প্রকাশ : ২৪ জুন ২০২৩, ০০:০০
একটা প্রেম করার জন্য মানুষ যে কতটা উতলা হতে পারে, জব্বার ভাইকে না দেখলে তা অজানাই থেকে যেত। ষোলো থেকে ষাট অর্থাৎ অত্র এলাকার যেকোনো বয়সের সিঙ্গেল নারীই জব্বার ভাইয়ের কাছ থেকে প্রেমের অফার পেয়েছেন। কিন্তু তার দৌড় ওই পর্যন্তই। অর্থাৎ প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে কখনো গালিগালাজ, কখনো চড়-থাপ্পড়, কখনো-বা জুতোর বাড়ি... এসব খেয়ে খেয়েই তিনি অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছেন। মেসে তার জন্য বাটিতে রেখে দেওয়া খাবারও নাকি প্রায় দিন ও ভাবেই পড়ে থাকে।
একদিন বললাম, ‘ভাই আপনি এত্ত বেহায়া!’
জব্বার ভাই এমন হাসি দিলেন! উলটো মনে হলোÍ আমি বুঝি ভুলক্রমে তার প্রশংসা করেছি!
তিনি বললেন, ‘ছোটভাই, প্রেমের কী বুঝবা! প্রেম করলে না বুঝতা!’
আমি চুপ মেরে গেলাম। আমি যে প্রেম করি, সে-কথা ভুলক্রমেও ফ্ল্যাশ করা যাবে না। তাহলে ‘কীভাবে প্রেম করা যায়’Í সেই কৌশল জানতে চেয়ে চেয়ে পাগল করে ছাড়বেন। এমনিতেও যা উৎপাত করেন না! দেখা গেলÍ ডেটিংয়ের জন্য বেশ সাজুগুজু করে বের হয়েছি। অমনি কোত্থেকে জব্বার ভাই এসে খপাৎ করে হাতটা চেপে ধরেছেন। বলি জব্বারের চেয়েও শক্ত সে হাত। ছাড়ানো কঠিন। তার আহ্বান, ‘চল ছোটভাই, আজ একজনকে প্রপোজ করতে যাব।’
‘সে তুমি যাও না। আমাকে নিয়ে টানাটানি করছো কেন?’
‘আরে তুই গেলে আমার প্লাস পয়েন্ট। এত সাজুগুজু করে বের হয়েছিস, আমার এত্ত সুদর্শন-স্মার্ট ছোট ভাই আছে দেখলে মেয়েরা এমনিতেই পটে যাবে।’
‘হ্যাঁ, পটে তো যাবে। কিন্তু সে তো আমার ওপর!’ এই কথাটা বলতে গিয়েও আর বলা হলো না। বললাম, ‘তা গিয়ে আমাকে কী করতে হবে? খাম্বা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকব নাকি?’
‘তা কেন করবি। তুই আমার হয়ে ইয়ে... মানে ঘটকালি করবি। আসলে এখন আর মেয়েদের সামনে যাওয়ার সাহস পাই না খুব একটা।’
বেচারার অবস্থা দেখে মায়া হলো। গেলাম তার সাথে। কিন্তু যা কাণ্ড হলো...। নিজের গার্লফ্রেন্ডের সামনে গিয়ে তাকে জব্বার ভাইয়ের হয়ে প্রপোজ করলাম!
তারপরে আরও যা ঘটল...।
গার্লফ্রেন্ড কর্তৃক তীব্র অপমানিত তো হয়েছি বটেই; চর-খাপ্পড়, হাই-হিল জুতোর বাড়ি... সব জুটেছে। অথচ, এই জুতো জোড়া আমিই গত ঈদে ওকে কিনে দিয়েছিলাম! কী নিষ্ঠুর দুনিয়া! বিদায় পিতিবি!
মেয়েটি রাগ করে হনহনিয়ে চলে গেল। এদিকে আমারও জব্বার ভাইয়ের ওপর তীব্র রাগ করার কথা ছিল। কিন্তু রাগ করতে পারছি না। মাইর আজ এমনিতেও আমার পাওনা ছিল। পকেটের মানিব্যাগটা একেবারেই ফাঁকা। ডেটিংয়ে গার্লফ্রেন্ডকে কিছুমিছু খাওয়াতে হতো। সেই বিল দিতে না পারলে রেস্টুরেন্টের লোকজনই আমাকে যা আপ্যায়ন করার করত! তার থেকে গার্লফ্রেন্ডের মাইর খাওয়া ঢের ভালো! তাছাড়া, আজকের গার্লফ্রেন্ডই তো আগামী দিনের বউ! শুনেছিÍ পাড়ার বিবাহিত সকল বড় ভাইয়েরাই নাকি নিয়মিত বউয়ের হাতে মার খান! একসময় তো ভেবেছিলাম, জিনিসিপত্রের দাম বাড়তি বলে তারা এই ‘মার’ নামক খাবারটাই তিনবেলা ভাতের বিকল্প হিসেবে খাচ্ছেন!
