প্রকাশ : ১১ নভেম্বর ২০২৩, ০০:০০
কবিতার মাধ্যমে সমাজ পালটে দিতে চাই। চাই জগতের সব অন্ধকার, বৈষম্য, শোষণ দূরীভূত হোক। চাই পৃথিবীর লোকরা আমাকে কবি হিসেবে চিনুক। চাই পরিচিত জনেরা আমাকে নিয়ে গর্ব করুক। কবিতা আমাদের নিয়ে যায় সম্পূর্ণ আলাদা এক জগতে। কবিতা আকণ্ঠ নিমজ্জিত মিথ্যা অন্ধকারের ভিড়ে বিদ্যুৎ চমকের মতো এক ঝলকে সত্য উদ্ভাসন করে। কবির কাছে তার প্রতিটা কবিতাই স্নেহস্পদ সন্তান, রত্নগর্ভা ঝিনুক যেমন নিজের গোপন কোষে যত্নে পোষে রাখে মুক্তোদানা। আমি আমার মতো করে লিখতে চাই। ভাল কবিতা লিখার প্রতিক্ষায় থাকি, জলদাস যেমন জলে জাল ফেলে প্রতীক্ষায় থাকে কাঙ্ক্ষিত মাছের।
আমি বিশ্বাস করি, মানুষের জন্য লিখতে হলে মানুষ যেন পড়ামাত্রই বুঝতে পারে এমনটা লিখতে হবে। কোন একটা কবিতা পাঠকের কাছে পৌঁছানোর পূর্বে আমি কবিতাটাকে অন্তত ছয় মাস কাটাছেঁড়া করি। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে পড়ি। শব্দ, বাক্য, উপমা সংযোজন-বিয়োজন করি। গুগোলে, ইউটিউবে, ফেসবুকে নাম লিখে সার্চ দিয়ে যখন দেখি কবিতাগুলো নানারূপে নানাদিকে ছড়িয়ে পড়ছে, তখন তুমুল আনন্দিত হই। পাঠকের ভালো লাগাতেই আমার সার্থকতা।
ইটচাপা হলুদ ঘাসেরা
বাঁশবনে গুইসাপের হাঁ-করা মুখ দেখে অকস্মাৎ
যারা দেয় আপ্রাণ দৌড়
আমি তাদের শঙ্কাচ্ছন্নতায় মুচকি হাসি। সন্ধ্যার অশ্বত্থ শাখে
নাকি সুর শুনে জুতো খুলে ছুঁড়ে ছিলাম ঢিল
শাঁখচুন্নিদের- সেই সুবাদে খোয়া গেছে
বাঁ পায়ের একপাটি নাগড়া চটি। যাক, দুঃখ নেই তাতে।
একটা সময় ছিল-
গোরস্তানের মাঠে ঝুঁকে থাকা তাল গাছটায়
পারিনি চড়তে কিছুতেই
অথচ এখন তরতর উঠে যাই
দেবদারুর চূড়ায় তোয়াক্কা না করে বিষ পিঁপড়ের কামড়। সময়
মানুষকে করতে শেখায় সব।
আকাশে উড়ছে শকুন
বাতাস দ্বি-খণ্ডকর চিৎকারে। ওরা মৃত্যু ভালোবাসে
এবং চায় ভেজাতে চঞ্চু জীবন্তের রক্তে। আমাদের চৌদিকে
গাঢ় আগুনের আঁচ, বরফে মশাল
জ্বলছে ভীষণ দাউ দাউ।
আমার কণ্ঠে তাই বজ্রপাতের মতো
তুমুল হুংকার, হাতের পতাকা যেন জ্বলে ওঠা বাতিস্তম্ভ।
আমাদের মুমূর্ষু মানুষগুলো
জলে ডুবে যেতে যেতে হঠাৎ আঁকড়ে ধরে তৃণ উঠে বসবেই
একদিন, আর আমি বলে রাখি- ইট চাপা হলুদ ঘাসেরা
ইট ঠেলে নিশ্চিত মাথা তুলবেই আকাশে।
রঞ্জু, একটা হাতিয়ার
মিছিলটা হয়েছিলো প্রায় তিনশো গজ লম্বা। টানা পাঁচ দিন খেটেখোটে
