংস্কৃতিক সংগঠকরা একে একটি ‘সাংস্কৃতিক হামলা’ হিসেবে দেখছেন। তারা বলছেন, এ ঘটনা নিছক ভাঙচুর নয়, বরং একটি বৈচিত্র্যপূর্ণ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে ভয় দেখানোর অপচেষ্টা।
চারুকলার এক ছাত্র জানান: “স্বৈরতন্ত্রের মুখ ও শান্তির পায়রা—এই দুটি প্রতীক আমাদের চিন্তার প্রতিবাদ ও স্বাধীনতা বোঝায়। এগুলোতে আগুন দেওয়া সরাসরি অসাম্প্রদায়িক চেতনার ওপর আঘাত।”
পেছনে কোন সংগঠিত চক্র?অনুসন্ধানে জানা গেছে, আগুন লাগানোর ধরন, সময় এবং টার্গেট বাছাই ইঙ্গিত করে যে, এটি নিছক ব্যক্তিগত কোনো ঘটনার চেয়ে সংগঠিত কোনো গোষ্ঠীর পরিকল্পনার অংশ হতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে ধর্মীয় মৌলবাদ, উগ্রবাদী দল এবং রাজনৈতিকভাবে বিভাজন সৃষ্টিকারী কিছু গোষ্ঠী মাঝে মাঝে পহেলা বৈশাখ বা বইমেলা কেন্দ্রিক হামলা চালিয়ে থাকে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক আলী ইমতিয়াজ বলেন: “চারুকলার উপর এমন হামলা একটি বার্তা দিতে চায় যে, তাদের কাছে এই উদারতা ও সাংস্কৃতিক উন্মুক্ততা গ্রহণযোগ্য নয়। এটি স্পষ্টতই সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদ চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা।”
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতাডিএমপি’র একটি গোয়েন্দা ইউনিট জানিয়েছে, ভিডিও বিশ্লেষণ করে সন্দেহভাজনের পরিচয় ও অবস্থান শনাক্ত করা হয়েছে। এর সঙ্গে কারা জড়িত, বা তার কোনো রাজনৈতিক বা উগ্রবাদী সংশ্লিষ্টতা আছে কি না, সেটিও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
কী বার্তা দিচ্ছে এই ঘটনা?বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বারবার হামলার শিকার হয়েছে। ২০০১ সালে রমনার বটমূলে হামলা, ২০১৫ সালে ব্লগারদের হত্যা, কিংবা সাম্প্রতিক কালে বৈচিত্র্যপূর্ণ মিছিল বা শিল্পকর্মে হামলা—সবগুলোতেই একটি অভিন্ন বার্তা: ‘মুক্তচিন্তা ও উদার সংস্কৃতি বিপদে।’
এই ঘটনাও সেই ধারাবাহিকতার অংশ কি না, তা সময়ই বলে দেবে। তবে সংশ্লিষ্টদের মতে, সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ ও সচেতনতা ছাড়া এই হামলা থামানো যাবে না।পহেলা বৈশাখ শুধুমাত্র একটি উৎসব নয়, এটি বাঙালির আত্মপরিচয়ের প্রতীক। চারুকলার প্রতিকৃতিতে আগুন দিয়ে সেই পরিচয়ের ওপর আঘাত হানা হয়েছে।
<এই হামলার পেছনে যে-ই থাকুক না কেন, দ্রুত তদন্ত, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি এবং সর্বোপরি সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ গড়ে তোলাই হবে একমাত্র সঠিক জবাব।
ডিসিকে/ এমজেডএইচ