জব্বার ভাই এতক্ষণ দূরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। কাছে এসে বললেন, ‘আজ ঝড়টা তোর উপর দিয়েই গেল রে...।’
‘ও কিছু না ভাই।’
‘কিছু না মানে, অবশ্যই কিছু! আমাকে মারলে কোনো সমস্যা ছিল না। তাই বলে আমার আদরের ছোটভাইটার গায়ে হাত!’
‘বাদ দাও না...।’
‘না। বাদ দেওয়া যাবে না। একটা ফাইনাল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি!’
‘কী?’
‘এই মেয়ের সাথেই আমার প্রেম করতে হবে।’
মাথায় যেন ঠাডা (বজ্রপাত) পড়ল। কোনোমতে ঢোক গিলে বললাম, ‘কী বলছো ভাই...! মেয়েটা বয়সে তোমার কত্ত ছোট!’
‘এজন্যই তো পারফেক্ট। এই ষোড়শীকেই আমার চাই।’
‘কিন্তু...।’
‘কোনো কিন্তু নয়। ষোলোতে প্রেম। আঠারো পেরুলেই বিয়ে। আহা! এতদিন কেন এভাবে ভাবিনি! চল তোকে আজ ট্রিট দেব।’
জব্বার ভাই জব্বর খানাপিনার আয়োজন করলেন। প্রেম হওয়ার আগে এভাবে কেউ ট্রিট দেয়? নাকি এটাকে আমার ব্রেকআপ পার্টি ধরে নেব?
গলা দিয়ে খাবার ঢুকছিল না। ভাবতে লাগলাম, জব্বার ভাইকে কীভাবে ফেরানো যায়?
শেষে বললাম, ‘ভাই তুমি তো একবার প্রত্যাখ্যাত হলে, দ্বিতীয়বার কোনো মেয়ের সামনে যাওনি। আজ হঠাৎ নতুন সিদ্ধান্ত নিলে যে?’
‘এতদিন এই ভুলটাই তো করে এসেছি রে। সে কারণেই আমার প্রেম হয়নি। তাছাড়া, এই মেয়ের সামনে তো আমি যাইনি। গিয়েছিস তুই। তোকে প্রত্যাখ্যান করেছে। আমাকে তো করেনি।’
জব্বার ভাইয়ের এমন জব্বর যুক্তি দেখে আমি তব্দা মেরে গেলাম। কোনোমতে বললাম, ‘কিন্তু... তখন না বললে, তুমি মেয়েদের সামনে যাওয়ার সাহস পাচ্ছ না।’
জব্বার ভাই জবরদস্ত হাসি হেসে বললেন, ‘সামনে না গিয়েও অন্য উপায় আরে রে ছোট।’
এরপর অনেকদিন জব্বার ভাইয়ের থেকে কেনো আপডেট পাইনি। তবে তাকে আমার গার্লফ্রেন্ডের বাসার ওদিকে ব্যাপক ঘোরাঘুরি করতে দেখেছি। প্রতি মুহূর্তে মনে হয়েছে, বোকা মেয়েটা আবার জব্বার ভাইয়ের প্রেমে পড়ে গেল নাকি! বোকা বলেই না আমার প্রেমে পড়েছিল। দিন দিন কনফিডেন্স কমে আসছে।
একদিন বাধ্য হয়ে জব্বার ভাইয়ের কাছে গেলাম।
‘ভাই, আপডেট কী?’
‘তুই ছোট মানুষ। প্রেমণ্ডটেম করিস না। এসব জেনে কী করবি।’
‘আহা, বলোই না।’
‘এখনো হয়নি। তবে লেগে আছি।’
একটু খুশি হলাম। বললাম, ‘আমার একটা বুদ্ধি আছে। চাইলে কাজে লাগাতে পারো।’
আসলে কুবুদ্ধি দিয়ে জব্বার ভাইকে কুপোকাত করতে চাইছি।
কিন্তু সে আমাকে পাত্তাই দিল না। বলল, ‘তুই ছোট মানুষ। প্রেমণ্ডটেম করিস না। তোর থেকে বুদ্ধি নিয়ে কী হবে?’
