মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর, ২০২৪  |   ১৯ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   ফরিদগঞ্জ পাকহানাদার মুক্ত দিবস পালন
  •   যৌথ অভিযানে কচুয়া থানার লুণ্ঠিত পিস্তলের ৮ রাউন্ড গুলি উদ্ধার
  •   দৈনিক ইনকিলাবের প্রশাসনিক কর্মকর্তা শহীদুল্লাহ্ মিজির দাফন সম্পন্ন
  •   শনিবার চাঁদপুরে ৪ শতাধিক নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে ম্যারাথন প্রতিযোগিতা

প্রকাশ : ২১ জুলাই ২০২২, ০০:০০

কল্পনা দত্ত আমাদের জ্বলন্ত প্রদীপ
অনলাইন ডেস্ক

নারীরাও যে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পারেন, তা কল্পনা করা যেতো না। অথচ নারীদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় চট্টগ্রামের যুব বিদ্রোহ ব্রিটিশদের ভিতকেই কাঁপিয়ে দিয়েছিলো। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার দখলের নেতা বীর শহীদ সূর্য সেন, পূর্ণেন্দু দস্তিদারের নামের সঙ্গে যে দুজন নারীর নাম অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছে তাদের একজন কল্পনা দত্ত। কল্পনা দত্ত অন্যান্য সাধারণ বাঙালি নারীদের থেকে ছিলেন একটু আলাদা। বেশ খানিকটা লম্বা, ছিপছিপে গড়ন, সুন্দর, ঋজুদেহ, বলিষ্ঠ, কাঁচা হলুদ গায়ের রঙের সাথে ছিলো ভীষণ মিষ্টি এক হাসি। তেমনি ছিলেন বিপ্লবী। তাকে মাস্টারদার প্রিয় পাত্রী, রবীন্দ্রনাথের ‘অগ্নিকন্যা’ এবং চট্টগ্রামের সকলে ‘ভুলুদা’ নামে চিনলেও ভারতীয় উপমহাদেশের ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের ব্যক্তিত্ব ও বিপ্লবী নেত্রী হিসেবেই সবাই চিনতেন, জানতেন। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অকুতোভয় যোদ্ধা এবং চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের অন্যতম সদস্য ছিলেন তিনি।

১৯১৩ সালের ২৭ জুলাই বাংলার (বর্তমানে বাংলাদেশ) চট্টগ্রাম জেলার বোয়ালখালী উপজেলার শ্রীপুর গ্রামের এক সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন বিপ্লবী নেত্রী কল্পনা দত্ত। পিতার নাম বিনোদবিহারী দত্ত ও মা শোভনা বালা দত্ত। গ্রামের বাড়ি বোয়ালখালী হলেও তার শৈশব ও ছাত্রজীবন কাটে চট্টগ্রাম শহরে। তার দাদু ছিলেন শহরের নামকরা ডাক্তার রায় বাহাদুর দুর্গাদাস দত্ত- পূর্নেন্দু দস্তিদার। দুর্গাদাস দত্ত ছিলেন চট্টগ্রামের একজন স্বনামধন্য ব্যক্তি। ইংরেজ প্রশাসনও তাকে যথেষ্ট সম্মান দিতেন। ফলে তাদের বাড়িটা সবসময় পুলিশের নজরের বাইরে ছিলো।

