প্রকাশ : ১২ আগস্ট ২০২৩, ০০:০০
হস্পিটালের বেডে শুয়ে থাকা মেয়েটির নাম রিমা। কিছুক্ষণ আগেই তাকে হাসপাতালের ওটি রুমে নেয়া হয়েছিল। রিমার মা-বাবার কাছে বোধহয় খবরটি এতক্ষণে পৌঁছে দিয়েছেন সাব-ইন্সপেক্টর কাদের। হাসপাতালে করিডোর রিমার কথা ভাবতে ভারতে পাঁয়চারি করছিলেন ওসি মানিক। রিমাকে তিনি ছোটবেলা থেকেই চিনেন। ওর বাবা শফিকুলের সাথে ওসি সাহেবের খুব ভালো সম্পর্ক । রিমার মায়ের চাকরির সুবাদে ও রিমাকে ভালো স্কুলে ভর্তি করাতেই কিছুদিন আগে শফিকুল সাহেব তাদের ঢাকায় নিয়ে আসেন। ওসি সাহেবের ভাবনার ছেদ ঘটিয়ে ডাক্তার রিমার রিপোর্ট হাতে বেরুলেন। ওসি সাহেব রিমার কথা জিজ্ঞেস করলেন। ডাক্তার তাকে আশ্বস্ত করে বললেন, She is out of danger. সঠিক সময় ওকে হস্পিটালে এনেছেন দেখে বিষক্রিয়া থামানো সম্ভব হয়েছে। বেশি সময় হয়ে গেলে ও হয়ত আজ আমাদের মাঝে
থাকতো না। রিমাকে এখন জেনারেল বেডে শিফট্ করা হয়েছে আর সম্পূর্ণরূপে অবজার্ভেশনে রাখা হয়েছে । ওসি সাহেব রিমার রিপোর্ট দেখতে দেখতে জিজ্ঞাসা করলেন, ডাক্তার সাহেব মেয়েটির এমন করার কারণ কী? মুখে এক রহস্যময়ী হাসি ঝুলিয়ে ডাক্তার সাহেব বললেন, আপনার কী মনে হয় ওসি সাহেব? রিপোর্ট দেখা শেষ করে ওসি সাহেব বললেন, বুঝতে পারছি না ডাক্তার সাহেব৷
রিমা একটা স্কুলপড়ুয়া মেয়ে। সে স্কুলের ল্যাব রুম থেকে কঈঘ নিয়ে মুখে পুড়ে সুইসাইড করতে চাইলো। তারপর আবার রাস্তায় গিয়ে গাড়ির সামনে গিয়ে মরতে চাইলো৷ কদিন আগে আবার ওর মা-বাবার ডিভোর্স হয়ে গেল। ও কি এই ট্রমাটা সহ্য না করতে পেরেই এই কাজটা আমি করে বসলো? নাকি অন্য কারণে। কিছুই বুঝতে পারছি না ডাক্তার সাহেব।
ওসি সব কথা শুনে ডাক্তার সাহেব বললেন, ওসি সাহেব আমার কেবিন চলুন। আপনাকে আমার কিছু বলার আছে। কফি খেতে খেতে বলি? ওসি সাহেব
বললেন, ঠিকাছে। ওয়ার্ডবয় এসে কেবিনে দু কাপ কফি রেখে টেবিলে রেখা গেল। কফির ধোঁয়া উড়ছে তার সাথে সাথে ওসি সাহেবের চিন্তা ও আগ্রহ বেড়েই চলেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই রিমার বাবা ও মা উপস্থিত হলেন। তারা রিমার অবস্থা জানতে চাইলে ডাক্তার ২ মিনিটেই তার শারীরিক অবস্থা ও অন্যান্য মেডিকেল টার্মসগুলো বুঝিয়ে দেন। কেবিনটিতে কিছুক্ষণ নিরবতা বিরাজ করছে। নিরবতার অবসান ঘটিয়ে ডাক্তার বলা শুরু করলেন, জানেন রিমার ল্যাব ইউনিফর্মের পকেট থেকে আমি এই সুইসাইড নোটটি পেয়েছি। আপনারা সম্মতি দিলে পড়ে শোনাতে চাই। ‘হ্যাঁ অবশ্যই’। কেবিনটিতে