দুদিন পর সুখবরটা পেলাম। জব্বার ভাই ফেসবুকের রিলেশনশিপ স্ট্যাটাস চেঞ্জ করেছেন। সিঙ্গেল থেকে মিঙ্গেল! অবশ্য স্ট্যাটাসটা দেখে প্রথমে কলজেটা ধক করে উঠেছিল। পরে দেখলাম, ওটা আমার এক্স থুড়ি, গার্লফ্রেন্ড নয় গার্লফ্রেন্ডের খুব কাছের বান্ধবী। যদিও তুচ্ছ একটা ব্যাপার নিয়ে তাদের দু’জনের মধ্যে এমন ঝগড়া বেঁধেছে যে, গত তিন মাসেও কেউ কারো মুখ দেখেনি পর্যন্ত।
তারপর, ‘সুখের পর দুঃখ আসে’ এই নিয়ম মেনে আমার জীবনে এলো সেই কুদিন।
জব্বার ভাই আবারও তার রিলেশনশিপ স্ট্যাটাস চেঞ্জ করলেন। এবার আর কোনো বেঁচে যাওয়ার ঘটনা ঘটেনি। অর্থাৎ আমার গার্লফ্রেন্ড থুড়ি এক্সই এখন জব্বার ভাইয়ের প্রেমিকা!
একদিন পথে ভাইয়ের সাথে দেখা হলে তিনি জোর করে রেস্টুরেন্টে নিয়ে বসালেন।
‘আমাদের প্রেম কাহিনি শুনবি?’
‘না ভাই। শোনার মুড নাই।’
‘আরে, শোন না। আরেকটু বড় হ। তোরও তখন গার্লফ্রেন্ড হবে। তখন তো ঠিকই এই জব্বারের কাছে এসে টিপস চাইবি।’
ইচ্ছা না থাকলেও শুনতে হলো জব্বার ভাইয়ের জব্বর প্রেম কাহিনি।
‘বুঝলি তো। তখন কোনো মেয়ের সামনে গিয়ে প্রপোজ করার মতো মানসিক সাহস পর্যন্ত ছিল না। আর, আশেপাশের চল্লিশ গ্রামে এমন কোনো সিঙ্গেল মেয়ে বাকি ছিল না, যাকে আমি প্রপোজ করিনি। একমাত্র সিঙ্গেল ছিল ওই মেয়েটি, অর্থাৎ আমার জানপাখি। মেয়েটি তোকে মেরেছে বলে ভাবিস না যে সে খুব রুড। আসলে খুবই দয়ার শরীর তার। যাই হোক, প্রথমেই ঠিক করে নিলাম এবার আর কারো সামনে যাব না। প্রেম হবে ফেসবুকে। প্রথমে ফেসবুকে তার ফ্রেন্ড হলাম। নানাভাবে তাকে আকর্ষণ করার চেষ্টা করলাম। তার বাসায় গিফট পাঠালাম। কিন্তু এসবে কোনো কাজই হলো না। একদিন, একজনের থেকে জানতে পারলাম, ক্লোজ বান্ধবীর সাথে তার কথা বন্ধ! তুই তো জানিসই, ওর সেই বান্ধবীকেও একদা প্রপোজ করেছিলাম। যাকগে, ওর বান্ধবীর নামে (ফেক) আইডি খুললাম। সেই আইডিটি ট্যাগ করে রিলেশনশিপ স্ট্যাটাস দিলাম। ক’দিন আমার ওয়াল থেকে চমৎকার সব পোস্ট দিলাম। অবশ্য তার সবটাই যে কবি গুপ্তদা’র থেকে নেওয়া, সে তো তুই অনুমান করতেই পারছিস। তারপরই ঘটল ম্যাজিক! আসলে জানিসই তো, মেয়েরা এমনিতে ছেলেদেরকে দাম দেয় না। আর যারা প্রেম করে না, তাদের দাম খুবই কম। এই যেমন, এখন কোনো মেয়ের কাছে তোর এক পয়সারও দাম নাই। তুই চাইলে আমার বুদ্ধিটা প্রয়োগ করে দেখতে পারিস। যাক, এখন বাকিটা শোন। একদিন টুংটাং শব্দের পরে ইনবক্স চেক করে দেখি পাখি আমার নিজেই হাজির হয়েছে! তার ‘এক্স’ বান্ধবীর সাথে প্রেম করছি কৌতূহল তো থাকবেই। মেয়েটি নিজে থেকেই আমার সাথে আলাপ জমাল। ধীরে ধীরে আলাপ গভীর হলো। জানিসই তো, মেয়েরা আরেকজনের কাছ থেকে তার প্রেমিক কেড়ে নিতে ব্যাপক পারদর্শী। এক্ষেত্রেও সেটাই ঘটল। ষোড়শী আমাকে তার বান্ধবীর বয়ফ্রেন্ড মনে করে দখল করে নিলো। তাছাড়া আমাকে বলেছে, তার বান্ধবীকে যেন না জানাই। কোনো যোগাযোগই যেন না রাখি। আর তার বয়স আঠারো হওয়া মাত্রই আমাকে বিয়ে করে নেবে সে!’