শৈশব থেকেই কল্পনা দত্ত ছিলেন অন্য সব মেয়েদের থেকে আলাদা। মানসিক দিক থেকেও ছিলেন ব্যতিক্রমী, অত্যন্ত ভাবপ্রবণ এবং স্পর্শকাতর। দুঃখী মানুষের দুঃখের কাহিনি তাকে ব্যথিত করতো। তাই শৈশব থেকেই সকলকে নিয়ে এক সুখী সমাজের স্বপ্ন দেখতেন। কল্পনা দত্ত পড়তেন ডাঃ খাস্তগীর স্কুলে, স্কুলের শিক্ষিকা উষাদি ছাত্রীদের সাথে নানা বিষয়ে গল্প করতেন। তাদেরকে তিনি দেশ-বিদেশের স্বাধীনতার গল্পও শোনাতেন। তিনিই তার ছাত্রীদের সাথে সূর্য সেন ও অম্বিকা চক্রবর্তীর মামলার কথা নিয়ে আলোচনা করেন। কল্পনা দত্ত মন দিয়ে সেসব শুনতেন, আর এভাবেই তার আগ্রহ তৈরি হয় স্বদেশ সেবার, স্বাধিকারের ও সংগ্রামের জন্যে। বারো বছর বয়স থেকেই স্বদেশ ভাবনা তার মননে জাগ্রত হতে থাকে। তিনি নানা স্বদেশী বই পড়তে আগ্রহী হন। ক্ষুদিরাম ও কানাইলাল দত্ত-এর বিপ্লবী কর্মকাণ্ড স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগদানে তাঁকে আগ্রহী করে তোলে এবং তিনি ছাত্রী সংঘ-এ যোগদান করেন।

‘বিপ্লবীদের জীবনী’, ‘পথের দাবী’ এই ধরনের স্বদেশী বই পড়তে পড়তে তার মনে হতে লাগলো ব্রিটিশ সরকারকে সরাতে পারলেই দেশে স্বাধীনতা আসবে, দেশের দুঃখ দূর হবে। তার ছোট কাকা তাকে আদর্শ দেশ-সেবিকারূপে গড়ে ওঠার জন্যে সর্বদা অনুপ্রেরণা দিতেন। ধীরে ধীরেই দুঃসাহসিক কাজের জড়িত হওয়ার প্রতি তার আগ্রহ জাগে। পড়াশোনায় বেশ মেধাবী ও বুদ্ধিদীপ্ত ছিলেন কল্পনা দত্ত। চট্টগ্রাম থেকে ১৯২৯ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন, সেসময় মেয়েদের মধ্যে চতুর্থ হন। ম্যাট্রিকুলেশন পাস করার পর কল্পনা দত্ত কলকাতা আসেন এবং বেথুন কলেজ-এ বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন। বেথুন কলেজে পড়তে পড়তে তিনি নানা ধরনের বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে জরিয়ে পরেন। শহীদ ক্ষুদিরাম এবং বিপ্লবী কানাই লাল দত্তের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি বেথুন কলেজ-এ গড়ে ওঠা ছাত্রী সংঘ-এ যোগদান করেন। কলকাতা থাকার সময় তিনি দেশীয় পদ্ধতিতে বিস্ফোরক তৈরির বিষয়ে আগ্রহী হয়ে উঠেন। পরে দলের জন্যে ডিনামাইটসহ অন্যান্য বিস্ফোরক তৈরিতে কৃতিত্ব দেখান। এই সময় বিপ্লবী নেতৃবৃন্দের বিচার ও সাজা রুখতে তিনি কোর্ট এবং জেলে ডিনামাইট দ্বারা বিষ্ফোরণের পরিকল্পনা করেন, যাতে বিপ্লবী নেতৃবৃন্দ পালাতে সক্ষম হন।