উপস্থিত সবাই মলিন কণ্ঠে বলে উঠলেন-‘আমি রিমা। বয়স ১৬ বছর ৭ মাস ৩৬ দিন। এখন দুপুর দুটো বেজে ৫০ মিনিট । আমি এখন একা একা ল্যাবে বসে আছি। কিছুক্ষণ পরই আমি কঈঘ (পটাশিয়াম সায়ানাইড) খেয়ে আত্মহত্যা করবো। তার আগেই বলে রাখছি কঈঘ স্কুলের ল্যাব রুম থেকে নেয়া হয়নি। এটি আমি আগেই জোগাড় করেছি। যাই হোক আত্মহত্যা করার মূল কাহিনিতে আসি। আমি বাবা ও মা মিলে শহরতলি নামক একটা মফস্বল শহরে থাকতাম। আমার বাবা একজন ব্যবসায়ী ও মা একজন শিক্ষক। বরাবরই আমি মা-বাবার একমাত্র মেয়ে একমাত্র ডাক্তার। তাই তাদের স্বপ্ন আমাকে একজন ডাক্তার বানানোর। স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে আমাকে ঢাকার স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করানো হয়। আমার মা-বাবার দুজনেই অর্থ উপার্জনে নিয়োজিত ছিলেন দেখে দুজনেই খুব নিজেদের টাকাণ্ডপয়সা নিয়ে বড়াই করত ও অহংকার করত। এই টাকাণ্ডপয়সা নিয়ে প্রায়শই বাসায় তাদের মাঝে ঝগড়া হতো। এই টাকা নামক বস্তুটা দিনদিন আমার কাছ থেকে আমার মা-বাবাকে কেড়ে নেয়া শুরু করল। তাই টাকাণ্ডপয়সার প্রতি আমার আগ্রহ কমা শুরু হলো এবং এটি এখন ঘৃণ্য বস্তুতে আমার কাছে পরিণত হলো। বাসায় এত ঝামেলার কারণে শহরতলির সেই ছোট্ট স্কুলটা আমার প্রিয় স্থান হিসেবে তৈরি করে নিলাম। কিন্তু এই নতুন স্কুলে তা হচ্ছিল না এমনকি আমার আগের স্কুলের মতন বন্ধু ও হয়ে উঠছিল না। এখানে এসে দেখি কিছু সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়েদের দেখি যারা নিজেদের বাবা-মায়ের টাকা নিয়ে অনেক অহংকার করত। তারা তাদের থেকে একটু অসচ্ছল। বা মধ্যবিত্ত মেয়েদের ছোট করতো, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করতো অপমান করতো এমনকি ব্যাগিং করতো। এছাড়াও তাদের অন্যতম কাজগুলোর মধ্যে একি হচ্ছে ক্লাসে কাউকে পড়তে না দেয়া। তাই শান্তির স্থানটিও হয়ে গেল খুব বিরক্তির। আমার বাবা-মা তাদের এক্সপেক্টেশন প্রবনের জন্য আমাকে প্রচুর প্রেশারাইজ করতো । তারা আমার জন্য science -Gi me sub -এর টিচার বাসায় রেখে পড়াতেন। কিন্তু যখন আমার মাইন্ড ফ্রেশ করার আমার প্রিয় কাজগুলো থেকে বিরত রাখতেন। আমাকে আমার পাঠ্যপুস্তকের বইয়ের বাইরে অন্য বই পড়তে দিতেন না। এমনকি স্বাংস্কৃতিকাঙ্গনে আমাকে পা ফেলতে দিতেন না। যার ফলে আমি ধীরে ধীরে বিষণ্ন হতে থাকি। এই বিষণ্নতাটা বেড়ে গেল যখন আমার বাবা-মা আমার উচ্চতর গণিত পরীক্ষার আগের ডিভোর্স নেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। যার ফলে আমার বিষণ্নতা প্রচুর পরিমাণে বাড়তে থাকলো। আমি তখনই হাত কেটে নিজেকে শেষ করে দিতে চাইলাম। কিন্তু স্বপ্নপূরণের জন্য তা করলাম না। তারপর স্কুলে বন্ধুরা, তাদের মা-বাবারা প্রতিবেশীরা পাড়ায় অনেকেই নানান কটূক্তি করতে শুরু করলেন। নানান কথা শোনা লাগত আমার। সবকিছুর পরও নিজেকে সামলে রাখলাম৷ কিন্তু যখন দেখলাম আমার উচ্চতর গণিতে F grade আসার পর নিজেকে আর সামলাতে পারলাম না। আমি ভেবেই নিয়েছি আমার দ্বারা স্বপ্নপূরণ কখনো সম্ভব না। তাই আমি সিদ্ধান্ত নিচ্ছি আমি আত্মহত্যা করবো। সরি বাবা মা তোমাদের মেয়ে ব্যর্থ। তোমাদের মেয়ে তোমাদের কিছুই দিতে পাবলো না। তারপরও বলতে চাই ভালোবাসি তোমাদের। পারলে এ কাজের জন্য ক্ষমা করে দিও।’ এই সব শোনার পর রিমার বাবা-মা বুঝতে পারলেন তাদের মেয়ের এই ভুল পদক্ষেপ নেয়ার কারণ কী?
ডাক্তার বললেন, আমাদের দেশে এমন অনেক উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্ত পরিবারের মেধাবী সন্তান আছে যারা মাধ্যমিক স্তরের নবমণ্ডদশম শ্রেণিতে পড়াকালীন আত্মহত্যা করছে, মেন্টালি প্রেশার না নিতে পেরে। সমাজে অনেকেই তখন বলে থাকেন নিশ্চিত এর কারো সাথে চক্কর চলছিল নইলে কী এ কাজ করে কেউ। কিন্তু যখনই সেই কিশোর বা কিশোরী আপনাদের সামনে আনমনে হাঁটা-চলা করতো নিজেকে সবকিছু থেকে আলাদা করত তখন ও তাদের অতি সামাজিক মানুষেরা নানা ধরনের কথা ও বাণী ঝেড়ে দেন। কিন্তু নিজেদের ভুলটা কোথায় সেটা বুঝতে পারেন না। এই সমাজের প্রতিটা মানুষই প্রত্যেকটা সুইসাইডের পেছনে দায়ী। যখন তাদের মানসিক। সাপোর্ট-এর প্রয়োজন তখন আপনারা সান্ত¡নার বুলি ও কটূক্তি শোনান। বলে থাকেন এই বয়সে ডিপ্রেশন? ঠিক তখনই নিউটনের বলের ৩য় সূত্রের মতন আপনাদের কথাগুলো সুইসাইড রূপে প্রতিক্রিয়া করে বসে। তখনই রিমার মতন ছেলে মেয়ারা সুইসাইড করে বসে । একে সুইসাইড নয় বরং আত্মার হত্যা করাকে বেশি বুঝায় । আশা করি ফলস্বরূপ আমরা যেই ডেড-বডিটা দেখি সেটা একটা আনুষ্ঠানিকতা হয় মাত্র। কিন্তু এই ভগ্ন হৃদয়ের কিশোর-কিশোরীরা তো অনেক আগেই মরে গেছে। আশা করি বুঝাতে পেরেছেন বর্তমানে কেন মেধাবী মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীরা আত্মহত্যা কে নিজের মুক্তি হিসেবে বেছে নিচ্ছে। তাই অনুরোধ করছি একটা মানুষকে কিছু বলার আগে তাকে জানুন। সে কেন এমন করছে তা জানুন এবং তার সাথে বন্ধুসুলভ আচরণের মাধ্যমে সুইসাইড রোধ করুন।