প্রকাশ : ২০ মার্চ ২০২৩, ০০:০০
যক্ষ্মা বা টিবি একসময় মারাত্মক জীবনঘাতী রোগ ছিলো। যে আক্রান্ত হতো তাকে আর বাঁচানো যেতো না। তাই যক্ষ্মাকে বলা হতো রাজরোগ। আজকাল যক্ষ্মার বিরুদ্ধে গড়ে উঠেছে বিশ্বব্যাপী সচেতনতা। যক্ষ্মা আজকাল আর আগের মতো আতঙ্কিত হওয়ার প্রয়োজন নেই। এখন আর কেউ বলে না, যক্ষ্মা হলে রক্ষা নাই। বরং এখন বলা হয়, যক্ষ্মা হলে রক্ষা নাই এ কথার আজ ভিত্তি নাই। মহান বিজ্ঞানী রবার্ট কচ মাইক্রোস্কোপের নিচে যক্ষ্মার জীবাণু শনাক্ত করার পর থেকে যক্ষ্মা বিষয়ে গবেষণার ক্ষেত্র অবারিত হয়েছে এবং যক্ষ্মা নিরোধে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হয়েছে।
বিশ্ব যক্ষ্মা দিবস
১৮৮২ সালের ২৪ মার্চ তারিখে বিজ্ঞানী রবার্ট কচ যক্ষ্মার জন্যে দায়ী ব্যাকটেরিয়া মাইকোব্যাকটেরিয়াম টিউবারকুলোসিস আবিষ্কার করেছিলেন। তাই প্রতি বছর ২৪ মার্চ তারিখকে বিশ্ব যক্ষা দিবস হিসেবে পৃথিবীজুড়ে পালন করা হয়ে থাকে। যক্ষ্মা নিরোধে অঙ্গীকার পূরণের এখনই সময়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অঙ্গীকার, মস্কো সম্মেলনের অঙ্গীকার পূরণের জন্যে সময় কিন্তু বসে নেই। ঘড়ি টিক টিক করে এগিয়ে যাচ্ছে আর আমরা আজও যক্ষ্মাকে পৃথিবী হতে নির্মূল করতে পারিনি।
যক্ষ্মার বিশ্ব পরিস্থিতি
বিগত দুহাজার সাল হতে সারা বিশ্বে চিকিৎসার মাধ্যমে এ অব্দি প্রায় তেষট্টি মিলিয়ন যক্ষ্মা রোগীকে সুস্থ করে তোলা সম্ভব হয়েছে। সারাবিশ্বে বর্তমানে চল্লিশ মিলিয়ন লোক যক্ষ্মাক্রান্ত আছে যার মধ্যে সাড়ে তিন মিলিয়ন আক্রান্ত হলো শিশু এবং প্রায় দেড় মিলিয়ন রোগী মাল্টি ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট হয়ে ভুগছে।
বাংলাদেশে যক্ষ্মা
বাংলাদেশে যক্ষ্মা নির্মূল কার্যক্রমের সাথে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, দেশে প্রতিদিন প্রায় ৯৭৮ জন যক্ষ্মায় আক্রান্ত হচ্ছেন এবং এর মধ্যে ১৬ জন ঔষধ-প্রতিরোধী যক্ষ্মায় আক্রান্ত। আর আক্রান্তদের মধ্যে দৈনিক মারা যাচ্ছে ১২৯ জন। এ চিত্র আমাদের জন্যে ভয়াবহ। অথচ যক্ষ্মা রোগের চিকিৎসা বিনামূল্যে করার জন্যে সকল কার্যক্রম বহাল আছে। মূলত মানুষের অসচেতনতাই বাংলাদেশের এ ভয়াবহ পরিস্থিতির জন্যে দায়ী। ইদানীং করোনার আক্রমণে মাস্ক ব্যবহারের কারণে যক্ষ্মার বিস্তারণ কমে এসেছে।
যক্ষ্মার লক্ষণ