১৯৩০ সালের ১৮ থেকে ২১ এপ্রিল এই চারদিন চট্টগ্রামে ইংরেজ শাসন কার্যত অচল ছিলো। পরাধীন জাতির ইতিহাসে বিপ্লবীদের এ বিজয় ছিলো গৌরবগাঁথা। ১৮ এপ্রিল চট্টগ্রামের অস্ত্রাগার দখল এবং ২২ এপ্রিল জালালাবাদ পাহাড়ের যুদ্ধের ঘটনায় তিনি এতোটাই অনুপ্রাণিত হন যে ছুটিতে চট্টগ্রাম এসে আর কলকাতায় ফেরে নি। তখনও মাস্টারদার সঙ্গে তার সরাসরি যোগাযোগ বা কথা হয়নি। বিপ্লবী হিসেবে নিজেকে প্রস্তুত করতে চেয়ে স্কলারশিপের টাকায় সাইকেল কিনে ভোরবেলায় কারও ঘুম ভাঙার আগেই বেথুন কলেজের কম্পাউন্ডের মধ্যে সাইকেল চালানো শুরু করেন। প্রতি রবিবার ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে গিয়ে নৌকা চালানোর অভ্যাস করতেন। ১৯৩১ সালের মে মাসে সূর্যসেনের সাথে সাক্ষাৎ করেন। পুর্নেন্দু দস্তিদারের মাধ্যমেই তিনি মাস্টার দা সূর্য সেনের সাথে পরিচিত হন। মাস্টার দা তখন প্রতিষ্ঠিত ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি, চট্টগ্রাম শাখায় যোগদান করেন। তখন চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের নেতৃবৃন্দ গণেশ ঘোষ, অনন্ত সিং, লোকনাথ বল প্রমুখ বিচারাধীন বন্দী। সেই সময় নারীদের বিপ্লবী দলে প্রবেশের ক্ষেত্রে কিছু প্রতিবন্ধকতা ছিলো। কিন্তু মাস্টার দা এই সমস্ত নিয়ম নীতি শিথিল করে কল্পনা দত্ত ও প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারকে তাঁর দলে গ্রহণ করেন। সেই সময়ে অনেকবারই রাত্রে পালিয়ে গ্রামে চলে যেতেন এবং সূর্য সেন, নির্মল সেনের সঙ্গে দেখা করতেন। এই সময় তিনি প্রায়ই মাস্টার দার সাথে তার গ্রামে ঘুরে গ্রামের মানুষের সুখ দুঃখের খবর নিতেন, বন্দুক চালানো শিখেন।

১৯৩১ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে এক বিশেষ আদালতে রাজদ্রোহ মামলায় অভিযুক্ত ৩২ জন বন্দির বিচার আরম্ভ হয়। সূর্যসেন মাইন ব্যবহার করে জেলের প্রাচীর উড়িয়ে দিয়ে বন্দীদের মুক্ত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। একই সাথে তিনি আদালত ভবন ধ্বংস করারও উদ্যোগ নেন। এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন কল্পনা দত্ত। হামলার দিন ধার্য করা হয়েছিলো ৩ জুন। শেষ মুহূর্তে সর্বশেষ মাইনটি বসানোর সময় পুলিশের নজরে পড়ে যাওয়ায় গোটা পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়ে যায়। পরিকল্পনা ফাঁস হয়ে যাওয়ার ফলে তাঁর গতিবিধির ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়। ১৯৩১ সালে সূর্য সেন কল্পনা দত্ত ও প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারকে চট্টগ্রামের ইউরোপীয় ক্লাব আক্রমণের দায়িত্ব দেন। নির্দিষ্ট দিনের এক সপ্তাহ আগে পুরূষের ছদ্মবেশে একটি সমীক্ষা করতে গিয়ে কল্পনা দত্ত ধরা পরেন ও গ্রেফতার হন। জেলে বসে তিনি অপারেশন পাহারতলী এবং প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের আত্মহত্যার খবর শোনেন।

