বৃহস্পতিবার, ২৮ নভেম্বর, ২০২৪  |   ১৮ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   ফরিদগঞ্জে সংবাদকর্মীর কন্যাকে অপহরণ চেষ্টায় অভিযুক্তদের অবিলম্বে গ্রেফতারের দাবি ফরিদগঞ্জ প্রেসক্লাবসহ বিভিন্ন সংগঠনের
  •   লক্ষ্মীপুরে মাদকসহ বাবা ও দুই ছেলে আটক
  •   চাঁদপুর সদর মডেল থানা পুলিশের অভিযানে বিভিন্ন মামলার ৮ আসামী আটক
  •   ফরিদগঞ্জ পাকহানাদার মুক্ত দিবস পালন
  •   যৌথ অভিযানে কচুয়া থানার লুণ্ঠিত পিস্তলের ৮ রাউন্ড গুলি উদ্ধার

প্রকাশ : ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০০:০০

আত্মঘাতী
ক্ষুদীরাম দাস

এক.

সর্বশক্তি দিয়ে পি. আর. সাহেব গাড়ির দরজাটি খুললেন। রানাকে সজোরে এক লাথি দিয়ে টেনে-হেঁচড়ে গাড়ি থেকে নামিয়ে আনলেন। আর সেই সাথে অকথ্য ভাষায় গালাগালি দিতে লাগলেন। আর দুই হাতে চরথাপ্পড় দিতেই চলেছেন। চিৎকার শুনে কারখানার সমস্ত লোকজন তাকিয়ে আছে। ভয়ে সকলেই কাঁপছে। কী জানি, হয়তো আজ তাদের কপালেও শনি আছে। কারণ পি. আর. সাহেব একবার রেগে গেলে কাউকে ছেড়ে দেন না। এতে দোষ থাকুক, আর না থাকুক। পুরোনো বিষয় টেনে এনে হেনস্তা করতে থাকেন।

রানাকে সজোরে এক লাথি দিলেন। সাথে রানা ‘ওমা গো’ বলে মাটিতে বসে গেলো। প্রচণ্ড ব্যথায় নাক চেপে ধরে কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে বসে রইলেন। আর এদিকে চিৎকারে করে আর. পি. সাহেব হুঙ্কার দিতে থাকলেন। এক পা, দু পা করে এদিক ওদিক ছুটাছুটি করতে থাকলেন। একসময় রানার দিকে আবার তেড়ে আসলেন। রানার দুই কান টেনে ধরে তাকে দাঁড় করালেন। আর বলতে লাগলেন, হারামি কোথাকার! ঠিকমতো গাড়ি চালাতে পারিস্ না? কয়েকদিন পর পর গাড়ির এটা ক্ষতি হয়, ওটা ক্ষতি হয় কেন? গাড়ির তেল এতো তাড়াতাড়ি শেষ হয় কেন? চুরি করিস্ নাকি? ধরতে পারলে জেলের ভাত খাইয়ে ছাড়বো রে তোকে!

রানা অনুনয়ের সাথে বললো, স্যার, আমি কোনোদিন তেল চুরি করিনি!

পি. আর. সাহেব আরো ক্ষেপে গিয়ে বলতে লাগলেন : তোর এতো বড় সাহস, আমার মুখের উপর কথা বলিস?

এই বলে আবারো রানাকে চড়থাপ্পড় দিতে থাকলেন। রানার কাছে সবই অসহ্য লাগছিলো। এদিকে কারখানার লোকজন যে যার কাজে মনোযোগ দিলো। তবে কেউ কেউ উঁকি ঝুঁকি দিয়ে সবই দেখতে থাকলো। এটা প্রতিদিনকার ঘটনা। আজ এর সাথে, কাল ওর সাথে ঘটনা ঘটেই থাকে। কারখানার মালিক বলে কথা! তাই পি. আর. সাহেবের কারখানায় মানুষ বেশি দিন টিকতে পারে না। কেউ কেউ হঠাৎ করে পালিয়েও চলে যায়। এটা মোটেও নতুন কিছু নয়।