দুই সপ্তাহের বেশি একটানা কাশি থাকলেই তাকে যক্ষ্মার লক্ষণ বলে চিহ্নিত করা হয়। দুপুরের পর হতে গায়ে গায়ে জ্বর, রাতে ঘামে বিছানা ভিজে যাওয়া, ওজন কমে যাওয়া, খেতে অরুচি হওয়া, কাশিতে রক্ত যাওয়া, শ্বাসকষ্ট তৈরি হওয়া, গলায় ছোট ছোট মটরের দানার মতো গঠনের উপস্থিতি তৈরি হওয়া এসবই যক্ষ্মার লক্ষণ। যক্ষ্মাক্রান্ত ব্যক্তির জিভে ছত্রাকের সংক্রমণ দেখা দেয়। শারীরিক দুর্বলতা তৈরি হয় এবং বুকে-পেটে পানি আসতে পারে।
যক্ষ্মার পরীক্ষা
রোগ নিরূপণে পর পর তিন দিন সকালে প্রথম কফের নমুনায় যক্ষ্মার জীবাণুর উপস্থিতি পরীক্ষা করা হয়। দুই নমুনাতে জীবাণু পাওয়া গেলে তাকে যক্ষা বলে শনাক্ত করা হয়। সাথে বুকের এক্স-রে, রক্তের কমপ্লিট ব্লাড কাউন্ট পরীক্ষা করা হয়। এক্স-রেতে সাদা সাদা ছোপ ছোপ দেখা গেলে, রক্তের ইএসআর আশি বা তার বেশি হলে যক্ষ্মা হয়েছে বলে ধরা হয়। এছাড়া যারা তরুণ তাদের বাম হাতের সামনের অংশে গড়হঃড়ীঁ (মন্টু টেস্ট)-এর মাধ্যমে যক্ষ্মা নিশ্চিত করা হয়।
যক্ষ্মার চিকিৎসা
যক্ষ্মা রোগীর চিকিৎসায় ইদানীং ফিক্সড ডোজ কম্বিনেশনের মাধ্যমে ঔষধ প্রয়োগ করা হয়। দুমাসের পর্যায়কে বলে ইনিশিয়াল ফেজ যাতে রিফামপিসিন, আইসোনিয়াজিদ, পাইরাজিনামাইড এবং ইথামবিউটল ঔষধ সেবন করানো হয়। পরের চার মাস (ক্ষেত্রবিশেষে সাত মাস, দশমাস) রিফামপিসিন ও আইসোনিয়াজিদের কম্বিনেশন প্রয়োগ করা হয়। একে বলে কনটিনিউয়েশন ফেজ।
যক্ষ্মার চিকিৎসায় পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া
যক্ষ্মা রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত ঔষধসমূহের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে। এতে জন্ডিস দেখা দিতে পারে, গিঁটে গিঁটে ব্যথা হতে পারে। চোখের দৃষ্টিতেও সমস্যা হতে পারে। চিকিৎসকের শরণ নিলে তা সমাধান হয়ে যায়। আজকাল যক্ষ্মার ঔষধ সেবনের জন্যে সরাসরি তদারকির ব্যবস্থা করা হয়েছে যাতে এক ডোজ ঔষধও গ্যাপ না হয়। ভিটামিন বি-৬ বা পাইরিডক্সিন সেবন করলে যক্ষ্মার ঔষধ সেবনজনিত গিঁটে ব্যথা সেরে যায়।
প্রতিষেধক
যক্ষ্মা হতে আজীবন রক্ষার জন্যে জন্মের পর পর চামড়ার নিচে বিসিজি টিকা দেয়া যায়। একটামাত্র ডোজে শক্তিশালী ইমিউনিটি তৈরি হয়।
যক্ষ্মার ঝুঁকিপূর্ণ উপাদান
ধূমপান, ড্রাগ আসক্তি, এইডস্ আক্রান্ত হওয়া ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ যক্ষ্মা সংক্রমণের জন্যে সহজ। যক্ষ্মা হতে দূরে থাকতে হলে মাস্ক ব্যবহার, যত্রতত্র কফ-কাশি না ফেলা আমাদের সবার পবিত্র দায়িত্ব। কারো দু সপ্তাহর বেশি কাশি হলে তাকে যক্ষ্মা পরীক্ষার জন্যে পাঠিয়ে দিন।