১৩৩২ খ্রিস্টাব্দের ১৩ জুন পটিয়ার ধলঘাটে সাবিত্রী দেবীর বাড়িতে গোপন বৈঠকের জন্যে সূর্যসেন, নির্মল সেন, প্রীতিলতা ও অপূর্ব সেন মিলিত হন। সেখানে হঠাৎ গুর্খা সৈন্য নিয়ে হানা দেয় ক্যাপ্টেন ক্যামেরন। এই যুদ্ধে ক্যাপ্টেন ক্যামেরন নিহত হয়। বিপ্লবীদের পক্ষে শহিদ হয়েছিলেন নির্মল সেন। পরে পালিয়ে যাওয়ার সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে শহিদ হন অপূর্ব সেন (ভোলা)। এই সময় সূর্যসেন, বিশেষভাবে কল্পনা দত্ত এবং প্রীতিলতাকে আত্মগোপনের নির্দেশ দেন। কিন্তু ধরা পড়ে জেলে যান। দুই মাস জেলে থাকার পর প্রমাণের অভাবে তিনি জামিনে মুক্ত হন। পুলিশ তার বিরুদ্ধে ১০৯ ধারায় অর্থাৎ ‘ভবঘুরে’ বলে মামলা দায়ের করে। এ সময় চট্টগ্রামকে মিলিটারি এরিয়া বলে ঘোষণা করা হয়। প্রতি গ্রামেই গড়ে তোলে মিলিটারি ক্যাম্প। জামিনে মুক্তি পেয়ে মাস্টার দার নির্দেশে তিনি কিছু দিন আত্মগোপন করে থাকেন। ১৯৩৩ সালের (১৬/১৭) ফেব্রুয়ারি পুলিশ তাদের গোপন ডেরা ঘিরে ফেলে। কল্পনা এবং মনিন্দ্র দত্ত পালাতে সক্ষম হলেও মাস্টার দা বন্দী হন। কিছুদিন পর কল্পনা এবং তাঁর কিছু সহযোদ্ধা পুলিশের হাতে ধরা পরেন। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনমামলায় মাস্টার দা ও তারকেশ্বর দস্তিদারকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। কল্পনা দত্ত যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন।

১৯৩৭ সালে প্রদেশে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠিত হলো। বিনা বিচারে রাজবন্দীদের ছেড়ে দেয়া, রাজনৈতিক বন্দীদের আন্দামান থেকে নিয়ে আসা এবং তাদের মুক্তি দেয়ার জন্যে বাইরে জনসাধারণের তুমুল আন্দোলন হলো। বন্দীদের আন্দামান থেকে ফিরিয়ে আনা শুরু হলো ১৯৩৭-এর নভেম্বর মাসে। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ অগ্নিকন্যা কল্পনার মুক্তির আবেদন জানিয়ে গভর্নরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। গান্ধীজী, রবীন্দ্র বন্ধু সি এফ এন্ডরুজও কল্পনাকে জেল থেকে বের করার জন্য আন্তরিক উদ্যোগ নিয়েছিলেন।

১৯৩৮-এর প্রথম দিকে কল্পনার বাবা জেলে এলেন মেয়ের সঙ্গে দেখা করতে, জানলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ অগ্নিকন্যা কল্পনার মুক্তির আবেদন জানিয়ে গভর্নরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। কল্পনা দত্তের বাবাকে লেখা রবীন্দ্রনাথের একটা ছোট্ট চিঠি দেখালেন, ‘তোমার কন্যার জন্যে যা আমার সাধ্য তা করেছি, তার শেষ ফল জানাবার সময় এখনো হয়নি, আশাকরি, চেষ্টা ব্যর্থ হবে না।’ রবীন্দ্র বন্ধু সি এফ এন্ডরুজও কল্পনাকে জেল থেকে বের করার জন্যে অপরিসীম পরিশ্রম ও আন্তরিক উদ্যোগ নিয়েছিলেন। গভর্নরের কাছে গিয়েছিলেন এবং কল্পনার বাবাকে অনুরোধ করেছিলেন ‘কল্পনা যেদিন মুক্তি পাবে সেদিন যেন তাঁকে টেলিগ্রাম করা হয়।’