হঠাৎ পি. আর. সাহেবের মোবাইলটি বেজে উঠে। তাই মোবাইল রিসিভ করে তাড়াতাড়ি অফিসের দিকে চলে গেলেন। কারখানার অন্যান্য কর্মচারীরা সহানুভূতি দিতে দিতে রানাকে নিয়ে গেলো। কেউ একজন এসে বললো, পি. আর. সাহেব চলে গেছেন। একঘণ্টার মধ্যে লন্ডন চলে যাবেন কোনো এক মিটিংয়ে যোগ দিতে।

এদিকে রানা অসুস্থ হয়ে গেলো। পি. আর. সাহেবের লাথির কারণে বুকে ভীষণ ব্যথা অনুভব করছেন। দীর্ঘদিন কারখানায় কাজ করার সুবাদে কিছু লোকের সাথে বিশ্বস্ত বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিলো। তারা তাকে প্রায় সময় এসে সান্ত¡না দিতে থাকে। একটা অটো বন্ধুরা ভাড়া করে এনে রানাকে নিয়ে হাসপাতালের দিকে রওনা হলো। খুব যত্নের সাথে রানাকে বন্ধুরা নিয়ে যাচ্ছে। একজন বন্ধু রানার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু কোনো সান্ত¡না দেয়ার মতো ভাষা খুঁজে পেলো না। তখন রানা বলে উঠলো, ইচ্ছে করছে আজই চাকুরিটা ছেড়ে দিই।

বন্ধু অনেকটা অভিমানের শুরে বললো, তাহলে যাস না কেন? তোর উপর এতো অত্যাচার আমি সহ্য করতে পারি না। তোর তো এখান থেকে এখনই পালিয়ে যাওয়া উচিত।

রানা : চলে গেলো বাঁচবো কী করে ভাই! মাস শেষ হলে যে বেতন পাই, তা দিয়ে সংসার চালাই। একদিকে চাকুরির মায়া, তারপর সংসারের ছেলেমেয়ের দিকে তাকিয়ে সবই সহ্য করে যাচ্ছি। চাকুরি ছেড়ে দিয়ে কোথায় যাবো। তাছাড়া বয়স এখন বিয়াল্লিশ। এই বয়সে তেমন একটা ভালো চাকুরি পাবো বলে মনে হয় না। তাই মুখবুজে সহ্য করছি।

বন্ধু : মানুষ এতো খারাপ হতে পারে?

এক সময় রানা ঘুমিয়ে পড়লো কিছু সময়ের জন্যে। বন্ধুরা সকলে পি. আর. সাহেবের আচরণের জন্যে নানান কথা বলতে লাগলো। সকলের মুখেই পি. আর. সাহেবের উপর অভিশাপের সংলাপ। তাদের কথা শুনে মনে হবে এই মুহূর্তে তাকে কাছে পেলে সবাই মিলে ছিঁড়ে খাবে। একই রকমভাবে তাকেও রাস্তায় ফেলে মেরে ফেলবে। বুকে লাথি মারবে। বন্ধুরা একেকজন হুঙ্কার দিয়ে পরস্পরের সাথে কথা বলছে।

একসময় তার হাসপাতালে চলে আসে। রানাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তাকে নিয়ে হাসপাতালে যায় সকলে। ডাক্তার দেখিয়ে তার চিকিৎসার করায়। একজন বন্ধু ডাক্তারের প্রেসকিপশন দেখিয়ে ফার্মেসী থেকে ঔষধ কিনে আনে। পরে তারা সকলে ওয়েটিং রুমে কিছু সময়ের জন্যে বসে। সকলে চুপচাপ কিছুক্ষণ রইলো। একসময় বন্ধুরা সকলে পরস্পরের দিকে তাকায়। কয়েকজন বন্ধু উঠে দাঁড়িয়ে এদিক সেদিক পায়চারি দিকে থাকে। সকলেই যে যার মতো ভাবছে। একজন বন্ধু এক গ্লাস পানি এনে রানাকে ঔষধ খাইয়ে দেয়। রানা কিছু সময় আরাম করে চেয়ারে বসে থাকে।

