প্রকাশ : ১৮ জুন ২০২৩, ০০:০০
রবীন্দ্রনাথের গান দিয়েই শুরু করি। আমার কণ্ঠ হতে গান কে নিলো নিলো ভুলায়ে--আর আমার এই গান ‘চাঁদপুর কণ্ঠ’ নিলো। সেজন্যে চাঁদপুর কণ্ঠ, চাঁদপুর কণ্ঠ পরিবারকে জানাই অনেক অনেক কৃতজ্ঞতা আর ভালোবাসা।
শুভ জন্মদিন ‘চাঁদপুর কণ্ঠ’। ত্রিশ বছরে পদার্পণ, ভরা যৌবন তোমার। তোমাকে একগুচ্ছ কদমফুলের শুভেচ্ছা। ১৯৯৪-এর ১৭ জুন থেকে টানা ত্রিশ বছর হেঁটেছো বীরদর্পে।
খুব ছোট বেলায় যখন নিজের দেশকে নিয়ে অনুচ্ছেদ, রচনা বা প্রবন্ধ পড়তামণ্ড-আমি আমার প্রিয় চাঁদপুরকে দেখতাম। আর ভাবতাম বই কখনো মিথ্যে বলে না। সত্যিই ভালো বই মিথ্যে বলে না। ভালো পত্রিকাও মিথ্যে লিখে না।
আমরা পড়তাম মৌসুমি বায়ুর দেশ বাংলাদেশ। আমাদের দেশ বদ্বীপ। নদী নালা খাল বিল জালের মত ছড়িয়ে আছে। ষড়ঋতুর দেশ বাংলাদেশ। একেক ঋতুতে একেক রুপ। পলি মাটির দেশ বাংলাদেশ। আমার প্রিয় চাঁদপুর একখণ্ড বাংলাদেশ। কারণ চাঁদপুরে এর সবক'টি উপাদানই ভরপুর। পদ্মা, মেঘনা, ডাকাতিয়া এই তিন নদীর মিলনস্থলে চাঁদপুর। বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম নদী বন্দর ও প্রসিদ্ধ ব্যবসা কেন্দ্র হিসেবে চাঁদপুর বন্দর এই উপমহাদেশের অত্যন্ত পরিচিত একটি সফল নাম। দেশের চতুর্মুখী যোগাযোগ ব্যবস্থার ধারক দেশের বিখ্যাত এ বন্দর এক সময় পূর্ব বাংলা-পশ্চিম বাংলা এবং সেভেন সিস্টার্স নামে খ্যাত ভারতবর্ষের বিস্তীর্ণ পাহাড়ী অঞ্চলের মধ্যে ব্যবসায়িক যোগসূত্র ও মেলবন্ধন তৈরি করে যাচ্ছিল। বহুকাল আগ থেকেই চাঁদপুরের রূপালি ইলিশ বিশ্বব্যাপী সমাদৃত। পাটের জন্যে বিখ্যাত ছিলো। ডাব্লিউ রহমান জুট মিল, আলকায়েদ জুটমিল। এ আমার চাঁদপুর। আমার চাঁদপুর যেমন প্রথম ভালো লাগা, তেমনি চাঁদপুরের ‘চাঁদপুর কণ্ঠ’ আমার প্রথম ভালোবাসা। পাঠক ফোরাম, শিক্ষাঙ্গন আমাকে আঁচল পেতে দিয়েছে।
জনাব ইকবাল বিন বাশার এই পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা। আমাদের শিক্ষা পরিবারের ইসলামের ইতিহাসের শিক্ষক বিলকিস ম্যাডামকে প্রথমে শিক্ষক হিসেবে পেয়েছি, তারপর কলিগ হিসেবে চাকরি করেছি চাঁদপুর সরকারি কলেজে। সে হিসেবে তো অবশ্যই, এছাড়া চাঁদপুরে এটিই সমাদৃত, জনপ্রিয় প্রথম সারির স্থানীয় পত্রিকা। ১৯৯৪-এর ১৭ জুন থেকে প্দ প্রথম ভোরের চায়ের কাপে ঝড় তুলেছে চাঁদপুর কন্ঠ। ফলে পত্রিকাটির প্রতি দুর্বলতা যেমন আছে ভালোবাসা অনেক বেশি আছে।
আমার সরকারি চাকুরির ২য় ধাপ পিটিআই, আলীগঞ্জ, হাজীগঞ্জ, চাঁদপুর। সেখানে ম্যাগাজিন বের হবে। আমি আগে থেকেই টুকটাক লেখা লিখি করি। পিটিআই, আমি ভাবলাম এখনে অনেক শিশুদের মায়েরা প্রশিক্ষণ নেয়। আমি মায়ের গর্ভকালীন অবস্থায় মায়েদের এবং শিশুর জন্যে কী রকম যত্ন নিতে হবে, করণীয়, বুকের দুধ কেন খাওয়াতে হবে সে বিষয়ে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলাম। কিন্তু হায়! ১৯৯৪-৯৫ তে এ ধরনের লিখা মানুষ নিতে পারতো না। মেয়েদের সবকিছুতেই রাখ রাখ ঢাক ঢাক। মায়েরা পর্যন্ত মেয়েদের পিরিয়ডের ব্যাপারে সচেতন করতে লজ্জা পেত। সত্যি বলতে আমি তখন নতুন মা হবো। আমার মধ্যে অন্য এক অনুভব। আমি শিশু লালন পালনের ওপর বই পড়ছি। আমি জানি আমাদের দেশের বেশিরভাগ মেয়েরা বাচ্চা লালন পালনের উপর কোনো ট্রেনিং পায় না, যত্ন হয় না। অথচ উন্নত বিশ্বে মা'য়ের জন্য কত ধরনের কাজ হয়। তখন ছুটি মাত্র তিন মাস। মেয়েদের দারুণ কষ্ট। চাকুরিজীবী মেয়েদের খুব করুণ অবস্থা।
