প্রকাশ : ০৯ মে ২০২৩, ০০:০০
ক্যান্সার সব বয়সে হতে পারে, তবে বয়স বাড়ার সাথে সাথে ক্যান্সার হবার ঝুঁকি বাড়ে। আবার পুরুষের চাইতে নারীর ঝুঁকি বেশি। পৃথিবীতে মানুষের মৃত্যুর দ্বিতীয় বৃহত্তম কারণ হলো ক্যান্সার। সারা পৃথিবীতে প্রতি বছর প্রায় এক কোটি লোক ক্যান্সারে মারা যায়। চিকিৎসায় শিশুর ক্যান্সার নিরাময় প্রায় শতভাগ, যদি প্রাথমিক স্তরে রোগ নির্ণয় করা যায়। বাংলাদেশ শিশুর ক্যান্সার চিকিৎসায় অনেক দূর এগিয়ে গেছে। প্রবীণদের যদি প্রাথমিক স্তরে ক্যান্সার শনাক্ত করা সম্ভব হয়, তবে আরোগ্য লাভের সম্ভাবনা অনেক বেশি। ক্যান্সারের প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়কে প্রাথমিক স্তর হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তৃতীয় পর্যায় হলো লোকালি এডভ্যান্স স্টেজ। চতুর্থ পর্যায় হলো এডভ্যান্স স্টেজ। প্রাথমিক পর্যায়ে এই রোগ শরীরের যে অঙ্গে সৃষ্টি হয়েছে সেখানেই সীমাবদ্ধ থাকে। অপারেশন, রেডিয়েশন এবং ওষুধ সেবনের মাধ্যমে আরোগ্য লাভ করা সম্ভব হয়। তৃতীয় ও চতুর্থ স্টেজে রোগীর শরীরে বিভিন্ন স্থানে ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়ে। এই অবস্থায় রোগীকে সুস্থ করা যায়, কিন্তু ক্যান্সার পুরোপুরি নির্মূল করা যায় না। শুধুমাত্র আয়ু বাড়ানো যায়। চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা প্রায় ৮৪ রকমে ক্যান্সারের সন্ধান পেয়েছেন। আমরা স্তন, জরায়ু, প্রোস্টেট, লিভার, কোলন, ফুসফুস, রক্ত, কিডনী, থাইরয়েড ও মুখের ক্যান্সারের কথা বেশি শুনতে পাই।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে, বর্তমান বিশ্বে ক্যান্সার যে ভাবে থাবা প্রসারিত করেছে তাতে ২০৩০ সাল নাগাদ প্রতি ১০ জনে ১ জনের ক্যান্সার আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা রয়েছে।
ক্যান্সারের কারণ
বার্ধক্য, স্থূলতা, ঝুঁকিপূর্ণ যৌন সম্পর্ক, মানব প্যাপিলোমা ভাইরাস, ধূমপান, অ্যালকোহল যুক্ত পানীয় গ্রহণ, বায়ু দূষণ, রেডিয়েশন, ভাজা-পোড়া ও আগুনে ঝলসানো খাবার গ্রহণ, বংশের কারো ক্যান্সার থাকলে।
ক্যান্সারের লক্ষণগুলো হলো : পায়খানায় রক্ত যাওয়া, ওজন কমে যাওয়া, বমি ভাব বা প্রচণ্ড বমি, দীর্ঘস্থায়ী কাশি, অবসাদ, শরীর টালমাটাল, অসহনীয় মাথা ব্যথা, দীর্ঘদিন ধরে খাবারে অরুচি, ত্বকের পরিবর্তন, ঘন ঘন জ্বর, মলমূত্র ত্যাগের অভ্যাসের পরিবর্তন, শরীরের কোনো স্থানে চাকা থাকা।
উপরের লক্ষণগুলো কারো মধ্যে দেখা গেলে চিকিৎসকের পরামর্শ/মতামত গ্রহণ করতে হবে। বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে চিকিৎসক নিশ্চিত হন ক্যান্সার হয়েছে কিনা। মেমোগ্রাম ও কলোনোস্কপি করে ক্যান্সার সম্ভাবনা যাচাই করা যায়।
সুস্থ জীবন চর্চা এবং নিয়মিত পরীক্ষা নিরীক্ষা ক্যান্সার প্রতিরোধে বড় ধরনের ভূমিকা পালন করতে পারে। ক্যান্সার প্রতিরোধে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো বিবেচনায় নেয়া যেতে পারে। পর্যাপ্ত পরিমাণে ফলমূল, শাকসবজি ও স্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ। খাবারে কম লবণ এবং ভাজা পোড়া, ঝলসানো খাবার পরিহার করতে হবে। শরীরের কাঙ্ক্ষিত ওজন বজায় রাখা। নিরাপদ যৌন সম্পর্কে আবদ্ধ থাকা। ধূমপান না করা এবং ধূমপানের স্থান পরিহার করা। সপ্তাহের অধিকাংশ দিন কমপক্ষে ত্রিশ মিনিট হালকা বা মাঝারি ব্যায়াম করা, অ্যালকোহল জাতীয় পানীয় পান থেকে বিরত থাকা কিংবা চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করা। জীবনকে কর্মচঞ্চল করে তুলতে হবে। দৈনিক পাঁচ ঘণ্টার অধিক সময় ধরে স্মার্টফোন ব্যবহার করলে ওজন বেড়ে যেতে পারে। কর্মস্থলে ক্যান্সার সৃষ্টিকারী উপাদানের বিষয়ে স্বাস্থ্য নিরাপত্তার নির্দেশনা অনুসরণ করা।