লোক জড়ো করেছিলো। বিপক্ষ দলের সামনে ইজ্জত রাখা চাই।
গলিটা দখলে নিয়ে সাজালে প্যান্ডেল। ঝাঁঝালো ভাষণে
জনপদ কাঁপিয়ে সার্থক জনসভা।
নেতা তোমাকে কাছে ডেকে পরিপাটি চুলগুলো
আঙুলে উলোঝুলো করে দিয়ে বললো- ‘বেটা বাঘের বাচ্চা, তোর মতো
কেজো ছেলে আগে দেখিনি, একেবারে বিপ্লবী চে গুয়েভারা’।
তুমি বাহবা পেয়ে গলে গেলে রঞ্জু। বুঝলে না, ছোটদের বগলবন্দি রাখতে
বড়রা এমন প্রশংসার ফাঁদ প্রায়ই পাতেন।
পার্টি অফিসে প্রতিদিন কত কাজ, কত পরিকল্পনা। নেতারা তোমায়
পিতার মতোই স্নেহ করে। গোলটেবিল বৈঠকে
জ্বালাময়ী আলোচনায় রক্ত গরম।
বাধা এলে অস্ত্র নেবে, প্রয়োজনে প্রাণ দেবে। অফিসের গোপন ঘরে
নেতারা গলা ভেজাতে ভেজাতে তোমাদের হাতে বোতল দিয়ে বলে-
‘নে বাবারা, খা... শুধু খেয়াল রাখবি যেন হুঁশ ঠিক থাকে’।
ভেবে দেখেছো কি রঞ্জু, তাদের ছেলেরা এসব নোংরা জল
ছোঁবার কথা কল্পনাও করতে পারে না। মায়েরা পড়ার টেবিলে
গরম দুধে গ্লাস ভরে রাখে।
কালো কাচ আটা পাজারো গাড়ি থামল রাস্তাতে। জানালার কাচ খুলে
নেতা হাত বাড়িয়ে দিলেন হাজার টাকার দুটো নোট। বললেন-
‘রঞ্জু... ঝাঁপিয়ে পড় বাবা, মান-সম্মানের ব্যাপার’।
তুমি ঝাঁপিয়ে পড়লে পেট্রোল-বোমা আর ককটেল হাতে। দুদিন পর
তোমার ঠিকানা হলো সরকারি হাসপাতালের নোংরা বিছানা। হাত দুটো
উড়ে গেছে, দু পায়ের হাঁটু অবধি ব্যান্ডেজ।
একবারও ভাবলে না, তিনি তোমার কেমন বাবা!
তার সম্পত্তির ভাগ পাবে? তার কালো কাচের পাজারোটা
তোমাকে দেবে? দেবে মখমল বিছানো বেডরুমে ঘুমানোর অনুমতি?
তার সম্মান রাখবে তুমি! তার ছেলে বিদেশে পড়ে,
নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে; সে তো ঝাঁপিয়ে পড়ে না!
তোমার হুঁশ কবে হবে রঞ্জু! তুমি ছিলে তাদের
স্বার্থের হাতিয়ার, কাঁটা তোলার কাঁটা।
তোমার মা হাসপাতালে গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদে, বাপ কাঁদে বারান্দায়।
সেই নেতারা, তোমার পাতানো বাবারা, একবারও তো
দেখতে এলো না! বলি রঞ্জু, তোমাদের হুঁশ কবে হবে!
অনুকরণে অনুসরণে
রাতের নির্জনে তুমি করাত হাতে নামো রাস্তায়।
গোপনে অন্যের বাগানে চারাগাছ কেটে আসো।
সকালে দেখো, একি! তোমার বাগান
কেটে গেছে অন্য করাত চালক, গোপনে।
গলির মোড়ে ভাতিজা বয়সি ছেলেটা সিগারেট ফোকে।
দেখেও না দেখার ভান করো। অন্যের ছেলে
নষ্ট হচ্ছে, তোমার কী!