যাই হোক, আমার সে লিখা ম্যাগাজিনে আর গেলো না। আমি চুপচাপ। ভাবছি, আর লিখবোই না। কিন্তু কথায় বলে স্বভাব না যায় মরলে কয়লার রঙ না যায় ধুইলে। আমি মাঝে মধ্যে ডায়েরি তে লিখি।
সেভাবেই রবীন্দ্র সংগীত প্রশিক্ষক, শিক্ষাগুরু ওয়াহিদুল হক চাঁদপুর সংগীত নিকেতনে প্রশিক্ষণ দিতে এলেন। আমি ৩য় নং সরকারি চাকুরিতে। অর্থাৎ চাঁদপুর সরকারি কলেজে। আমার বড়টি আদিত্য খুব ছোট। আমি ওকে পাঠিয়েছি প্রশিক্ষণে। অনেক গল্প হয়েছে আদিত্যর সাথে। আমি ওয়াহিদুল হক কে নিয়ে লিখলাম। সংগীত নিকেতনের অধ্যক্ষ স্বপন দাকে পড়ালাম। দাদা পড়ে খুব খুশি হলেন। বলেন, নিভা লিখা বন্ধ করিস্ না। পত্রিকায় আসার দরকার নেই, তুই লিখে যা।
চাঁদপুর সরকারি কলেজ। ছেলেমেয়েদের মাঝে আমি আমার কাজকে উপভোগ করছি। আনন্দে কাটছে দিন। ম্যাগাজিন বের হবে। বাংলা বিভাগে জসীমউদ্দিন স্যার। তিনি ম্যাগাজিনের দায়িত্বে। একদিন পরীক্ষার ডিউটি, একই রুমে। স্যার বললন, ম্যাগাজিন বের হবে। তখন শেষ সময়। আমি একদিন সময় নিলাম। লিখলাম, 'কী যে ভালো লাগছে আমার'। ম্যাগাজিনে ছাপা হলো।
তারপর চাঁদপুর কণ্ঠের সম্পাদক কাজী শাহাদাত সাহেব আমার লিখা পত্রিকায় ছেপে দিলেন। আমি জানি না। আমার কলেজের ছেলেমেয়েরা আগে পড়লো। পরে এসে আমাকে বলছে, ম্যাম লিখা এসেছে। দেখানোর পরে বিশ্বাস করলাম। সত্যিই তো আমাদের শ্রদ্ধেয় পীযূষ দা যেমন বলেন, ‘আমার একজন কাজী শাহাদাত ভাই আছেন’।
রবীন্দ্রনাথ গেয়ে উঠেন-যিনি সকল কাজের কাজী মোরা তাঁরি কাজের সঙ্গী।/যাঁর নানা রঙের রঙ্গ মোরা তাঁরি রসের রঙ্গী ॥/তাঁর বিপুল ছন্দে ছন্দে/মোরা যাই চলে আনন্দে।
সত্যিই শাহাদাত ছিলো বলেই আমি অনেক লিখা লিখেছি। মানুষ আমাকে লেখক হিসেবে জানলো। বই হলো। শুধু তাই নয়, কাজী শাহাদাত ছিলো বলেই অনেক ছাত্র-ছাত্রী লেখক, কবি, বিতার্কিক, সনাক, সাংবাদিকতা বিষয়ে নিজেদের প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে। এভাবে চাঁদপুর সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে এগিয়ে গেছে অনেকখানি।
আমার মত ঘরকুণো, ভয় পাওয়া মানুষকে ধমকিয়ে লেখক হিসেবে পরিচিতি দিয়েছে কাজী শাহাদাত । যদিও কাজী শাহাদাত আমার বন্ধু, আসলে সে আমার গার্জিয়ান।
২৯ বছর যাবৎ কাজী শাহাদাত পত্রিকাটির বিভিন্ন দায়িত্বে। সাড়ে ২৪ বছর সফলভাবে সুনামের সাথে প্রধান সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে চলেছে। পত্রিকার সাথে সাথে সামাজিক, সাংগঠনিক কাজও সমানভাবে করে যাচ্ছে। এই পরিবারের সাথে যারা জড়িত আছেন, তারা বেশির ভাগ নিজেকে চাঁদপুর কণ্ঠের সাথে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে রেখেছেন।
শেষে পত্রিকার জন্যে তথা চাঁদপুর কণ্ঠ পরিবারের জন্যে অনেক শুভ কামনা। ভালো থাকুক চাঁদপুর কণ্ঠ, ভালো থাকুক বাংলাদেশ।
তৃপ্তি সাহা : লাইব্রেরি উন্নয়ন কর্মকর্তা, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর, ঢাকা।