বুধবার, ২৭ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২৫ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   ফরিদগঞ্জে সংবাদকর্মীর কন্যাকে অপহরণ চেষ্টায় অভিযুক্তদের অবিলম্বে গ্রেফতারের দাবি ফরিদগঞ্জ প্রেসক্লাবসহ বিভিন্ন সংগঠনের
  •   লক্ষ্মীপুরে মাদকসহ বাবা ও দুই ছেলে আটক
  •   চাঁদপুর সদর মডেল থানা পুলিশের অভিযানে বিভিন্ন মামলার ৮ আসামী আটক
  •   ফরিদগঞ্জ পাকহানাদার মুক্ত দিবস পালন
  •   যৌথ অভিযানে কচুয়া থানার লুণ্ঠিত পিস্তলের ৮ রাউন্ড গুলি উদ্ধার

প্রকাশ : ২৪ জুন ২০২৩, ০০:০০

ঋণ
তৃপ্তি সাহা

বাণী প্রভা সাহা, আমার মাসি। ওর কথা আপনারা সবাই জানেন। সেই যে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে আমরা চাঁদপুর থেকে চৌমুহনীতে আশ্রয় নিলাম। যখন এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে ছুটছি নিরাপদ আশ্রয়ের জন্যে, তখন এই মাসির বাড়িতে আশ্রয়ের জন্যে মাইলের পর মাইল হেঁটে উপস্থিত হই। আমার মায়েরা তিন বোন। আমার মায়ের নাম দুলালী প্রভা সাহা, মাসির নাম বাণী প্রভা সাহা। ছোট বোন। বিয়ে হয় বেশ অল্প বয়সে। ১৯৭১ সালে পাকসেনারা চৌমুহনী বাজারে যেদিন আগুন লাগিয়ে দেয়, তারপর মাথার ওপর দিয়ে প্লেন উড়তে থাকে। আমরা বুঝি এ জায়গাও আমাদের জন্যে নিরাপদ নয়। রাজাকারদের নজরদারিতে আমরা। আরও নিরাপদ স্থান চাই। আরও নিরাপদ স্থানের প্রয়োজনে প্রায় ৮ থেকে ১০ মাইল হেঁটে দক্ষিণ নরোত্তমপুর মাসির শ্বশুর বাড়িতে যাই। আমাদের দলে ১০/১১ জন ছিলো। কিন্তু ঢুকেই বুঝি বাড়ির সবাই আমাদের আসাটাকে ভালো মনে মেনে নেয়নি। কারণ ছিলো ও বাড়ির ছেলেরা মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছে এবং এ খবরটি রাজাকারের মাধ্যমে পাকিস্তানি বাহিনীর কাছে পোঁছে গেছে। তারা এমনিতেই পাকিস্তানি বাহিনীর নজরদারিতে ছিলো। সবাই চিন্তিত, কখন কী হয়! এজন্যে আমাদের আসাটা ভালোভাবে নেয়নি কেউ। নিজের ভিটেমাটি কে সহজে ছেড়ে যায়? তারাও ছেড়ে যেতে চায় না। ফলে পরদিন ভোরবেলায় রিকশাযোগে সেখান থেকে অন্য গ্রামে দাদপুরে চলে যাই। মাইজদীর ৫ প্রায় কিলোমিটার পশ্চিমে। আমার দাদার বাড়ি।

পরবর্তীতে মাসির বাড়ি পাকিস্তানি সৈন্যরা অ্যাটাক করে। বাড়িতে যারা তখন পর্যন্ত ছিলো, তারা খবর পেয়ে আশপাশের বাগানে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নেয়। মাসিমেশোর পরিবারও নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নেয়। কিন্তু রাজাকারদের সেদিনের টার্গেট ছিলো মেশো। পাকিস্তানি সৈন্যরা মাসিরা যে বাগানে আশ্রয় নেয় সে বাগানের দিকে এগিয়ে যায়। মাসি টের পেয়ে মেশোকে নিয়ে সরে যেতে চেষ্টা করে। সেই সময় মাসি ছিলো প্রেগন্যান্ট। মাসি চটজলদি পাশেই একটি নোংরা ডোবায় নাক উঁচু করে রেখে শরীর ডুবিয়ে দেয়। কিন্তু মেশো অন্ধ মাকে নিয়ে হুট করে সরে যেতে পারেননি। মাকে নিয়ে মেশো লুকিয়ে যেতে সময় নিলো। ততক্ষণে রাজাকারসহ পাকিস্তানি সৈন্য বুকে গুলি করে মেশোকে হত্যা করলো। মেশো ছিলেন স্কুল শিক্ষক। একদিন যুদ্ধ শেষ হলো। মাসির কন্যাসন্তান জন্ম হলো। শ্বশুর বাড়িতে আর জায়গা হলো না।