কিছু সময় পর রানা সবাইকে বললো : এই অমানুষটা সোনার চামচ নিয়ে জন্মেছে তো তাই আমাদের মতো গরিবদের দুঃখ বুঝতে চায় না। টাকা আছে বলে যাচ্ছেতাই করছে। গরীবের উপর অত্যাচার সৃষ্টিকর্তা সইবে না।

একজন বন্ধু বললো : সে তো আমাদের উপর দিনের পর দিন অত্যাচার করছে।

: তাহলে আমরা কী করবো? আমাদের কী করা উচিত?

: আমরা সকলে চাকুরি ছেড়ে চলে যাই।

: না না সেটা আমাদের ভীষণ বোকামী হবে।

: আমাদের চাকুরি ছাড়া যাবে না। চাকুরি আছে বলেই আমরা বেঁচে আছি। আর আমরা গরীব বলে তাদের মতো মানুষের কর্মচারী হয়ে রয়েছি।

: তাই বলে এভাবে আমাদের উপর অত্যাচার করবে?

: টাকাওয়ালারা এভাবেই আমাদের মতো অসহায়দের উপর অত্যাচার করে।

: ঠিক বলেছিস্। এটা মোটেও নতুন কিছু নয়।

: ওদের মনের মধ্যে মনুষ্যত্ববোধ বলতে কিছুই নেই। নৈতিক শিক্ষা ওদের নেই। তাই ওদের মনের মধ্যে পশুত্ব কাজ করে। আমাদের মতো মানুষদের মানুষ বলে গণ্য করে না।

: ওরা ধনী লোক। ওদের জীবনই আলাদা।

: তাই বলে কি আমরা মানুষ নই? আমাদের উপর এভাবে অমানসিক নির্যাতন চালাবে? এভাবে আর কতোদিন।

রানা বন্ধুদের সব কথা শুনছিলো। সে উঠে দাঁড়িয়ে কিছু বলতে চায়। মনের মধ্যে কোনো সিদ্ধান্ত বাসা বেঁধেছে। সিগারেটের প্যাকেটটা বের করে তাকিয়ে দেখলো, লেখা আছে, ধুমপান স্বাস্থ্যের জন্যে ক্ষতিকর। তবুও মানুষ এই বিষয় পান করে। আমরা সকলেই বিষয় পান করি। সুতরাং বিষের জ্বালা আমাদের শরীরে রয়েছে। আমরা গরীব বলে কম দামী পান করি। আর ধনী বলে পি. আর. সাহেব দামী দামী সিগারেট পান করে।

ওরা সকলে উঠে দাঁড়ায়। আর তারা হাসপাতাল থেকে সকলে চলে যায়। কিছুদিন পর রানা সুস্থ হয়ে উঠে।

বেশ কিছুদিন দিন পি. আর. সাহেব লন্ডন থেকে ফিরে আসে। তার কিছুদিন পর আবারও রানাকে মারধর করে। সেই সাথে আরো কয়েকজন কর্মচারীকেও মারধর করেছিলো। কাউ কাউকে গালাগালি করেছিলো। এভাবে অত্যাচারিত হতে হতে দিন চলে যেতে থাকে।

