প্রকাশ : ০৭ জুলাই ২০২১, ০০:০০
এ কে ফজলুল হক সাহেবের সঙ্গেও সে রকম একদিন হঠাৎ করেই আমার দেখা হয়ে যায়। কথাবার্তাও হয়। এর আগে তাঁর মতো এত বড় নেতার সঙ্গে কোনো দিন আমার দেখা-সক্ষাৎ হয়নি। কারণ, আমি আগেই বলেছি, সমাজের যাঁরা নেতা বা লিডার, তাঁদের কাছে বেশি যেতাম না। ফজলুল হক সাহেবের বাড়ি ছিলো তালতলা রোডে। তাঁর বাড়ির পাশের একটা বাড়ি আমি ভাড়া নিয়েছিলাম। তাঁর বাড়ির সঙ্গে আমার বাড়ির ব্যবধান ছিল মাত্র চার ফুট সরু একটা গলির। আমি সেখানে নিচের তলায় থাকতাম। ফজলুল হক সাহেবের নিজের বাড়ি ছিল ঝাউতলায়; কিন্তু সেখানে এত লোকের ভিড় আর এত হই-হল্লা হতো যে, আমি কোনো দিন ওসবের মধ্যে যাইনি। একদিন আমি আমার গাড়ি চালু করার চেষ্টা করছিলাম; কিন্তু স্টার্ট নিচ্ছিল না কিছুতেই। হক সাহেব ওপর থেকে দেখে বললেন, ‘কী গাড়ি স্টার্ট নিচ্ছে না!’ এই বলে উনি নিচে এসে প্রথমেই আমার কাঁধের ওপর হাত রেখে বললেন, পাশের বাড়িতে আপনি থাকেন। আমার স্ত্রী জিনাতুন্নেসা আপনার পত্রিকার নিয়মিত পাঠিকা। সওগাত আমার ঘরে এখনো বাঁধাই করা আছে। আর আপনি কি-না আমার বাড়িতে একদিনও এলেন না। দেখাও করলেন না! এটা কী রকম ব্যাপার, বলুন তো!
আমি বলি, আমি তো একজন ব্যস্তসমস্ত মানুষ, আর আমি সাধারণত বড় লোকদের বাড়িতে যাই না।
উনি বললেন, ‘মনে কষ্ট পেলাম আপনার কথা শুনে। এই দুঃখ আমার মন থেকে যাবে না। এ পৃথিবীতে আমার চেয়ে গরিব আর কেউ নেই।’ কথাটা শেষ করেই বললেন, ‘সন্ধ্যার পর আপনি আমার এখানেই খাবেন।’
আমি তাঁর দাওয়াত কবুল করলাম।
উনি আরও বললেন, ‘জানেন, আমার নামে কয়টা মামলা আছে? কয়টা ওয়ারেন্ট আছে? আমি দেনার দায়ে ডুবে রয়েছি। আমি বাড়ি থেকে পালিয়ে বেড়াই। আমার নামে কোর্ট থেকে ওয়ারেন্ট আসে। রাতের বেলা আমি ঘুমাই না। একটা টেবিলের ওপর কোনো মতে মাথা রেখে সারা রাত আমি কাত হয়ে পড়ে থাকি।’
বললাম, এত কিছু তো আমি জানতাম না।
এসবই বরিশালে স্যার নাজিমউদ্দিনের সঙ্গে তাঁর ভোটযুদ্ধ হওয়ার মাস কয়েক আগেকার কথা। প্রথম যখন স্বায়ত্তশাসনের ওপর ভোট হলো, ঠিক তখনকার কথা। সাক্ষাতে উনি বললেন, ‘আমি একটা কথা বলার জন্য আপনাকে ডেকেছি। আসেন, আগে খাওয়াদাওয়া করে নিই।’
খাওয়াদাওয়া শেষ হলে আমার হাতে টাইপ করা একটা কাগজ তুলে দিয়ে তিনি বললেন, ‘আমি কৃষক প্রজা পার্টির পক্ষ থেকে দাঁড়াব আর গরিবের ডাল-ভাতের সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা করব। এটাই হলো আমার নির্বাচনী প্রচারের মূল কথা। গরিবের জন্য আমি খাটব, কৃষক প্রজা পার্টির জন্য কাজ করব; কিন্তু আমার মুশকিল হলো যে, যখন মুসলমানের কথা বলি, তখন হিন্দুরা বলে সাম্প্রদায়িক, আবার যখন হিন্দুদের কথা বলি, তখন মুসলমানরা দেয় গাল। দেখেন আমার সমস্যাটা তাহলে কী রকম! কাজেই আমি যে কথাগুলো বলি, আমি ঠিকই বলি; কিন্তু বুঝবার ভুলে লোকজন আমাকে এ রকমভাবে নাস্তানাবুদ করে ছাড়ে। কাগজে নানা ধরনের লেখালেখি হয়।’