সবধরনের সতর্কতা অবলম্বন করার পরও ক্যান্সারে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা থাকে। ক্যান্সার ব্যক্তির যেমন শারীরিক বিপর্যয় ঘটায়, তেমনি একই সাথে মানসিক, আর্থিক, সামাজিক বিপর্যয় ঘটায়।
আমাদের দেশের প্রবীণদের অধিকাংশই গরিব। তাদের জন্যে ক্যান্সার চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করা সম্ভব হয় না। সরকারি বিভিন্ন হাসপাতালে গরীব রোগীদের বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা দেবার ব্যবস্থা রয়েছে। চিকিৎসা সেবা ব্যবস্থা পর্যাপ্ত না থাকায় গরীব রোগীদের দীর্ঘ সময় ধরে অপেক্ষা করতে হয়। পরীক্ষা নিরীক্ষার যন্ত্রপাতি সরঞ্জাম অচল থাকলে কিংবা না থাকলে ং রোগীর খরচ এবং বিড়ম্বনা বাড়ে।
প্রবীণ বয়সে মানুষের শরীরে নানা ধরনের রোগের বসবাস শুরু হয়। শরীরের কর্মক্ষমতা কমে যায়। অনেকেই একাকী বসবাস করেন। সেবা-যত্ন করার মতো কাউকে পাওয়া যায় না।
সামর্থ্যবান প্রবীণরা সেবা কিনতে পারলেও গরীব প্রবীণরা কিনতে পারে না। যক্ষ্মার চিকিৎসার মতো ক্যান্সার চিকিৎসা সম্পূর্ণ বিনামূল্যে হলে দালাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার, হাসপাতালের যন্ত্রণা লাঘব হতো। ক্যান্সার রোগীদের চিকিৎসায় সহায় সম্বল বিক্রি করে পরিবার নিঃস্ব হয়ে যায়, আবার রোগীকেও বাঁচাতে পারে না।
প্রবীণ যখন বুঝতে পারেন তার আরোগ্য লাভের সম্ভাবনা কম বা নেই, তখন তার মধ্যে নানা ধরনের শারীরিক ও মানসিক অস্থিরতা তৈরি হতে পারে।পরিবার পরিজন, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় ভোগে। রোগীর যন্ত্রণা লাঘবে প্যালিয়েটিভ কেয়ার বা মৃত্যু যন্ত্রণা প্রশমন কেন্দ্রে নিয়ে যেতে হয়। গরিব রোগীদের বিনামূল্যে প্যালিয়েটিভ কেয়ার পাবার সুযোগ রাখা জরুরি। ব্যক্তিগত বা সামাজিক উদ্যোগে প্যালিয়েটিভ কেয়ার স্থাপন করা গেলে মৃত্যুপথযাত্রী প্রবীণদের কষ্ট অনেকখানি লাঘব হবে।
স্থানীয় পর্যায়ে সামর্থ্যবান মানুষদের উদ্যোগে ক্যান্সার চিকিৎসা তহবিল গঠন করা গেলে চিকিৎসারত অসহায় প্রবীণদের আর্থিক সহায়তা দেয়া সম্ভব হতো। আমাদের দেশে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রাখা প্রবীণরা ক্যান্সার আক্রান্ত হলে তাদের চিকিৎসায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে অনেকেই এগিয়ে আসেন। যে সব প্রবীণ যৌবনে কৃষিতে, কলে কারখানায়, সেবা খাতে, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে অবদান রেখেছেন তাদের চিকিৎসায় তেমন কেউ এগিয়ে আসতে দেখা যায় না। ক্যান্সারের যন্ত্রণার কষ্ট ধনী গরিব সবার জন্যে একই রকম। রোগ নিরাময়, রোগ প্রতিরোধ, যন্ত্রণা উপশম, পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াজনিত কষ্ট লাঘবে কার্যকর ব্যবস্থাগ্রহণ জরুরি।