প্রকাশ : ০৭ জুলাই ২০২১, ০০:০০
ক্ষিরাই নদীর মূল অংশ প্রবাহিত হয়েছে কুমিল্লার দাউদকান্দির ওপর দিয়ে। এ নদীর পাড় ধরেই হেঁটেছি সারাদিন। সঙ্গে ছিলেন কৃষকবন্ধু প্রভাষক মতিন সৈকত।
খুব সকালে গুলিস্তান থেকে বিআরটিসির এসি বাসে চেপে বসি। দেড় ঘণ্টার মাথায় এসে নামি গৌরিপুর। এখানে মতিন সৈকত আগে থেকে আমার অপেক্ষায় ছিলেন। গৌরিপুরে বরইপাতা রেস্টুরেন্টে চা খেয়ে অটোরিকশায় আসি দাউদকান্দির বলদাখাল ড. মোশাররফ কলেজের কাছে। এরপর অটোরিকশায় গোয়ালমারী গ্রামের বাজার। আর এখান থেকেই হাঁটতে শুরু করি আমরা।
হাঁটার আগে গোয়ালমারী বাজারে একটা দোকানে চা খাই। গরুর দুধের চা। দারুণ মজার। চা খেতে খেতে কথা হয় এখানকার মকবুল হোসেন, হাফেজ মো. আবুল কাশেম, জালাল উদ্দিনসহ অনেকের সঙ্গে। তারা জানান, এ ক্ষিরাই এক সময় অনেক বড় ছিল। বড় বড় নৌকা চলাচল করত। আর এখন বর্ষা ছাড়া অন্য সময় পানি থাকে না বললেই চলে।
ক্ষিরাই নদীর পাড়েই মকবুল হোসেনের বাড়ি। নদীর মতো তিনিও তখন জোয়ান। তিনিও ক্ষিরাইয়ে নৌকা বাইতেন, ঘাসী নৌকায় মালপত্র আনা-নেওয়া করতেন এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে, এক বাজার থেকে অন্য বাজারে। মাঝেমধ্যে টানতেন নৌকার গুণ। মাছ ধরেছেন, দলবেঁধে করেছেন গোসল। কিন্তু এখন মকবুল হোসেনের কাছে সেসব শুধুই স্মৃতি। বয়স হয়েছে তার ষাটের ওপর। শরীরে লেগেছে বৃদ্ধের ছাপ। আর তার সঙ্গে সঙ্গে বৃদ্ধের ছাপ ফুটে উঠেছে ক্ষিরাইয়ের শরীরেও। মকবুল হোসেন বলেন, তখন ক্ষিরাই নদীর ভরা যৌবন। নদীতে পানি ছিল থইথই, নিত্যদিন আসা-যাওয়া করত ছোট-বড় নৌকা। নৌকায় পাল তুলে মাঝি গাইত গান। নদীর পানি দিয়ে ফসল বুনতেন কৃষক। আর এখন নানা কারণে পানি শুকিয়ে ক্ষিরাই হয়েছে মরা খালের মতো। অন্যদিকে ক্ষিরাইয়ের ওপর সেতু হওয়ায় নৌকার যাতায়াত কমেছে, বন্ধ হয়েছে নৌকার প্রচলন।
মকবুল হোসেনদের কথা শুনে আমরা গোয়ালমারী গ্রাম ধরে নদীর পাড় দিয়ে হাঁটতে শুরু করি। গোয়ালমারীতেও ক্ষিরাইয়ের ওপর সেতু হয়েছে। ক্ষিরাইয়ের মূল উৎপত্তি দাউদকান্দির গোমতী থেকে, যা গোয়ালমারী থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার পশ্চিমে। এখান থেকে ক্ষিরাই গোয়ালমারী, মাছিদিয়া, কামারকান্দি, চিলি চরগোয়ালী, মিনারদিয়া, জুরানপুর গ্রামের মধ্য দিয়ে চলে গেছে।
ছায়াশীতল গোয়ালমারী গ্রামটি সত্যিই সুন্দর। কিছুক্ষণ হাঁটার পর থামি জুরানপুর এসে। জুরানপুর গ্রামটি যেন পুরোটাই সবুজে ঢাকা। এ গ্রামে বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, স্কুল, মাদ্রাসা, এতিমখানা সবই আছে। স্টেডিয়ামও আছে। আমরা এখানকার যারিফ আলী পাঠাগারের সামনে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিই। এরপর আবার শুরু করি হাঁটা। এখানকার গ্রামগুলোর অনেক রাস্তাতেই দু’পাশে সারি সারি গাছ। ঠিক যেন সবুজ সুড়ঙ্গপথ। হাঁটতে ভালোই লাগে। আমরা হাঁটতে হাঁটতে জুরানপুর বাজার-পালের বাজার পথের সেতুর কাছে আসি। ক্ষিরাইয়ের ওপর এ সেতু। আমরা এ পথ পাড়ি দিয়ে আবার হাঁটতে শুরু করি।
আঁকাবাঁকা ক্ষিরাইয়ের পাড় ধরে আমরা পাড়ি দিচ্ছি একের পর এক গ্রাম। দেখি ক্ষিরাইয়ের কোথাও মোটা, আবার কোথাও চিকন। কোথাও কচুরিপানায় ঢাকা, আবার কোথাও মাছের জন্য বাঁধ। তবে ক্ষিরাইয়ের আশপাশে জনবসতির চাইতে ফসলি জমিই বেশি। আর এসব ফসলি জমিতে দেখি ভুট্টার চাষ।
আমরা হাঁটতে হাঁটতে থামি বিটেশ্বর গ্রাম। আবার বিশ্রাম নিই কিছুক্ষণ। এখানে কথা হয় বিটেশ্বর ইউনিয়ন পরিষদের ১ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য মিজানুর রহমান, আকতারুজ্জামানসহ স্থানীয় কৃষকদের সঙ্গে। তারা জানান, এক সময় এ ক্ষিরাইয়ের পানি দিয়েই এর আশপাশের জমিতে ধান চাষ হতো। কিন্তুপলিমাটি ভরাটসহ নানা কারণে ক্ষিরাইয়ের নব্য দিন দিন কমেছে। এখন বর্ষা ছাড়া অন্য সময় পানি খুব কম থাকে। ধানের পাশাপাশি এ এলাকায় অনেকে ভুট্টার চাষও করেন।
বিটেশ্বর থেকে হাঁটতে হাঁটতে শেষ বিকেলে থামি নৈয়ার বাজার এসে। সারাদিন আমরা ক্ষিরাইয়ের পাড় ধরে প্রায় ১০ কিলোমিটার হাঁটি। শেষে নৈয়ার বাজারের মোজাম্মেল হোটেলে খাই দুপুরের খাবার। আর চা খাই গোপাল মিষ্টান্ন ভান্ডারে। নৈয়ার থেকে ক্ষিরাই চলে গেছে নায়েরগাঁয়ের দিকে আরও প্রায় ১০ কিলোমিলার। আমরা আর সেদিক না গিয়ে গৌরিপুর হয়ে আসি পুটিয়া। তখন সন্ধ্যা। মুক্তিযোদ্ধা তৌহিদুল ইসলাম মোল্লার চায়ের দোকানে বসি। তৌহিদুল ইসলাম মোল্লা নিজ হাতে গরুর দুধ দিয়ে চা বানিয়ে খাওয়ান আমাদের। দারুণ স্বাদের চা। সেই চা খেতে খেতে চলে আরও কিছুক্ষণ আড্ডা। ছবি : লেখক