প্রকাশ : ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০০:০০
আরজ আলী মাতবর বয়স নব্বই ছুঁই ছুঁই। বড় সংসারের একমাত্র অভিভাবক হিসেবে এখনো সব বিষয়ে খবরাখবর রাখে। পাঁচ ছেলে তিন মেয়ের সংসার। আগের মানুষ তো, পরিবার পরিকল্পনার বিষয়টি মাথায় আনতো না। তাছাড়া পৈত্রিকসূত্রে অনেক সম্পত্তির মালিক। তাই মাত্র তেরো বছর বয়সেই বিয়ে করে ফেলেন। ধর্মের প্রতিও বেশ অনুরাগ আছে। যৌবন বয়স থেকেই নামাজ রোজার ব্যাপারে খুবই যত্নবান। নিজে বেশি লেখাপড়া না করলেও আট ছেলে-মেয়েদের মধ্যে চারজনেই উচ্চশিক্ষিত এবং বাকি চার জন ও মোটামুটি শিক্ষিত। নিজে এখন তেমন কাজকর্ম করে না। তবে নাতিপুতিদের সাথে গল্প গুজব করে সময় কাটান। ওনার একটি দুঃখ আছে। মেজো ছেলে অল্প বয়সে মারা যান, সে ঘরের দুটি নাতি আছে। নাতি দুটি এখন বড়ো হয়েছে এবং বিশেষ করে ছোট নাতি সবুজ তার বেশ প্রিয়। বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া সবুজ দাদাকে বেশ সময় দেন, তাই তো যখনই ছুটি পান, ছুটে আসে বাড়িতে। তাছাড়া সবুজের গ্রামের নিরিবিলি প্রাকৃতিক পরিবেশ খুব পছন্দ। দাদা ইতিহাসের সাক্ষী। অনেক পুরাতন বাস্তব ঘটনার মুখোমুখি হয়েছেন, সেগুলো সে জানার চেষ্টা করে।
একদিন দাদাকে নিয়ে বাড়ির দক্ষিণ দিকের পুকুরের ঘাটে বসে গল্প করছে। সবুজ খুবই মেধাবী ও ভাবুক প্রকৃতির ছেলে। নিজের জীবনের মাঝে দাদা আরব আলী মাতবরকে কল্পনা করে, হারিয়ে যায় বহু অতীতে। ডানপাশে এ গ্রামের সবচেয়ে পুরোনো কবরস্থান।
ঘাটের এক সিঁড়ি নিচে বসে দাদার দিকে তাকিয়ে থাকে।
আসলে মানুষের জীবন পরিচালিত করে কে? গন্তব্যটা কোথায়? যাত্রাটা শুরু কোথায় আর শেষ বা কিসে? ধরিত্রীতে আমাদের অবস্থান কেমন। সব মিলিয়ে এলোমেলো চিন্তায় কিছুই ভালো লাগে না। ডানদিকে তাকিয়ে কবরস্থানে চোখ পড়তেই বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে, দাদা আমার পাশে কিন্তু বাবাতো নেই, বহু আগেই এখনকার বাসিন্দা হয়েছে।
সারি সারি কবরের দিকে তাকিয়ে কত ভাবনা আসে মনে। মানুষের শেষ পরিণতি নিয়ে কথাগুলো মাথায় গুরুপাক খায়। জীবনের হিসেব যে বড়ই বিচিত্র ধরনের। সব কিছু ছেড়ে একাই নিরিবিলি প্রাকৃতিক ঘেরা পরিবেশে পড়ে থাকতে হবে, যে গন্তব্যের যাত্রাপথ নির্ধারণ করা যায় না, অসীম আর অসীম।