ফজলুল হক সাহেবের কথা শুনে আমি বলি, যারা কাজ করে যারা কর্মী, তারা এসব কথা গায়ে মাখে না। তারা কাজ করেই যায়।
উনি বললেন, ‘খুব খুশি হলাম। আপনি আমার এই প্রোগ্রামটা একবার দেখেন।’
দেখলাম এ দেশের গরিবদের জন্য, কৃষক-প্রজাদের উন্নতির জন্য কী কী করা যায়, এসব লেখা আছে হাতে লেখা নির্বাচনী কর্মসূচিতে। আমি বললাম, আপনার নির্বাচনী-কর্মসূচির সঙ্গে আমার সওগাত-এর লক্ষ্যের অনেকটা মিল আছে। আমিও সাহিত্যের মাধ্যমে সমাজের কুসংস্কার, কৃষকের উন্নতি, জাতির উন্নতি, এগুলো চাই। কাজেই আপনার কর্মসূচি আমার খুব ভালো লেগেছে।
উনি বললেন, ‘আমি যে ইলেকশন করব, তার প্রচারকাজের জন্য আমার নিজস্ব প্রেস, টাকাপয়সা নেই। খরচ জোগাতে পারছি না। আপনি আমার জন্য কী করতে পারেন?’
আমি বললাম, আমারও পকেট খালি, তবে আপনার যে উদ্দেশ্য সেটা আমি সমর্থন করলাম এবং আমার প্রেসে ছাপার যাবতীয় বিল আপনি নির্বাচনের পরে দিতে পারেন।
তিনি বললেন, ‘তাহলে তো একটা সমস্যা মিটল। তবে কাগজ পাব কোথা থেকে, কীভাবে?’
আমি বললাম, দেখি ভোলানাথ দত্তের ওখান থেকে কাগজ আনতে পারি কি না। দোকানে গিয়ে বলি যে হক সাহেব নির্বাচনে দাঁড়িয়েছেন, আপনি কাগজটা দেবেন।
শুনে দোকান থেকে বলা হলো যে আমার কাছ থেকে কাগজ নিয়েই উনি নবযুগ চালিয়েছিলেন। পাঁচ হাজার টাকা বাকি পড়ে আছে। এখনো দেননি। হাইকোর্টে কেস করেছি। তাঁর নামে ডিক্রি হয়ে আছে; কিন্তু আমি অ্যাকশন নিইনি।
আমি বলি, আপনি এক কাজ করেন, ইলেকশনের জন্য যা কাগজ লাগবে দেন। বিল করবেন সওগাত-এর নামে।
এ কথা শুনে তাঁরা বললেন, তাহলে দিতে পারব।
তারপর ফজলুল হক সাহেব নাজিমুদ্দিন সাহেবের বিরুদ্ধে কী রকম পোস্টার ছাপলেন, তাতে কী লিখলেন, জানেন? লিখলেন, ‘ভাইসব, তোমাদের পোস্ট কার্ডের দাম ছিল এক পয়সা, সেই পোস্ট কার্ডের দাম তিন পয়সা করল কে? নাজিমুদ্দিন।’
‘ভাইসব, তোমরা যে নুন দিয়া পান্তাভাত খাও, সেই নুনের ওপর ট্যাক্স বসাল কে? নাজিমুদ্দিন।’ এ ধরনের কথাবার্তাই লিখলেন।
নির্বাচন হলে ১২/১৩ হাজার ভোটের ব্যবধানে হক সাহেব পাস করলেন। নাজিমুদ্দিন সাহেবের পক্ষে গভর্নর নিজে সব ধরনের নির্বাচনী রসদ জুগিয়েছেন। তিনি তাঁকে মোটর লঞ্চ দিয়েছেন, লোকজন দিয়েছেন, নৌকা ভাড়া করে দিয়েছেন। অন্যদিকে ছেঁড়া কাপড় পরে হক সাহেবের পক্ষে গ্রামের ছেলে-ছোকরারা নৌকা ঠেলেছে। ইলেকশনের খবর শুনে আমি আমার পরিচিত লোকজনদের বলি, হক সাহেব জিতেছেন, যাও রাস্তার ধারের রেলিংয়ে রেলিংয়ে মোমবাতি জ্বালাবার ব্যবস্থা করো। ফলে তারা বাতি জ্বালিয়ে উৎসব শুরু করে দেয়। কতক্ষণ পর হক সাহেব রাস্তা থেকে ওপরের দিকে চেয়ে দেখেন অবাক কাণ্ড। দৌড়ে এসেছেন ওপরে। আমি সামনে পড়তেই বলে ওঠেন, এখানে বাতি জ্বালাল কে?