এদিকে তোমার মেয়েটা দশজন মুরব্বিকে সাক্ষী রেখেই
ছেলেদের সাথে ডলাডলিতে মাতে।
তারা কেন ফেরাবে! তোমার মেয়ে তো তাদের কেউ না...
অথচ, তুমি করাত চালানো ষড়যন্ত্র থামালে
কমে যাবে পৃথিবীর একজন গোপন বৃক্ষনিধক।
সিগারেটখোর ছেলেটাকে ফেরালে
অবক্ষয় থেকে বাঁচবে একটি সন্তান। আর ঠিক তখনই
অনুকরণে অনুসরণে বদলে যাবে সমস্ত পৃথিবী।
পুনরায় চাই
আমাদের মাথার উপর
ছায়া হয়েছিল যে মেঘ, উড়ে গেছে কোন দূরে।
আমাদের পায়ের নিচে ভিটা হয়ে ছিল যে মাটি,
ধসে গেছে নদী ভাঙ্গনের মতো।
বুক ভরে নিতে চাই প্রশ্বাস, অথচ বাতাসে
ফুলের সুবাস নেই, শুধু কপাল পোড়ার ঘ্রাণ।
আমাদের দু চোখ এখন আর কোন স্বপ্ন দেখে না, ডিমের ছড়ানো
কুসুমের মতো হলুদাভ হয়ে গেছে।
আমরা ভুলে গেছি সাবলীল হাসির ভাষা। তাই হাসতে গেলে
বেরিয়ে আসে ডাইনির দাত, প্রেতায়িত শব্দের প্রতিধ্বনি।
যখন কোন গান গাই, মনে হয় যেন নেড়ি কুত্তার ভাঙ্গা পায়ে
পুনরায় আঘাত দিয়েছে কেউ, বাজখাই কাঁদছে প্রাণান্ত ক্রন্দন।
তোমার কলম যেদিন থামিয়ে দিলে, সেদিন থেকে
আমাদের ঠোঁট সিক্ত হয় না কবিতার পংক্তি চুম্বনে।
যেদিন ছুড়ে ফেলে দিলে তোমার বাঁশি, সেদিন থেকে
বিষিয়ে উঠেছে কান, শুনতে পাই না কোন মধুর রাগিনী।
তোমার প্রতিবাদী মুষ্টিবদ্ধ হাত, অভিযোগের আকাশমুখী তর্জনী,
যখন নামিয়ে নিলে, তখন থেকে আমাদের হাতে শান্তির সাদা পায়রা
উড়িয়ে দিতেই পাথরের মতো নিস্তেজ হয়ে যায়।
তোমার অবর্তমানে এতই ভীতু আমরা, জাগতিক দাজ্জালের মুখের উপর
ছিটাতে পারি না থুতু, পায়ের আঘাত।
অজস্র অমানুষের মেলায় হাঁটতে গিয়ে যেন
ভুল পথে বাড়িয়েছি পা।
আমাদের নিয়ে যাও সঠিক গন্তব্যে, পিতা যেমন তার
উ™£ান্ত সন্তানেরে হাত ধরে স্কুলে পৌঁছায়।
তুমি ছাড়া কে আর শোনাতে পারে মক্তবী-মৌলভীর মতো
সাম্যের উপদেশ, শান্তির বাণী।
ওগো কবি, ওগো কাণ্ডারী, ওগো দেশের নেতা... জলে ডুবে যেতে যেতে
অসহায় চাইছি ত্রাণ, খড়কুটো আঁকড়ে ধরার মতো
তোমার পায়ের কড়ে-আঙুলটিতে একটু ধরতে দাও।
পথ চলতে চলতে হঠাৎ নিভে গেছে বাতি, ভীষণ এ অন্ধকারে
পুনরায় জ্বালাও তোমার বজ্র আলোর ঝলক।