প্রকাশ : ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০০:০০
নকল এখনও হয়, তবে কিছু শিক্ষকের সহযোগিতায়
পাকিস্তান আমলে ‘এনএসএফ’ নামক ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মীদের কেউ কেউ বিএ পাস করার জন্যে পরীক্ষার হলে ঢুকতো পিস্তল কিংবা ডেগার নিয়ে। চাঁদপুর কলেজে তো এক ছাত্রনেতা টেবিলে ডেগার খাড়া করে রেখে ইচ্ছেমত নকল করে বি.এ. পাস করার কৃতিত্ব (!) দেখিয়ে কিংবদন্তি হয়ে আছেন। স্বাধীনতা অর্জনের পর বাংলাদেশে ১৯৭২ সালে নকলের মহোৎসবে যে এসএসসি পরীক্ষা হয়েছে, তাতে পরীক্ষার হলে অনেক পরীক্ষার্থীকে অস্ত্র সাথে রেখে পরীক্ষা দিতে দেখা গেছে। সেজন্যে বাংলাদেশের পাবলিক পরীক্ষার ইতিহাসে ১৯৭২ সালে এসএসসি পরীক্ষায় পাসকৃত শিক্ষার্থীদেরকে ‘বাহাত্তুইরা পাস’ বলে অনেকে এখনও ব্যঙ্গ করে। ১৯৭৩ সাল থেকে এসএসসি পরীক্ষায় কড়াকড়ি আরোপের নিমিত্তে পরীক্ষার হলের চারপাশে ১৪৪ ধারা জারি এবং নকলবাজদের বহিষ্কারের ব্যবস্থাগ্রহণ করা হয়। তারপর পরিস্থিতি অন্য দিকে মোড় নেয়। শিক্ষাবোর্ডের ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ম্যানেজ করে প্রত্যন্ত এলাকায় পরীক্ষা কেন্দ্র খুলে শিক্ষার্থীদের চুক্তিভিত্তিক পাস করিয়ে দেয়ার পদক্ষেপ নেয় কিছু অসাধু শিক্ষক, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কমিটির সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ও প্রভাবশালী লোকজন। এরা শিক্ষার্থীদের এসএসসি, এইচএসসি ও স্নাতক (বিএ, বিএসসি, বি-কম) পাস করিয়ে দেয়ার ঠিকাদারির দায়িত্বপালন করেন বেশ ক’বছর-একেবারে নিশ্চিন্তে নির্বিঘ্নে। এর ফলে অনেক উচ্ছৃঙ্খল রাজনৈতিক নেতা-কর্মী, বখাটে ছেলে, বাপে তাড়ানো-মায়ে খেদানো পোলাপান এসএসসি, এইচএসসি ও স্নাতক পাস করে তদবিরের জোরে সরকারি-বেসরকারি চাকুরি বাগিয়ে নিয়েছে। আশির দশকে চাঁদপুর কলেজে তো স্নাতক পরীক্ষায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এক্সটার্নাল পরীক্ষক হিসেবে আগত এক শিক্ষককে নকল করতে না পারা বিক্ষুব্ধ এক ছাত্রনেতা জুতা দিয়ে মেরেছে। তারপর ক’বছর চাঁদপুরে আর কেন্দ্র থাকেনি, ডিগ্রি (স্নাতক) পরীক্ষার্থীদেরকে কুমিল্লা গিয়ে দিতে হয়েছে পরীক্ষা।
|আরো খবর
বিশেষ কিছু পরীক্ষা কেন্দ্রে নকলের এমন দাপট বন্ধ হতে নব্বইর দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত সময় লেগে যায়। তারপর পরীক্ষার হলের পরিবেশ ক্রমশ উন্নত হয় এবং নকলমুক্ত পরিবেশে বাংলাদেশের সর্বত্র পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয় বলে বাহ্যিক সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। এমতাবস্থায় দুর্বল-অমনোযোগী শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকরা নৈতিক স্খলনে আক্রান্ত লোভী শিক্ষকদের খুঁজে খুঁজে বের করে এবং এমন শিক্ষকদের মুখে বলা, দেখিয়ে দেয়া, বাতলিয়ে দেয়া, এমনকি নকল সরবরাহের কাজে ব্যবহারের জন্যে আর্থিক চুক্তিতে আবদ্ধ করার সূক্ষ্ম কৌশল অবলম্বন করে। এই সূক্ষ্ম কৌশলের কাছে এখন পর্যন্ত পরাস্ত স্থানীয় প্রশাসন, হল কর্তৃপক্ষ, এমনকি শিক্ষাবোর্ড ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। বাইরে থেকে বাহ্যিক দৃষ্টিতে পরীক্ষার হলের পরিবেশকে মনে হবে অনেক সুন্দর, কিন্তু ভেতরে ঢোকার সুযোগ পেলে আগ্রহী পর্যবেক্ষকমাত্রই তার তীক্ষè দৃষ্টিতে নকলের সূক্ষ্ম কৌশল দেখতে সমর্থ হন। গত তিন বছর আগে চাঁদপুর কণ্ঠে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছে অসাধু কিছু শিক্ষকের সহযোগিতায় পরীক্ষার হলে কীভাবে নকল হয় তার বীভৎস চিত্র সম্বলিত বেশ ক’টি প্রতিবেদন।
গতকাল চাঁদপুর কণ্ঠের প্রতিনিধি নূরুল ইসলাম ফরহাদের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে এমন একটি প্রতিবেদন, যার শিরোনাম হয়েছে ‘রূপসা আহমদিয়া উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্র : টাকার বিনিময়ে নকল সরবরাহ করেন ক’জন শিক্ষক।’ প্রতিবেদক এখানে নকলবাজির যে চিত্র তুলে ধরেছেন, সেটা ফরিদগঞ্জের প্রত্যন্ত এলাকার এই পরীক্ষা কেন্দ্রের চিত্রই কেবল নয়, চাঁদপুর জেলার বিভিন্ন কেন্দ্রসহ দেশের অনেক কেন্দ্রেরই চিত্র। এ চিত্র পাল্টাবার উদ্যোগ নিতেই হবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে। আশা করি শিক্ষামন্ত্রী মহোদয় এ চিত্র পাল্টাবার কার্যকর ও টেকসই পন্থা অবলম্বনের জন্যে যথাযথ ও ত্বরিৎ উদ্যোগ গ্রহণ করবেন।