আমি বলি, খবর জানেন না?
বললেন, না তো।
আমি বলি, আপনি এত হাজার ভোটের ব্যবধানে জিতে গেছেন। কথাটা শুনে ওখানে দাঁড়িয়েই দুই হাত তুলে আল্লাহর দরবারে মোনাজাত করলেন তিনি। বললেন, ‘দেখি আমাদের সমাজের জন্য, সকলের জন্য কিছু করতে পারি কি না। চেষ্টা করব।’
তবে নির্বাচনের পর মন্ত্রিসভা করতে গিয়ে তিনি বিপাকে পড়লেন। প্রথমত, তিনি হিন্দুদের ছাড়া মন্ত্রিসভা করতে পারবেন না। দ্বিতীয়ত, তিনি কৃষক প্রজা পার্টির লোক হলেও পার্টিতে যাঁরা আছেন, তাঁদের নিয়ে কাজ করা সম্ভব ছিল না। শেষ পর্যন্ত তিনি বললেন, ‘দেখো, যদি দেশের কাজ করতে হয়, তাহলে শত্রুকে মিত্র বানাতে হবে। তা না হলে কাজ করতে পারবে না।’
আমি তো অবাক হয়ে গেলাম। বললাম, শত্রু কে? বললেন, নাজিমুদ্দিন। তারপর সঙ্গে সঙ্গে বলেন, তাঁকেও মন্ত্রিসভায় নিতে হবে। নাজিমুদ্দিন সাহেব যখন আমার সঙ্গে মন্ত্রিসভায় আসবেন, তখন দুনিয়া দেখবে আমি প্রধানমন্ত্রী আর নাজিমুদ্দিন আমার সঙ্গে কাজ করছেন। এতবড় একটা ব্যাপার। এ কথা বলার পরপরই তিনি আরও বললেন, ‘আরে, বন্ধু তো বন্ধু আছেই। শত্রুকে যে আপন করতে পারে, আসলে সে-ই বড়।’ এই সাংঘাতিক কথাটা তিনি আমাকে বলেছিলেন। শেষে দেখলাম, ঢাকার নবাব স্যার নাজিমুদ্দিন, মহারাজা মনীন্দ্রচন্দ্র নন্দী, নলিনীরঞ্জন সরকার, সৈয়দ নওশের আলী (এই একজনই কৃষক প্রজা পার্টি থেকে গেলেন), এঁদের নিয়ে তিনি তাঁর মন্ত্রিসভা গঠন করলেন। এবং আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে, হক সাহেব মন্ত্রীদের যাঁকে যা বলতেন, তাঁদের সবাই তা-ই করতেন। কোনো প্রতিবাদ করতেন না। তাঁরা তাঁকে খুবই মানতেন। এই যে তিনি বিরোধী দলের লোক নিয়ে তাঁর মন্ত্রিসভা গঠন করলেন, তাঁদের কেউই কোনো দিন তাঁর বিরোধিতা করেননি। এ দেশে এক অর্থে রাজনীতি করা কোনো লোকের পক্ষেই সম্ভব নয়, যেখানে নীতির কোনো বালাই নেই, যেখানে আমাদের নেতারা সকালে একদিকে তো বিকালে আর একদিকে যান। এসবই খুব খারাপ ব্যাপার। অসুবিধা হয়। তা সত্ত্বেও তিনি জীবনভর এভাবেই চালিয়ে গেছেন। এভাবেই চলেছেন। এমনটা তাঁর পক্ষেই সম্ভব ছিল। আর কারও পক্ষে সম্ভব হতো না। বিশেষ করে, মানুষটা যা-কিছু করতেন, করতেন আন্তরিকতার সঙ্গেই। দরিদ্র মানুষের জন্য ছিল তাঁর অপরিসীম দরদ। আর মুসলমান সমাজের জন্য এমন কাজ নেই, যা তিনি করতে পিছপা হতেন।
একদিন তাকে বললাম, কলকাতার উপকণ্ঠে এক জায়গায় মুসলমান আর হিন্দু গোয়ালাদের মধ্যে ঝগড়া লেগেছে। আপনি না গেলে মারামারি আরও ছড়িয়ে পড়বে।