১৯৭২ সাল। মাসি তার বাপের বাড়ি চৌমুহনীতে। কোলে তার কন্যাসন্তান। নাম রাখা হলো নিবেদিতা। জীবনের সবচেয়ে কঠিনতম সময় কাটাতে হচ্ছে। মেয়েটার জন্যে বাঁচতে হবে, মেয়েটাকে বাঁচাতে হবে। রুটিরুজির ব্যবস্থা করতে হবে। বাবার সংসারে অঢেল কিছু নেই। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ। সরকারের তৎকালীন কার্যক্রম মেয়েদের পুনর্বাসন কেন্দ্রে যোগ দিলো।

খবর এলো বঙ্গবন্ধু নোয়াখালীতে আসবেন। যারা যুদ্ধের সময় ক্ষতিগ্রস্ত, তাদেরকে টাকা, টিন, কাঠ দিবে। আমরা চাঁদপুর থেকে গেলাম। আমি খুব ছোট। যুদ্ধের সময় পথে হেঁটে হেঁটে, রাজাকারদের মুখোমুখি হয়ে অনেক অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি। তখন ভয়টা অতশতভাবে কাজ করতো না। বুঝতাম না। কিন্তু বঙ্গবন্ধু তো রক্তের সাথে মিশে গেছে। বাবাকে দেখেছি কখনো বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণ করতো শ্রদ্ধাভরে, কখনো একান্ত আবেগে, ভালোবাসা, বেদনায়, কখনো চোখের জলে। সুতরাং যুদ্ধ শেষে আমি যাবো বঙ্গবন্ধুকে দেখতে। কী যে আনন্দ! ভালো লাগা!

আমার ঠাকুরমা (দাদি) যুদ্ধে চোখ হারানো ছেলেকে অর্থাৎ আমার কাকাকে নিয়ে যাবে বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করতে যাবেন। কাকা সে সময় রাজশাহীতে থাকতেন। সরকারি প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক।

২২ জুন ১৯৭২ সাল। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আসবেন জেলা শহর মাইজদীতে। ইতিহাসের বরপুত্র বঙ্গবন্ধুর আসবেন। জেলা শহরের বর্তমান নাম শহীদ ভুলু স্টেডিয়ামে। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর এই প্রথম নোয়াখালীর মাটিতে। জনসভার প্রস্তুতি নিয়ে ধ্বংসস্তূপের উপর মহাআয়োজনের ধুম পড়ে যায়।

কয়েক দিন আগ থেকে জাতির পিতাকে বরণ করতে জেলাব্যাপী ব্যাপক প্রস্তুতি। বঙ্গবন্ধুকে একনজর দেখতে ও তাঁর বজ্রকণ্ঠের ভাষণ শুনতে জেলা শহরে ছুটে আসেন প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে হাজার হাজার মানুষ। অনেকেই দু-তিন দিন আগ থেকে আত্মীয়-স্বজন, পরিচিতজনদের বাসাবাড়ি ও আবাসিক হোটেলে উঠেন। চৌমুহনী থেকে মাইজদী বেশি দূর নয়।

আমি মাসির কাঁপা হাত একবার ধরছি। আরেকবার ঠাকুমার সুদৃঢ় হাত ধরছি। যে হাত বঙ্গবন্ধুর হাত স্পর্শ করে হ্যান্ডশেক করেছিলো। আমি জানি না সেদিন মাসি কে রাজশাহী মেয়ে তারা ব্যানার্জি কে শেখ মুজিবুর রহমান যেভাবে বলেছেন, তোদের চিন্তা কী? আমি তো আছি। সেভাবে বলেছেন কি না? মাসি অঝোরে কাঁদলেন। জীবনের সমস্ত জমা কান্না পিতার বুকেই কাঁদলো।

সেদিন মাসি বঙ্গবন্ধুর হাত থেকে টাকাসহ অন্যান্য অনুদান নিয়েছিলেন। তাঁর সনদ পেলাম মাসির মৃত্যুর পর।

বঙ্গবন্ধুর সিগ্নেচার করা সেই সার্টিফিকেট। শুনেছি পরবর্তীতে মাসিকে মাসিক ভাতাও দিতে চেয়েছে। মাসি নেয়নি। কারণ মাসি ততোদিনে পড়াশোনা করে অগ্রণী ব্যাংকে চাকুরি করছেন।

আমি সাক্ষী হয়ে রইলাম। আমার জন্ম ধন্য হলো বঙ্গবন্ধুকে দেখে। সামনাসামনি এই প্রথম, এই শেষ দেখা। যে চেহারার কথা কখনোই ভোলা যায় না, সে কণ্ঠস্বর আর ভোলা হলো না। মাসির কাছে অনেক ঋণ।

তৃপ্তি সাহা : লাইব্রেরি উন্নয়ন কর্মকর্তা, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর, ঢাকা।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়