প্রকাশ : ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০০:০০
(গত সংখ্যার পর)
তিন.
ডিসেম্বর মাস। শীতকাল। কনকনে ঠাণ্ডা। পিকনিক আর ভ্রমণের যাবার উপযুক্ত সময়। পি. আর. সাহেব চিন্তা করলেন কয়েক দিনের জন্যে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের দৃশ্য দেখা দরকার। এবার তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন স্বপরিবারে কক্সবাজার যাবেন।
এজন্যে ফোনের মাধ্যমে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের নিকটবর্তী হোটেল ভাড়া করলেন এক সপ্তাহের জন্যে। এ খবর শুনে পি. আর. সাহেবের পুরো পরিবার খুশিতে গদগদ। অপেক্ষা করছে কবে সেই কাঙ্ক্ষিত দিন আসবে।
পি. আর. সাহেব রানাকে খবর পাঠালেন কক্সবাজার যাওয়ার জন্যে গাড়ি প্রস্তুত করতে। রানা জানতে পারলো এবার পি. আর. সাহেবের পুরো পরিবার কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে একই গাড়িতে করে যাবে। আর তাকেই সেই গাড়ি চালাতে হবে।
আঘাত করার সীমা আছে। কষ্ট দেয়ারও সীমা আছে। অসহায়েরা নীরবে সবই সহ্য করে। কিন্তু থেকে যায় তাদের মনে আঘাতকারীদের উপর প্রচণ্ড ঘৃণা। সেই ঘৃণা থেকে জন্ম নিতে পারে তিক্ততার মহাপরিকল্পনা। শুধু সুযোগের অপেক্ষা। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে যা হয় সে রকমই কিছু একটা। অন্য কোনো উপায় না থাকলে অসহায়রাও একসময় তীব্র আঘাতের পরিকল্পনা করে। দুর্বলদের রোষানলে পড়ে গেলে যতই ক্ষমতাশালী হোক না কেন তাদের নিস্তার নেই। আর এই রোষানল জ্বলতে থাকে ঘৃণা থেকে। আক্রোশ তখন বেড়েই চলে। রানার মনের মধ্যে যেমন সেই আক্রোশ বেড়েই চলছে। এই আক্রোশ সুযোগ খুঁজছিলো দীর্ঘদিন থেকে।
একদিন রানা রাতের বেলায় বিছানায় ঘুমাতে ঘুমাতে চিন্তা করলো, এই সুযোগ কোনোভাবেই হাতছাড়া করা যাবে না। তীব্র আঘাত করবো। আত্মঘাতী আঘাত! এই আঘাত থেকে তার পরিবারের কেউ রক্ষা পাবে না। আমি আর বাঁচতে চাই না। এভাবে জীবনকে বাঁচিয়ে রেখে কোনো লাভ নেই। এই অমানুষের অনেক অত্যাচার সহ্য করেছি। আর সহ্য করবো না। আর কষ্ট দেবার সুযোগ দেবো না। সমস্ত প্রতিশোধ নেবো। আর সেই প্রতিশোধ হবে দৃষ্টান্তমূলক। এখন শুধু সেই দিনের অপেক্ষা। আরাম করে নে, যত পারিস। তোর আর বেশি দিন নেই। আত্মঘাতী! আত্মঘাতী!! আত্মঘাতী প্রতিশোধ।
খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে রানা স্নান করে নেয়। তারপর ফুরফুরে মেজাজে পি. আর. সাহেবের বাড়িতে গাড়ি নিয়ে ঢোকে। তার পরিবারের সকলে কক্সবাজার যাওয়ার জন্যে প্রস্তুত। বেশ সেজেগুজে রয়েছে সকলে। একে একে সকলে গাড়িতে বসলো। রানার পাশে পি. আর. সাহেব বসলেন।
রানা বললো, আমরা কি রওনা দিতে পারি?