শুনে বললেন, ‘চলেন এখনই যাই।’
আপনার জামাটা ছেঁড়া, যাওয়ার আগে জামাটা পাল্টে নিলে ভালো হয়।
আমার কথার জবাবে বললেন, জামা যায় না, ফজলুল হক যায়।
আমি আর কিছু বললাম না। সোজা ঘটনাস্থলে চলে এলাম। আসার পর গোয়ালারাও পায়ে পড়ে সালাম করে আর মুসলমানরাও এসে সালাম করে। দুপক্ষই সালাম করে। তখন বেশ মজা হলো।
উনি বললেন, ‘কী নিয়ে তোমাদের ঝগড়া? ব্যাপারটা তোমরা আমার ওপর ছেড়ে দাও। মানো তো?’
ওরা বলল, হ্যাঁ, মানি।
বললেন, ‘যাও, দুপক্ষই হ্যান্ডসেক করো।’
আমি বলি, তাতে কী হলো?
ফজলুল হক সাহেব বললেন, চলেন, বাড়িতে ‘চলেন। দুদিন পর ওদের মধ্যে আপনা-আপনিই মিল হয়ে যাবে।’
আফতাব আলী বলে সিলেটের একজন লোক ছিলেন। তিনি ছিলেন জাহাজের কর্মচারী ইউনিয়নের সেক্রেটারি জেনারেল। তিনি একদিন এসে ফজলুল হক সাহেবকে বললেন, ‘স্যার, আমার একটা মামলা আছে। যেতে হবে।’
বললেন, ‘তোমার কাজ, তখন তো যেতেই হবে।’
মামলা শেষে আফতাব আলী বললেন, ‘আপনাকে টাকা বেশি দিতে পারলাম না। সামান্য কিছু দিলাম।’ টাকা পাওয়ার পর তিনি সেগুলো কিসের ওপর যেন রেখেছিলেন। গোসল করে খাওয়াদাওয়া সারার পর দেখলেন যে, টাকাটা যেখানে রেখেছিলেন, সেখানে নেই। তখন তিনি বললেন, ‘কী আর করা যাবে! আফতাব, আমার রেলের টিকিটটা করে দাও।’
ফজলুল হক একবার মুন্সিগঞ্জ এসেছিলেন মামলা করতে। তিনি যেখানেই যেতেন, তাঁকে দেখার জন্য লোকজন খুবই ভিড় করত। তারাও বলতেন, স্যার, গরিব মানুষ। টাকা বেশি দিতে পারলাম না।
যে যৎসামান্য টাকা তিনি তাঁদের কাছ থেকে পেতেন, সেটা তাঁদেরকেই দিয়ে বলতেন, ‘তোমাদের টাকা তোমরাই নিয়ে নাও।’
এতসব ঘটনা আমার চোখের সামনেই ঘটেছে। তেঁতুলিয়ার একটা মামলার কথা এখানে বলি। তখন হিন্দুদের কোনো মেয়ে যদি কোনো মুসলমানের সঙ্গে বেরিয়ে যেত, তখন বলা হতো মুসলমানরা সব গুন্ডা। আমার মেয়েকে তারা জোর করে ধরে নিয়ে গেছে। তাকে জেলে দাও। তেঁতুলিয়ায় মহিউদ্দিন নামে হক সাহেবের বাড়ির একজন কাজের লোক ছিল। তার সঙ্গে বরিশালের এক উকিলের মেয়ে বেরিয়ে আসে। বেরিয়ে এলে দলের বিরুদ্ধে মামলা করা হলে দল ঘাবড়ে যায়। হক সাহেব বললেন, ‘ঘাবড়িয়ো না। এই কেসটা আমি লড়ব।’
আমাকে বললেন, ‘চলেন, হাইকোর্টে একটা মামলা দেখবেন।’
কোর্টে যাওয়ার পর দেখা গেল, মেয়ের মা-বাবা আর তার আত্মীয়স্বজনদের প্রায় সবাই সেখানে উপস্থিত। হক সাহেব মেয়েকে বললেন, ‘এই মেয়ে, তুমি সত্যি করে বলো তো, মহিউদ্দিন কি তোমাকে ফুসলিয়ে এনেছে? সত্যি কি না, বলো?’
