প্রকাশ : ২০ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
ভালোবাসায় বিভাজ্য
তেইশ মিনিট ধরে তমালের জন্য অপেক্ষা করছি। মাথার ঠিক ওপরে সূর্য এক শ আশি ডিগ্রি কোণে নিজেকে মেলে ধরেছে। কড়া রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা যাচ্ছে না। ঈদের দিনে বেশির ভাগ মানুষ এখন আয়েশে সময় কাটাচ্ছে, অনেকের চোখ টেলিভিশনের পর্দায় নিবদ্ধ। আর আমি কিনা রাস্তায় দাঁড়িয়ে সূর্যের অবস্থান মাপছি! হেঁটে গেলে তমালদের বাড়িতে পৌঁছাতে দশ মিনিটের বেশি লাগে না। অন্য কোনো দিন হলে এত ভাবনাচিন্তা করতাম না। সোজা ওদের বাড়ি গিয়ে নাম ধরে হাঁক ছাড়তাম। ওর বাবা আমাকে যথেষ্ট স্নেহ করেন। মা মারা যাওয়ায় সংসারের বেশির ভাগ কাজের তদারক করতে হয় ছোট বোন তন্বীকে। তন্বী তমালের বছর দুয়েকের ছোট। আমার বোন মিলির সঙ্গে একই কলেজে পড়ে। কলেজে যাওয়া ছাড়া বাড়ির বাইরে বের হয় না তেমন। ব্যতিক্রম কেবল তমালের বড় ভাই। তিনি স্থানীয় কলেজের গণিতের শিক্ষক। কিছুটা রাশভারী স্বভাবের। নিতান্ত প্রয়োজন না হলে বাক্য ব্যয় করেন না। তবে শিক্ষক হিসেবে এলাকায় তাঁর বেশ নামডাক। সূর্য ওঠার আগে থেকে টিউশনি শুরু করেন। কলেজে যাওয়ার আগ পর্যন্ত একনাগাড়ে কয়েক ব্যাচ পড়ান। আমি যতটা সম্ভব নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করি, পাছে না গণিতের কোনো সূত্র জিজ্ঞেস করে বিপদে ফেলেন! আজ অবশ্য অন্য কারণে ওদের বাসায় যাওয়া যাবে না। আমাদের বিশেষ পরিকল্পনা আছে। দিনের বাকি সময়টুকু তমালের সঙ্গে মোটরসাইকেলে ঘুরব। চার-পাঁচজন বন্ধুর বাসায়ও যেতে হবে। কিন্তু সমস্যা একটাই। মোটরবাইকের মালিক তমালের ভাই। তার চোখ ফাঁকি দিয়ে চাবি নিয়ে বের হতে যথেষ্ট ঝক্কি পোহাতে হয়।
মুঠোফোনে কয়েকবার চেষ্টা করেও তমালকে পাওয়া গেল না। ‘আর কতক্ষণ অপেক্ষা করব?’ জানতে চেয়ে দুবার এসএমএসও করেছি। তারও জবাব নেই। মোটরসাইকেলের ব্যবস্থা না হোক, ফোন ধরতে অসুবিধা কী? তমালের পরামর্শ উপেক্ষা করে ওদের বাড়িতে গিয়ে উঠব কি না ভাবছি, এমন সময় মুঠোফোনে বার্তা : ‘বন্ধু, একটা কাজে আটকে গেছি। তুই বরং বাড়িতে চলে যা। সুযোগ বুঝে আমি তোদের বাড়িতে আসব।’
ঈদের দিনে কোথায় একটু আড্ডা দেব, আনন্দ-ফুর্তি করব, তা না; বাসায় গিয়ে মরার মতো শুয়ে থাকতে হবে। তমালের ওপর ভরসা করাটাই ভুল হয়েছে। বেঁকে যাওয়া মেজাজকে যতটা সম্ভব নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করে বাড়ি ফিরি। ঘরে ঢুকেই চমকে উঠি। তন্বী বসে পুরোনো ম্যাগাজিন পড়ছে। হালকা গোলাপি রঙের পোশাকে ওকে দারুণ মানিয়েছে। নিয়মিত ওদের বাড়ি গেলেও দেখা হয় কম, কথা হয় তার চেয়েও কম। বড়জোর পড়ালেখার খোঁজখবর নেওয়া পর্যন্ত। এ বাড়িতেও ও তেমন আসে না। প্রয়োজনে মিলিই ওদের বাড়ি যায়। তন্বীকে পেয়ে ভালোই হলো। তমালের খোঁজ নেওয়া যাবে।
-তুমি এখানে কখন এসেছ? তমাল কোথায় জানো?
-ভাইয়াকে বাবা একটা জরুরি কাজে পাঠিয়েছে। আসতে দেরি হবে। তাড়াহুড়া করতে গিয়ে মুঠোফোনটাও ফেলে গেছে।
-তাহলে একটু আগে ও যে আমাকে এসএমএস পাঠাল!
-আপনি কীভাবে নেবেন জানি না, তবে না বলেও পারছি না। ভাইয়া নয়, আমিই ওই মুঠোফোন থেকে মেসেজটা পাঠিয়েছিলাম।
-তার মানে?
-আপনাকে বাড়ি আসতে বলেছিলাম, যেন আমাদের দেখাটা হয়। সারা দিন বলতে গেলে আমি বাড়িতেই থাকি। আপনি ভাইয়ার কাছে গেলেও আমাদের বিশেষ কথা হয় না। কিন্তু যতবার আপনি ও বাড়িতে যান, একবারের জন্য হলেও আপনাকে দেখি। কেন দেখি তা জানি না। ভালো লাগার নির্দিষ্ট কারণ থাকতেই হবে, তা তো নয়। কথাগুলো বলার সুযোগ হচ্ছিল না বলে অস্বস্তিতে ছিলাম। আমার মনের কথা তো জানলেন। মিলিকে আমি নিয়ে যাচ্ছি। সন্ধ্যায় ওকে দিতে আরেকবার আসব। আপনি অবশ্যই বাসায় থাকবেন। আমার চাওয়াতে ভুল থাকলে জানাবেন।
কথা শেষ করেই উঠে দাঁড়ায় তন্বী। ততক্ষণে আমি বিস্ময়ে বিমূঢ়। তন্বী আমাকে পছন্দ করে, সে কথাগুলো এমন অবলীলায় বলে গেল! ওকে আমি এত দিনেও চিনিনি কিংবা চেনার চেষ্টা করিনি। পড়তে পারিনি ওর মন। এটা কি আমার অক্ষমতা? ইচ্ছা করছে, এখনই ওকে ভালো লাগার কথা জানিয়ে দিই। তার কী দরকার! আসুক না সন্ধ্যায় আরেকবার।
মুঠোফোনের স্ক্রিনে তমালের নম্বর ভাসছে। ওর সঙ্গে বাইরে যাওয়ার প্রস্তাব ব্যস্ততার অজুহাতে এড়িয়ে যাই। আসলেই আমি চরম ব্যস্ত। তন্বীর কথার জবাব তৈরি করার চেয়ে এ মুহূর্তে জরুরি কাজ আর কিছু হতে পারে না। ঈদ এমন মধুর হয়! কী বলব তন্বীকে? তোমার কথা শোনার পর নিজেকে কোথায় যেন হারিয়ে ফেলেছি, বলতে পারো আমি তোমার ভালোবাসায় বিভাজ্য!