প্রকাশ : ২৭ আগস্ট ২০২৩, ০০:০০
(গত সংখ্যার পর)
দুই.
পুরোনো বাড়ির পুরোনো ছাদ হলেও অন্যান্য বাড়ির তুলনায় বাড়িটা চমৎকার। আলাদা সৌন্দর্য বাড়িটার মধ্যে লুকিয়ে আছে। বাড়ির ছাদটা বিশাল। বিকেল হলে বাড়ির ছাদে সূর্যের আলো পড়ে না। পাশে থাকা গাছগুলো সূর্যকে ঢেকে দেয়। কিছুক্ষণ আগে বৃষ্টি হয়েছিলো। তাই ধুলোবালির রাজত্ব নেই। ডুবু ডুবু সূর্যটা কিছুক্ষণ পরে আর আলো দেবে না পৃথিবীকে। অন্যরকম আলোয় চারদিকে ভরে আছে। বাতাসটাও বেশ লাগছে। কিন্তু সেই বাতাসে সোহেলীর মনটা কেনো জানি হু হু করে উঠলো। সোহেলী ছাদের পরিবেশটা একনজর দেখে নিলো। বড় বড় বালতিতে বিভিন্ন রকমের গাছগুলো সতেজ হয়ে রয়েছে। সেই গাছগুলোর পাশে লোহার রেলিংয়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মনটা তার বিষণ্ণ। কিছুক্ষণ আগে তার ছোট ভাইয়ের সাথে একটু ঝগড়া হয়েছে।
সোহেলীর ভাই শাওন প্যাকেটভর্তি মিষ্টি এনে সোহেলীর সামনে রেখে বললো, দিদি তুই খেয়ে নেয়। মিষ্টিটা দারুণ খেতে। সোহেলী অন্যদিকে তাকিয়ে বললো, এগুলো তুই খা রে ভাই। আমার ইচ্ছা করছে না।
শাওন : আমি অনেক খেয়েছি। এবার তুই খেয়ে নে। ভালো লাগবে। নতুন নতুন আমাদের ছেড়ে এসেছিস তো তাই তোর মনটা খুবই খারাপ লাগছে।
সোহেলী : তুই কি কোনোদিন মিষ্টি খাসনি? খুবই বিরক্ত লাগছে।
শাওন : বুঝতে পেরেছি। তোর জামাই এনেছে বলে তুই এভাবে আমাকে কথা শোনাচ্ছিস? আমি আর খাবোই না।
সোহেলীর হাতে কতোগুলো ছবি দিয়ে শাওন দ্রুত চলে গেলো। সোহেলী বুঝতে পেরেছে এগুলো কিসের ছবি। সে ছবিগুলো বের করে একে একে দেখতে লাগলো। সোহেলীর সঙ্গে রওনের বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। সোহেলী যখন কলেজে যায়, তখন রওন তাকে একনজর দেখেছিলো। আর আজ সোহেলী দেখছে ছবিতে। রওনের মা-বাবার খুবই আদরের সন্তান। সোহেলী ছবিগুলো একে একে দেখতে লাগলো। বেশ তো! চেহারায় নাদুনুদুস ভাব আছে। একটা ভালো কোম্পানিতে সে ভালো চাকুরি করে। পোশাক আশাকে সেটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। তবে চেহারাটা মোটেও ভালো নয়। কিন্তু টাকা পয়সা থাকলে বাজে চেহারাও ভালো হয়ে যায় পোশাক আশাক আর সাজগোছে। রওনকেও সে রকমই লাগছে। তবে ছেলেটির প্রতি সোহেলীর মোটেও ভালো লাগা জেগে উঠেনি। তবুও সোহেলীর চোখে সে আজ থেকে জীবনসঙ্গী।
তিন.