মেয়ে বলল, না ফুসলিয়ে আনেনি।
তবে কী করে এসেছ?
মেয়েটা বলল, ‘আমি নিজের ইচ্ছায় বেরিয়ে এসেছি। আমি আর হিন্দু থাকব না।’
ওর কাছে এগিয়ে গেল ওর মা। মাকে বলল, ‘এই তুমি আমাকে ছুঁয়ো না।’ দিল জোরসে এক ধমক। বাপ এগিয়ে গেলে বাপকেও বলল, ‘আমাকে ছুঁয়ো না। আমি মুসলমান হয়ে গেছি।’ তখন মামলায় মহিউদ্দিন খালাস পেয়ে গেল।
হক সাহেব বললেন, ‘নারী অপহরণের যত মামলা, তার নাইন্টি নাইন পারসেন্ট মামলার রায় হয় মুসলমানদের পক্ষে। হিন্দুসমাজের আচারব্যবহার এত খারাপ যে, তা বলার নয়। বিধবা হলে তার বিয়ে হয় না। হয়তো ১৮ বছরের মেয়ে বিধবা হয়েছে। বিয়ে হয় না। এরাই এদিক-ওদিক চলে যায়। আর যত দোষ চাপে আমাদের মুসলমান সমাজের ঘাড়ে। কাগজে বের হয় যে, মুসলমানরা অসভ্য, মুসলমানরা এটা করছে, সেটা করছে। আপনারাই কাগজে এসব ছাপেন। সে জন্যই আমি আপনাকে এখানে ডেকে এনেছি।’
দেখেন, কী রকম দূরদর্শী ছিলেন হক সাহেব। তারপর আমরা মহিউদ্দিনের ঘটনাটা সাপ্তাহিক বেগম-এ ছেপে দিই। উনি দেখে বলেছিলেন, ‘সাব্বাশ!’
নির্বাচনের পর ভোলানাথ টাকা না পেয়ে আমার নামে কোর্টে নালিশ করে দিলেন। আমি সমনটা নিয়ে হক সাহেবের ওখানে গিয়ে বলি, দেখুন, কী সর্বনাশা ব্যাপার!
শুনে বললেন, ‘মন্ত্রী হলাম মাত্র কয়দিন হলো। সমনটা পেয়ে আপনারা ঘাবড়াচ্ছেন কেন? আমার নামে তো কোর্ট থেকে ডজন ডজন নোটিশ আসে। আমি তো একদিনও ঘাবড়াইনি।’
আমি বলি, এখন বলেন আমাকে কী করতে হবে?