একদিন এক বয়স্ক দাড়োয়ানকে জুতা দিয়ে পেটালো। এটা দেখে কারখানার বয়স্ক কর্মচারীরা এগিয়ে এসেছিলো। কিন্তু তারা পি. আর. সাহেবকে কিছুই বলার মতো সাহস করলো না। বয়স্ক লোকটি জুতা পেটা খেয়ে কাঁদতে কাঁদতে অফিসের দিকে চলে গিয়েছিলো। একজন সহকর্মীকে বলেছিলো : এই পি. আর. কে আমি ছোট বেলা থেকেই দেখছি। তাকে আমিও কোলে নিয়েছিলাম। কোলে করে নিয়ে তাকে গাড়িতে বসিয়েছিলাম। তাকে আমি অনেক আদর যত্ন করতাম। তার বাবা আমাকে প্রচণ্ড ভালোবাসতেন। অনেক শ্রদ্ধা করতেন। আর আজ আমি তার দ্বারা অপমানিত হলাম। আমার গায়ে এভাবে হাত তুললো! বয়স্ক লোকটি এর কিছুদিন পর মারা যায়। সকলেই বলতে থাকে, পি. আর. সাহেবের অপমান সহ্য করতে না পেরে বয়স্ক লোকটি মারা গেছে। সকলেই লোকটির জন্যে হাহুতাশ করেছিলো।

দুই.

একদিন শহর ঘুরতে রানা পি. আর. সাহেবের ছেলেমেয়ের নিয়ে বের হলো। সারাদিন তাদের নিয়ে ঘুরলো। একটি বাসের সাথে গাড়ির ঘষা লাগে। এতে সাদা গাড়ির একপাশ দাগ হয়ে যায়। দাগটি বিশ্রী রকমের হয়ে গেছে। গাড়ির সৌন্দর্য আর আগের মতো নেই। ছেলেমেয়েরাও আপসোস করছে; আর ঠিক বাবার মতোই রানাকে গালাগালি করতে লাগলো। তারা বললো : আজ আমরা সকলেই বাবার কাছে আপনার কথা বলবো। আপনি ইচ্ছে করেই গাড়ির এই ক্ষতি করলেন। বাবা আপনাকে আবারও মারবে।

রানা : আরে বাবা আমি তো আর ইচ্ছে করে এ রকম করিনি। এটা হয়ে গেছে। এটা দুর্ঘনা।

ওরা হুঙ্কার দিয়ে বললো : আবার মুখে মুখে কথা বলছেন। আবার সাহস তো কম নয়। আজ বাবাকে অবশ্যই নালিশ করবো আপনার নামে।

রানা ওদের সাথে কোনো কথাই বললো না। শুধু মনে মনে ভাবলো, কপালে যা হবার তাই হবে।

গাড়ি চালাতে চালাতে একসময় বাড়িতে চলে এলো। দাড়োয়ান গেইট খুলে দিলেন। আর রানা গাড়িটি নিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকলো। সাথে সাথে পি. আর. সাহেবের ছেলেমেয়েরা দৌঁড় দিয়ে বাবার রুমে গিয়ে রানার নামে বলে দিলো। সাথে সাথে পি. আর. সাহেব একটা লাঠি হাতে নিয়ে ছুটে এলো। আর রানাকে দেখতে পেয়ে ইচ্ছেমতো পেটাতে লাগলো। আর বলতে লাগলো : ছোট লোকের জাত। তোদের তিন পুরুষের এমন গাড়ি ছিলো নাকি রে। তোরা দেখেছিস এমন গাড়ি। আমার গাড়ির উপর অত্যাচার করিস। তোরা টাকা পয়সার মুখ দেখেছিস রে।

পি. আর. সাহেবের ছেলেমেয়েরা এসব দেখছিলো। তারা রানাকে আরো বেশি করে মারার জন্যে উসকে দিতে লাগলো। বলতে লাগলো : আরো মারে দুষ্ট লোকটাকে, আরো বেশি করে মারো। যে চিরজীবন মনে থাকে।

রানা সমস্ত লাঠির আঘাত সইতে লাগলো। কিন্তু আজ অন্যদিনের মতো কিছুই করেনি রানা। শুধু দু’চোখের জল ফেলতে লাগলো। পি. আর. সাহেব ঘাড় ধাক্কা দিয়ে রানাকে বাড়ি থেকে বের করে দিলো।

হাঁপাতে হাঁপাতে পি. আর. সাহেব ঘরে ঢুকে গেলেন।

কেটে গেলো বেশ কয়েকটি মাস।

(আগামী সংখ্যায় সমাপ্য।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়