কলেজে ভর্তির সময় সোহেলীর সঙ্গে অর্নবের পরিচয় হয়। ছেলেটা গরিব। প্রথম দিন যে শার্ট পরতে দেখা গেছে, সেই শার্ট এক বছরও দেখা যায়। মধ্যবিত্ত কিংবা গরিবের সন্তানেরা এ রকমই হয়। নিত্যনতুন পোশাক তাদের কপালে জোটে না। যদিও ছেলেটা দেখতে কালো, তবুও সোহেলীর তাকে বেশ ভালো লেগে যায়। অর্নব একটু কথা বললেই কেন যেন ভালো লাগায় সোহেলীর মন ভরে যায়। এটা হয়তো প্রেম সোহেলী সেটা স্পষ্ট বুঝতে পারে। কিন্তু এটা একতরফা। তবে অর্নব জানিয়েছে, সে নাকি কোনোদিনও বিয়ে করবে না। এটা তার প্রতিজ্ঞা। সেটা জানার পর থেকে সোহেলী তার সাথে কম কথা বলতো। ছেলেটা নাকী আজীবনই বই পড়বে; তারপর একদিন মরতে চাইরে মরে যাবে। তবে সে এমনি এমনি মরবে না। মা-বাবাকে সুখী করতে করতে মারবে। আর সোহেলী চিন্তা করে, সে যদি এখন বিয়ে করে তাহলে মা বাবাকে সে কোনোদিনও উপকার করতে পারবে না। তাদেরকে সুখী করা তার স্বপ্নই থেকে যাবে না, বাস্তবে তা কোনোদিনও পূরণ হবে না। মাঝে মাঝে সোহেলীর খুবই খারাপ লাগে যে, তার জন্যে মা বাবার অনেক টাকা খরচ করতে হচ্ছে। হয়তো করছে। কিন্তু তারা এমন একটা ভালো ছেলে মোটেও হাতছাড়া করতে রাজি নয়। সোহেলী মনে মনে চিন্তা করে, যদি কোনোদিন রওন তাকে ফোন করে তাহলে সে পরিষ্কার জানিয়ে দেবে, সে বিয়ে করবে না। হয়তো তার মা বাবা তার সিদ্ধান্ত মেনে নিবে। কিন্তু না মানারই তো কথা। কারণ, এমন ভালো ছেলে, তাছাড়া তাদের নিজেদের সুখের জন্যে বিয়ে না দিয়ে সোহেলী সিদ্ধান্তে তারা মোটেও রাজি হবে না। রওনকে তার বিয়ে না করার আপত্তিটা জানাতেই হবে।
সোহেলী এসব ভাবছে, এমন সময় তার হাতের ফোনটি বেজে উঠে। ফোনটা রিসিভ করতেই রওন বললো : মনে হয় বিরক্ত করলাম।
সোহেলী : না না, বিরক্ত নয়।
রওন : তাহলে ফোনটা তুলতে দেরী হলো যে।
সোহেলী : ফোনটা সাইলেন্ট করা ছিলো তাই।
রওন : ও তাই।
সোহেলী : তারপর কি বলতে চেয়েছো?
রওন : তোমাকে যে বইটা দিলাম সেটা তুমি পেয়েছো?
সোহেলী : কোন বইটা?
রওন : কেনো যেটা তোমার ভাইকে দিয়ে পাঠালাম সেটা তুমি পাওনি?
সোহেলী : না। সে তো এখনো আমাকে দেয়নি। হয়তো দেবে, ভুলে গেছে হয়তো বা।
রওন : হতে পারে।
সোহেলী : তোমাকে একটা কথা বলবো।
রওন : বলতে পারো।
সোহেলী: তুমি রাগ করবে না তো?
রওন : না, মোটেও রাগ করবো না।
সোহেলী : আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই না। আমার মনে একটা স্বপ্ন আছে। সেটা আমি পূরণ করতে চাই।
রওন : আমি তোমার কথা বুঝতে পেরেছি। তাহলে তো তোমার প্রতি ইচ্ছা জাগানো যায় না। সুতরাং তোমার প্রতি আমার আর কোনো ইন্টারেস্ট নেই। তুমি মুক্ত।
সোহেলী : একটু অপেক্ষা। ফোনটা রেখে দিও না।
রওন : আর কিছু বলার আছে?
সোহেলী : কী আশ্চর্য! এতো সহজে তুমি মেনে নিলে? আমি তো রীতিমতো অবাক হচ্ছি।
রওন : আমি মোটেও আশ্চর্য হইনি। এটাই বাস্তব। তুমি সরাসরি আমাকে মনের কথা বলেছো। এটা সবচেয়ে ভালো হয়েছে। যদি বিয়েটা হয়ে যেতো, তখন যদি এই কথা বলতে তাহলে আমার পরিবারের সম্মান যেতো। আর আমি চিরদিন কষ্ট পেতাম। সুতরাং বিয়ের আগেই তুমি তোমার বাস্তব কথা বলেছো, সে জন্যে তোমাকে ধন্যবাদ। এখন আমি বুঝতে পেরেছি। তুমি আমাকে পছন্দ করোনি।
সোহেলী : আমার অন্য একজন ভালো লাগে।
রওন : তাহলে তো আর কথা বাড়িয়ে লাভ নেই।
রওন এ কথা বলেই ফোনটা কেটে দিলো। আর সোহেলী খুবই আশ্চর্য হলো। এমন অদ্ভুত মানুষ থাকতে পারে পৃথিবীতে! তারপর ছবিগুলো হাত থেকে টেবিলের উপর রেখে সোহেলী নিজের ঘরে চলে যায়। দু’চোখ বন্ধ করে ঘুমিয়ে থাকে। (সমাপ্ত)