১৯৩৯ সালের ১ মে ছাত্র আন্দোলনের চাপে সরকার কল্পনাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হন। কারাবাস থেকে মুক্ত হবার সাতদিন পরেই কল্পনা চলে আসেন চট্টগ্রামে। শুরু হয় তার অন্য জীবন। সে সময়ে নিষিদ্ধ থাকা কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদান করে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকেন। দলের মহিলা ও কৃষক সংগঠনকে চাঙ্গা করেন। সাঁওতাল পাড়ায় গিয়ে কুলিদের পড়াতেন, মালিপাড়া, ধোপাপাড়ায় গিয়ে গোপন সভা করতেন। সাম্যবাদই প্রকৃত দেশপ্রেম এবং সেই দেশপ্রেম মানে জনগণের মনে আত্মবিশ্বাস গড়ে তোলার কাজে আত্মনিবেদন করেন। ১৯৪০ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। তারপর তিনি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদান করে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন চালিয়ে যান। ইতোমধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গেলো। কল্পনাকে কলকাতা থেকে বহিষ্কার করে চট্টগ্রামে পাঠানো হলো। ১৯৪১ সালে চট্টগ্রামে জাপানী আক্রমণের আশঙ্কায় জাপানবিরোধী প্রচারকাজে অংশগ্রহণ করেন কল্পনা দত্ত।

১৯৪৩ সালে এদেশে ঘটে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। সারা বাংলায় ৫০ লক্ষ ও চট্টগ্রামে ২ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়। কল্পনার নেতৃত্বে মহিলা সমিতি নিরন্ন ক্ষুধাতুর মানুষদের সেবায় এগিয়ে আসে। ত্রাণের কাজে তিনি ঘুরে বেড়াতেন চট্টগ্রামের সর্বত্র। কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় দফতর তখন বোম্বেতে। কল্পনা দত্ত পার্টির কেন্দ্রে যান এবং নারী আন্দোলনে নিজেকে যুক্ত করেন। ওই সময়ে সিপিআই-এর সাধারণ সম্পাদক তরুণ কমিউনিস্ট নেতা পি সি জোশীর সঙ্গে তার পরিচয় ও প্রণয়। ১৯৪৩ সালের ১৪ আগস্ট তিনি পি সি জোশীর সঙ্গে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হয়ে কল্পনা দত্ত হলেন কল্পনা জোশী। বরপক্ষের হয়ে সই করেন বি টি রণদিভে আর কন্যাপক্ষের হয়ে মুজফফর আহমেদ। বিয়ের সময় শ্বশুর বাড়ির পাঠানো লাল রেশমি শাড়ি পরেননি কল্পনা। পরে সকলে মিলে সেই শাড়ি কেটে কেটে পার্টি ফ্ল্যাগ তৈরি করেছিলেন। এরপর তিনি চট্টগ্রামে ফিরে যান এবং দলের নারী ও কৃষক সংগঠনকে চাঙ্গা করেন। ১৯৪৬ সালে বঙ্গীয় প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে চট্টগ্রাম নারী আসনে কল্পনা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন কমিউনিস্ট পার্টির প্রার্থী হয়ে, কংগ্রেস প্রার্থী দেশপ্রিয় যতীন্দ্রমোহনের স্ত্রী নেলী সেনগুপ্তার বিরুদ্ধে। খেটে খাওয়া গরিব নিম্নবর্গের মানুষদের ভোটাধিকার সে সময় ছিলো না। নির্বাচনে কল্পনা জয়লাভ করতে পারেনি।