পি. আর. সাহেব : হুম! খুব সাবধানে চালাও গাড়ি। দুপুর ১টার দিকে একটা ভালো হোটেলে থামিয়ে নিও। খাবার দাবার সেরে নেবো।
রানা মনে মনে চিন্তা করলো, সেই সুযোগ আর হবে না পি. আর. সাহেব। রানা গাড়ি রাস্তায় নামিয়ে খুবই সতর্কতার সাথে গাড়ি চালাতে লাগলো। রানা আগেই ঠিক করে রেখেছিলো কোথায় ঘটনা ঘটাবে। নিজের জীবন আজ নিজে শেষ করে দেবে। ক্ষোভের আগুনে জ্বলছে প্রতিটি মুহূর্ত। গাড়ি চলছে তো চলছে। একসময় ফাঁকা জায়গা দেখলো রানা। এখানে সামনে অথবা পেছনে কোনো লোকাল জায়গা বা কোনো বাজার নেই। গাড়িতে বসে থাকা প্রাণীগুলো বেশ মজা করছে। চারিদিকে তাকিয়ে প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করছে। রানা দেখলো, পি. আর. সাহেব একটু ঘুম ঘুম ভাবের মধ্যে রয়েছেন। পেছনে সকলে হৈচৈ করছে। রান মনে মনে বললো, ঘুমাও বাছাধন ঘুমাও। রানার উপর রানা দেখলো সাহেবের অত্যাচারের ঘটনাটিগুলো একে একে মনে পড়তে লাগলো। আর রানা ফুঁসতে লাগলো। গাড়ি গতিও বাড়াতে লাগলো তীব্র থেকে তীব্র গতিতে। রানা দেখতে পেলো তার গাড়ির গতি অস্বাভাবিক বেড়ে গেছে। আর বিপরীত দিক থেকেও গাড়িগুলো তীব্র গতিতে ছুটছে। একটি বড় লাল রঙের ট্রাক ঝড়ের গতিতে এগিয়ে আসছে। রানাও গাড়িটির গতি আরো বাড়িয়ে দিলো। রানা দেখলো সাহেবের স্ত্রী বুঝতে পারলেন গাড়ির গতি বেড়ে গেছে অস্বাভাবিক গতিতে। তিনি রানাকে এতো জোরে গাড়ি চালাতে নিষেধ করছেন। চিৎকার করে বলছেন যেনো গাড়ির গতি আরো কমানো হয়। কিন্তু না, রানা তার কথা শুনলো না। বরং জানিয়ে দিলো এটাই আপনাদের জন্যে শেষ গতি। আর রানা ডান দিকে হালকা মোড় নিয়ে লাল রঙের বড় ট্রাটের নিচে ঢুকিয়ে দিলো।
দূর থেকে মানুষজন বিকট আওয়াজ শুনতে পেয়ে ছুটে এলো। রানার গাড়ির অস্তিত্ব রইলো না। গাড়িটি টুকরো টুকরো হয়ে চারিদিকে পরে রইলো। গাড়িতে থাকা প্রত্যেকটি মানুষের দেহের টুকরো রাস্তার উপর, রাস্তার পাশে জমিতে পড়ে রইলো। কোন মাথা কোনদিকে ছুটে গেছে বোঝা যাচ্ছে না। লাশের টুকরোগুলো রাস্তায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে রয়েছে। পিছঢালা রাস্তায় লাল রক্তের বন্যা বইয়ে গেছে যেনো। কুকুরের দল মাংসের টুকরোগুলো কাড়াকাড়ি করে খেয়ে নিচ্ছে। আর কুকুরগুলোর মধ্যে তুমুল ঝগড়া আর মারামারি শুরু হয়ে গেলো। কয়েকজন লোক লাঠি হাতে ওদের তাড়া দৌড় দিলো। তার আগেই মানুষের মাংসের বেশ কিছু টুকরো ঘাপাঘাপ খেয়ে নিয়েছে।
‘আহা! সে কী করুণ দৃশ্য! আহা রে কীভাবে হলো দুর্ঘটনা। দু’দিনের দুনিয়াতে কতোদিন আর মানুষ বেঁচে থাকে। আজ আছি তো কাল নাও থাকতে পারি। নিঃশ্বাসের কী আর বিশ্বাস আছে। কে কখন মারা যাবো, আমরা সেটা বলতে পারি না।’-এভাবে অনেক কথা মানুষের মুখে মুখে। কেউ আবার চোখের জলও ফেলেছে। দুর্বলচিত্তের মানুষগুলো ধারে কাছেও আসেনি। এমন করুণ দৃশ্য তাদের সহ্য হবে না বলে তারা দূরে থেকেই সব খবর শুনেছে। সাংবাদিকরা ছুটাছুটি করছে সংবাদ সংগ্রহের জন্যে। পি.আর. সাহেবের কিছু পোষা সাংবাদিকও ছিলো। যারা তার পক্ষেই সাফাই গাইতো।
কিন্তু দুর্ভাগ্য! রানা সম্পূর্ণ জীবিত; তবে অজ্ঞান হয়ে ধানক্ষেতে চিৎ হয়ে পরে আছে। এদিকে ট্রাকটিও রাস্তার পাশের গাছের সাথে ধাক্কা লেগে কাত হয়ে রয়েছে। ড্রাইভার আহত হয়েছেন। ট্রাকে থাকা জিনিসপত্র রাস্তায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে।
একটি অ্যাম্বুলেন্স এসে রানা ও ট্রাক ড্রাইভারকে হাসপাতালে নিয়ে গেলো।
পি.আর. সাহেব একজন ধনাঢ্য ব্যক্তি ছিলেন। তাই সেখানে দুর্ঘটনার খবর খুব দ্রুতই ছড়িয়ে পড়লো। দুর্ঘটনাস্থলে মানুষে পরিপূর্ণ হলো। সকলেই হা-হুতাশ করতে লাগলো। পুলিশের লোকজন বাঁশি দিয়ে মানুষকে সরে যেতে বলতে লাগলেন।
দুর্ঘটনার কথা কারখানার কর্মচারীদের কানে যেতে বেশি সময় হলো না। ওরা শুনতে গেলো রানাকে হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়েছে। আর তাই দুর্ঘটনা স্থলে যাওয়ার আগে তারা সকলে রানাকে দেখার জন্যে হাসপাতালে রওনা দিলো।
হাসপাতালে জ্ঞান ফিরলে রানা বুঝতে পারলো বাম পা থেতলে যাওয়া ছাড়া তার আর কিছু হলো না। রানা তাকিয়ে দেখলো, তার চারিদিকে কারখানার বন্ধুরা দাঁড়িয়ে আছে।
একজন রানার গায়ে হাত রেখে বললো, কেমন আছিস রানা?
রানা তার দিকে তাকালো। এরপর সকলের তাকিয়ে রইলো বেশ কিছুক্ষণ।