বললেন, ‘আপনাকে নোটিশ দিয়েছে তো, আপনি চুপ করে থাকেন। আবার নোটিশ পাবেন। তারপর ছয় মাস পর তারিখ পড়বে। আমি এই সময়ের মধ্যে কিছু রোজগার করতে পারব। আপনি এক কাজ করেন, সমনটা আমার জুনিয়রের কাছে রেখে দেন। সে এটার জবাব দিয়ে দেবে। ভোলানাথ দত্ত পাঁচ বছরেও টাকা পাবে না। আর যদি আপনি দিতে চান তো আমি মাইনেটা পেয়ে নিই টাকাটা দিয়ে দেব।’
এরপর অবশ্য টাকাটা তিনি দিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁর এত বেশি বিপদ হয়েছিল যে, উনি সামাল দিতে পারতেন না। সেটা হলো এই, প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর উনি যা মাইনে পেতেন, তার দশগুণ বেশি তাঁর আত্মীয়স্বজন এসে বলত, এর মেয়ের বিয়ে হয় না, এই সেই নানা কথা। সবাই বাড়িতে ভিড় করতেন আর অনেকে তাঁর বাড়িতে থেকে খাওয়াদাওয়াও করতেন।
আমাদের এলাকায় একটা লোক ছিল। নাম রায় বাহাদুর সুখলাল কার্নানি। খুব বড় ধনী লোক।
হক সাহেব ও সোহরাওয়ার্দী সাহেব যখন রাজনীতি করতেন, তখন কার্নানির কাছ থেকে টাকা আনতেন আর ওদের একটা কিছু টাইটেল দিতেন। তাঁরা আর কিছু চাইতেন না, চাইতেন কেবল সম্মান।
হক সাহেবের মাথা তোলার উপায় ছিল না। দেনায় দেনায় তিনি জর্জরিত। তাঁর এসব দেনা পরিশোধ করবে কে? সবে নির্বাচন করে এসেছেন, বরিশালে দেনা, কলকাতায় দেনা। তিনি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর ভাগ্যকুলের রাজারাও তাঁর ওপর চাপ সৃষ্টি করে তাঁকে দিয়ে দুই একটা কাজ করিয়ে নিতে চাইলেন। তাঁরা সোজা তাঁর কাছে হাজির হয়ে বললেন, টাকা দেন। আর হক সাহেব বললেন, ‘সবুর করেন।’
তারা বললেন, সবুর আর কত করব?
তখন নান্না মিয়া আমাকে বললেন, তারা সবুর করত কিন্তু তাদের উদ্দেশ্য তো ভিন্ন। আসলে উনি প্রধানমন্ত্রী বলে তাঁর ওপর চাপ সৃষ্টি করে তাঁকে দিয়ে তারা তাদের সব কাজ করিয়ে নিতে চায়।
একজন আমাকে বলেছিলেন, যাঁরা রাজনীতি করেন, তাঁরা বিপদে পড়লে রায় বাহাদুর সুখলাল কার্নানি তাঁদের নাকি ঋণমুক্ত করে থাকেন। তাঁকে বলে দেখেন তো হক সাহেবকে ঋণমুক্ত করা যায় কি না? তাঁর কথামতো আমি গেলাম সুখলাল কার্নানির কাছে। যাওয়ার পর তিনি বললেন, ‘আপনি কে?’
বললাম, সওগাত নামে আমার একটা কাগজ আছে। প্রেস আছে। আর হক সাহেব আমার খুব বন্ধু মানুষ।
শুনে তিনি বললেন, ‘ফজলুল হক সাহেবের কাছে তো আমি কয়েক হাজার টাকা পাব। সেই টাকা তিনি আর দেননি। হাইকোর্টে নালিশ হয়েছিল, ডিক্রি হয়ে পড়ে আছে। আমি আর কিছু করিনি।’
বললাম, কার্নানি সাহেব, একটা মুশকিল আছে।
বললেন, কী?
বলি, হক সাহেব যদি প্রধানমন্ত্রী থাকেন, হিন্দুদের অনেক উন্নতি হবে। আর নাজিমুদ্দিন যদি প্রধানমন্ত্রী হন, হিন্দুদের শেষ করে ফেলবেন। কারণ, উনি সাম্প্রদায়িক, আর হক সাহেব সাম্প্রদায়িক নন। ব্যাপারটা চিন্তা করে দেখেন। আপনার তো টাকার অভাব নাই। আমি প্রস্তাব দিচ্ছি ওনাকে ঋণমুক্ত করা হলে উনি নিশ্চিন্ত মনে আপনাদের সমাজের জন্য কাজ করতে পারবেন।
বললেন, ‘বলেন কত টাকা?’
বললাম, কত আর হবে, সব সুদ্ধ এক লাখ হতে পারে।
বললেন, ‘এক লাখ টাকা এ আর এমন কি! কিছুই না।’ বলেই একটু ভেবে বললেন, ‘আমি কাল সকালে আপনার বাড়ি যাব। কোথায় থাকেন আপনি?’ আমি বলি, হক সাহেবের পাশের বাড়িতে। বললেন, ‘আমি একটু ভেবেচিন্তে নিই। কাল সকালে আপনাদের ওখানে যাব।’
অনুলিখন : রীতা ভৌমিক।