তবুও মানুষের অনেক কিছু দরকার হয়, সব প্রয়োজনকে পুরা করতে গিয়ে মানুষ মিথ্যা বলে, প্রতারণার আশ্রয় নেয়, ঠকবাজি করে, ভাইয়ে ভাইয়ে শত্রুতা, নেতায় নেতায় কত তিক্ততা, কেউ কাউকে ছেড়ে কথা বলে না। যে-ই লোকগুলো এখানে নিশ্চল হয়ে চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন, তাদেরও এই ধরায় বিচরণ ছিল। কত কিছু করেছে। শিক্ষিত, অশিক্ষিত, ধনী গরিব, আস্তিক, নাস্তিক, সুন্দর, অসুন্দর, রাজা এবং প্রজা সব এক কাতারে শুয়ে আছেন। কত সময় অতিবাহিত করছি বা অতীতের মানুষগুলো করেছে এর ইয়ত্তা নেই।।
সবুজের ভাবনার রাজ্যে এক মহাবিস্ফোরণ ঘটেছে। বৃদ্ধ দাদার দিকে তাকিয়ে মনটা আরও বিষণ্ন হয়ে গেল, কারণ তিনিও তো আমার মতো যুবক ছিলেন, এ পথঘাট ধাবরিয়ে বেড়িয়েছে। আজ যে জীবনের সায়াহ্ন, ভাটির টান, আলো যে নিভু নিভু করছে, থপাস করে যেকোনো সময় নিভে যেতে পারে। তাহলে মানুষ কেন প্রতারণা জালিয়াতির আশ্রয় নেয়, সামান্য
স্বার্থের জন্য বন্ধুর হাতে বন্ধু খুন,অবাধে মিথ্যা বলে, খাদ্যের ভেজাল করে, চুরি ডাকাতি করে,আবার দান করে বাহবা নেয়, মনে হয় পুরো পৃথিবী বা সমাজ দেশ আজ বাজিকর দের হাতে চলে গেছে। কে শুনবে সাধারণ মানুষের মনের আকুলতা।
সবুজের ভাবনার রাজ্যে এ কথাগুলো ঘুরপাক খায়। সীমিত জীবনের জন্য এতো চাহিদা কেন? সুখের জন্য বেশি কিছু দরকার নেই, শুধু সততা নিষ্ঠা আর দেশপ্রেম। দাদার কাছে ব্রিটিশ, পাকিস্তানের শোষণের কাহিনি শুনছে। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশের অজানা কাহিনি গুলো নিজের চোখে অবলোকন করছে। কতো দিন খেলবে, সীমানা পেরিয়ে বেশি গন্তব্যে যাওয়ার সুযোগ যে রুদ্ধ। ডানদিকে কবরস্থানে আবারও চোখ গেল,নতুন একটি কবর, কিছুদিন আগে প্রয়াত এক ধনাঢ্য ব্যক্তি মারা যান, কত দাপট, চাকর, বাকর, গাড়ি, যখন গ্রামে আসতো পুরো এলাকা সাজসাজ রব পড়ে যেতো, ন্যায়-অন্যায়ের বালাই ছিল না। ইচ্ছে করলে ধরাকে সরা করে ফেলতেন। কেউ ভয়ে টুঁ শব্দ করতো না। আজ কোথায়? যে লোকটার পায়ে কখনো মাটি লাগতো না, আজ সে পড়ে আছে মাটির এক টুকরো অন্ধকার ঘরে, যে ট্রেনে কোন বিরতি নেই, নেই কোন যাত্রা পথ, কবে শেষ হবে এ অন্ধকারের যাত্রা পথ কেউ জানে না। বৃষ্টির পানিতে ভিজে আবার রোদে শুকায়। তাহলে কেন এতো অহংকার, দেমাগ, ভাব, এতো শ্রেণিবিন্যাস, এতো বিভাজন? কেন?
পশ্চিমের সূর্যটা আস্তে আস্তে লাল আভায় ডুবে যাচ্ছে। পুরো জাহানের আলো ধীরে ধীরে ম্রিয়মাণ হয়ে যাবে। জীবনের আলোটাই একদিন থপাস করে নিভে যাবে, সেদিন শেষ হবে সব কোলাহল। সেই গন্তব্যহীন যাত্রায় নেই কোনো সহযাত্রী।
* পুনশ্চ লেখাটি শৈশবের প্রয়াত বন্ধু মনিরের স্মৃতির উদ্দেশ্যে উৎসর্গ।