প্রকাশ : ২৮ নভেম্বর ২০২২, ০০:০০
ঋতু পরিবর্তনের ধারাবাহিকতায় বর্ষপঞ্জিতে হেমন্ত এলেও এ সময়ে হিমের পরশে শরীরে যে অনুভূতি তৈরি হয় তাতে বেজে ওঠে শীতের আগমনী গান। শীত মানে পিঠাণ্ডপার্বণ যেমন তেমনি শীত মানে শরীরের জন্যে প্রকৃতিকে মানিয়ে নেয়ার নিরন্তর সংগ্রামও বটে। সৌরতপ্ত প্রকৃতি যখন হঠাৎ করেই উত্তরী হাওয়ায় নিজে কেঁপে কেঁপে ওঠে তখন বাঙালির দেহজুড়ে শুরু হয় আত্মরক্ষার যুদ্ধ। এ যুদ্ধে শরীরকে রসদ যোগানোর দায়িত্ব যদি ঠিকমতো পালন করা না যায় তবে জীবনে নেমে আসে বিপর্যয়। শীত যেমন দুই প্রান্তিক বয়সের জনগোষ্ঠীর ওপর আক্রমণ হানে, তেমনি তরুণ-যুবারাও এ আক্রমণের পরিণামের বাইরে নয়।
শীতের প্রথম আক্রমণ আসে সংবেদনশীল উন্মুক্ত ত্বকের ওপর। ত্বকের আর্দ্রতা শুকিয়ে গিয়ে ফাটল বা ক্র্যাক সৃষ্টি হয়। সেই ফাটল ঠোঁট থেকে শুরু করে পায়ের পাতা পর্যন্ত সর্বত্র বিস্তৃত হয়। কখনও কখনও ফাটলের তীব্রতায় কমবেশি রক্তপাতও ঘটে থাকে। তাই হিমশীতের সূচনালগ্ন হতেই ঠোঁট-মুখ, ত্বক ও পায়ের পাতায় পেট্রোলিয়াম জেলি, অলিভ অয়েল, অয়েল বেইজ্ড লোশন প্রয়োগের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। নারকেল তেল মাখলেও ত্বক ফেটে যাওয়া রোধ করা যায়। পাশাপাশি ভিটামিন বি-কমপ্লেক্স ক্যাপসুল সেবন করে ত্বকের নিরবচ্ছিন্ন স্বাস্থ্য বজায় রাখা যায়। বয়ষ্ক এবং মধ্য বয়ষ্কদের বিশেষ করে পায়ে ইকথায়োসিস নামে ত্বকের শুষ্কতাজনিত ক্ষয়ক্ষতি সাধিত হয়। শীতের শুরু থেকে যত্ন নিলে ইকথায়োসিস ( মাছের শুকনো আঁইশের মতো ত্বক) হতে রেহাই পাওয়া যায়।
শিশু ও বৃদ্ধরা শীতে নিউমোনিয়ায় ভোগে। তাই উপযুক্ত উষ্ণ পোশাকের আবরণে প্রবীণ ও শিশুদের রাখতে হয়। কডলিভার অয়েল, ভিটামিন সি-জাতীয় সিরাপ সেবনে শিশুরা ঠাণ্ডা থেকে দূরে থাকতে পারে। প্রবীণদের ক্যালসিয়াম পর্যাপ্ত পরিমাণে গ্রহণ করতে হয় যাতে শীতে অস্থি ও অস্থিসন্ধিগুলো সচল থাকে এবং হাতে-পায়ে ঠাণ্ডার প্রকোপ কম অনুভূত হয়। ক্রণিক অ্যাজমা রোগীরা গরমণ্ডঠাণ্ডার সংযোগলগ্নে শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত হতে পারেন। এ সময় তাদের অ্যাজমা-অ্যাটাক তীব্রতা ধারণ করে। তাই এ অবস্থাকে আগাম রুখতে হলে নিয়মিত অ্যান্টি অ্যালার্জিক ড্রাগ বা বা অ্যান্টি হিস্টামিন এবং মন্টিলুকাস্ট জাতীয় ঔষধ সেবন করা বাধ্যতামূলক। সাথে ভিটামিন ই-ক্যাপসুল ও ভিটামিন এ সেবন করা উচিত। শীতে ঘরের দরজা-জানালা অধিকাংশ সময় বন্ধ রাখা হয় বলে আবদ্ধ কক্ষে বিভিন্ন ডাস্ট-মাইট-পোলেন জাতীয় অ্যালার্জেন ঘোরাফেরা করে যা পরবর্তীতে তীব্র শ্বাসকষ্ট ঘটায়। তাই কেবল সন্ধ্যা বেলা ব্যতিরেকে অন্য সময়ে ঘরের দরজা-জানালা খুলে রেখে রোদণ্ডহাওয়া খেলতে দেয়া উচিত।
শিশুরা শীতে কোল্ড ডায়রিয়া এবং ফাংগাসের সংক্রমণজনিত ডায়রিয়াতে আক্রান্ত হয়। তাই শিশুদের খাদ্য প্রস্তুতির উপকরণাদি ভালোভাবে ধোয়া দরকার। পায়খানার বর্ণ সবুজাভ হতে পারে। শিশুকে বার বার পরিষ্কার করতে গিয়ে ঠাণ্ডা লেগে যেতে পারে। সেদিকেও নজর দেয়া জরুরি। নারীরা যারা কোমড়-হাঁটুর ব্যথায় ভুগতেন শীতে তাদের সে ব্যথা তীব্রতা ধারণ করে। এক্ষেত্রে ব্যথা নিরসনে প্যারাসিটামল ( এক্সটেন্ডেড রিলিজ) জাতীয় ঔষধ সেবন করাটাই যুক্তিযুক্ত।
শীতে হার্ট অ্যাটাকের প্রবণতা বেশি। কেননা, ঠাণ্ডা আবহাওয়ায় দেহের উষ্ণতা বজায় রাখতে গেলে তাতে হৃদপি-ের নিজের পক্ষে অক্সিজেন সংকটে ভুগতে হয়। পাশাপাশি এ সময় মুখরোচক খাবারের আধিক্যের কারণে হৃদপি-ের ওপর খাদ্য হজমের চাপ তৈরি হয়। এ চাপ সামাল দিতে গিয়ে হার্ট নিজেই বেসামাল হয়ে পড়ে এবং হার্ট অ্যাটাক হয়। কাজেই শীতকালে খাবার পরিমাণ মতো খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে অনুরোধে ঢেঁকি গিলে অতিরিক্ত খাবার গলাধঃকরণ কোনো দরকার নেই।
শীতে দেহের প্রতিরক্ষায় দুর্বলতা তৈরি হয়। সেই দুর্বলতাকে জয় করতে হলে নিয়মিত শরীরচর্চা ও সুষম পুষ্টিযুক্ত খাবার খেতে হবে। দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা পর পর অল্প অল্প করে খাবার খাওয়াটাই স্বাস্থ্যের পক্ষে উত্তম। আতঙ্কের নয়, শীত হোক উপভোগ্য এবং নিরাপদ। শীতের মোকাবেলায় আগাম প্রস্তুতিই উপযুক্ত পরিচর্যা হয়ে উঠুক।
* চিকিৎসাঙ্গন বিভাগের লেখা পাঠানোর ই-মেইল : [email protected]