কল্পনা দত্ত রুশ ও চীনা ভাষায় দক্ষ ছিলেন। দিল্লিতে অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব রাশিয়ান ল্যাঙ্গুয়েজ-এর সম্পাদক ও শিক্ষিকা হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। সক্রিয় ছিলেন পঞ্চাশের দশকে স্থাপিত ইন্দো-সোভিয়েত কালচারাল সোসাইটি ও ন্যাশনাল ফেডারেশন অব ইন্ডিয়ান উইমেন-এর কার্যকলাপে। রাজনীতিতে দূরে থাকলেও জীবনাচরণে ও বিশ্বাসে আজীবন তিনি থেকে গিয়েছেন কমিউনিস্ট। ১৯৪৭ সালে ভারতীয় উপমহাদেশ বিভাজন। তখন কল্পনা দত্তের কর্মক্ষেত্র ভারতবর্ষে। ১৯৪৮ সালে সিপিআই দলের দ্বিতীয় কংগ্রেসে ‘ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়’ বলে উগ্র লাইন গ্রহণ করা হয়। পি সি জোশী পার্টির নেতৃত্ব থেকে অপসারিত হন এবং শোষণবাদী বলে সাজা প্রাপ্ত হন। একদিকে পুলিশের হুলিয়া, অপরদিকে পার্টিতে একঘরে। এই দুর্বিষহ অবস্থার শিকার শুধু জোশী নন, এই অবস্থার শিকার কল্পনা জোশীও। কলকাতায় গোপন ভাড়াবাড়িতে বন্ধুদের সাহায্যে কোনো রকমে তারা দিন যাপন করতেন।

ইংরেজি ও বাংলা ভাষায় সমান দক্ষতা ছিলো কল্পনার। চল্লিশের দশকে কমিউনিস্ট পার্টির তৎকালীন মুখপত্র ‘পিপলস্ ওয়ার’ পত্রিকায় নিয়মিতভাবে প্রকাশিত তৎকালীন সামাজিক বিষয়ের ওপর তার লেখাগুলো গবেষকদের কাছে মূল্যবান দলিল হয়ে আছে। ‘চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার আক্রমণকারীদের স্মৃতিকথা’ কলকাতা থেকে প্রকাশিত তার লেখা গ্রন্থটি এক ঐতিহাসিক দলিল। ১৯৯০ সালে ‘চট্টগ্রাম অভ্যুত্থান’ নামে ভারত সরকারের উদ্যোগে আর একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তিনি ছিলেন বাংলাদেশের সমব্যথী। দেশ ভাগের পর ১৯৭৩ ও ১৯৭৫ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের আমন্ত্রণে দু’বার বাংলাদেশে এসেছিলেন কল্পনা। ১৯৯১ সালে চট্টগ্রামে যুব আন্দোলনের ইতিহাস লিখতে শুরু করেছিলেন, শেষ করতে পারেননি। তার জীবনের স্মৃতিকথার তিন হাজার পৃষ্ঠার পা-ুলিপি হারিয়ে ফেলেছিলেন সামান্য এক ভুলের কারণে। সেই মনোবেদনা নিয়ে ১৯৯৫-র ৮ ফেব্রুয়ারি ৮২ বছর বয়সে কল্পনা দত্ত নয়া দিল্লীতে মৃত্যুবরণ করেন।

সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের ইতিহাসে কল্পনা দত্ত একটি চিরস্মরণীয় নাম। স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে অসীম সাহস ও বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে চির জাগরুক হয়ে আছেন থাকবেন এক অকুতোভয় নারী যোদ্ধা- কল্পনা দত্ত। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন নিয়ে বলিউডে ‘খেলে হাম জি জান সে’ শীর্ষক একটি চলচ্চিত্র মুক্তি পেয়েছে, যার অন্যতম প্রধান চরিত্রটি ছিলো কল্পনা দত্তের। এই ছবিতে তাঁর চরিত্রে অভিনয় করেছেন বিখ্যাত বলিউড অভিনেত্রী দীপিকা পাডুকোন। জাতির মুক্তি ও জাতীয়তাবাদের আন্দোলনে নারীদের ভূমিকা ছিল অসামান্য। সেই ব্রিটিশ আমল থেকেই প্রতিটি সংগ্রামে নারীরা ছিলেন সম্মুখযোদ্ধা।

রহিমা আক্তার মৌ : সাহিত্যিক কলামিস্ট ও প্রাবন্ধিক।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়