প্রকাশ : ২০ মে ২০২৩, ০০:০০
কাজ না থাকলে মানুষ খই ভাজলেও, আমি বাইক চালাই। না, তেলের জন্য আমাকে মোটেও ভাবতে হয় না। একটা সময় ছিল, তখন আমাদের বয়সী চ্যাংড়া পোলাপান হয়তো বাপকে ধরে-কয়ে একখানা বাইক কিনত। কিন্তু উড়াধুড়া বাইক চালাতে গিয়ে ফকির হয়ে শেষে পথে বসার জোগাড় হতো! বাপকে তেল দিয়ে ম্যালাদিন তেলের খরচা জোগাতে পেরেছে- এমন ইতিহাস খুব কম। আর, কারও যদি প্রেমিকা থাকে, তাহলে তো কথাই নেই। দুবেলা না খেয়ে তেল খরচা করে তাকে নিয়ে এখানে-সেখানে ঘুরে-টুরে, শেষে আপ্যায়ন করাতে গিয়ে দ্বিগুণ ফতুর হয়ে যেত।
আমার ক্ষেত্রে অবশ্য এর কোনোটাই হয়নি। না আমি বাইক চালাতে গিয়ে তেলের অভাবে খোদ বাইকখানাই পুরনো বাইকের দোকানে বিক্রি করে দিয়েছি। না আমার ডেটিং খরচ সামলাতে কারও কাছে হাত পাততে হয়েছে। বিষয়টা তাহলে এই বেলায় খোলাসা করেই বলি।
আমার বন্ধুবান্ধবরা যেখানে তাদের শ্রদ্ধেয় আব্বাজানের দরবারে বাইক কিনে দেওয়ার ফরিয়াদ তুলতে তুলতে মুখে ফেলা তুলে ফেলেছে, সেখানে আমার পিতৃদেব নিজে থেকেই বাইক কিনে দিতে উদ্যত হলেন।
‘চলো, তোমাকে বাইক কিনে দিই’। হাসি মুখে এই কথা বলে তিনি আমাকে বাইকের শোরুমে নিয়ে গেলেন। পছন্দসই একখানা বাইক কিনে, বাইকের চাবি আমার হাতে দেওয়ার আগে সেই হাসি প্রশস্ত করে বললেন, ‘দুটো শর্ত’। বাইকের পেতে আমি তখন মরিয়া। বাপ যদি আমাকে আমার গার্লফ্রেন্ড ছাড়ার শর্তও দেয়, আমি তাতেও রাজি! কিন্তু তিনি অতটা নিষ্ঠুর হলেন না। বললেন, ‘তেলের খরচা নিজেকেই জোগাতে হবে। আর মাসে মাসে বাইক কেনার টাকা কিস্তিতে পরিশোধ করতে হবে।’
‘কিন্তু বাইক তো কিস্তিতে নয়, নগদ টাকা দিয়ে কিনলেন!’ তাকে এই কথাটা বলতে গিয়ে ঢোক গিলতে হলো। তার আগেই মস্তিস্কে অনুধাবন করতে পারলাম- বাপজান আমাকে বাইক কিনে দিয়ে নিজেই লাভবান হতে চাইছেন! আমার ব্যবসায়ী বাবা ভালোই ব্যবসায়িক পলিসি জানেন!
বাইক চালিয়ে ফিরতে ফিরতে আব্বাজান বললেন, ‘বাইক তো ভালোই চালাও, পাঠাও না হটাও, কী জানি একটা বাইক সার্ভিস আছে না, কাল থেকে ওটাতে যুক্ত হয়ে যাও’। বাপ আমার বাইক চালানোর প্রশংসা করলেন, নাকি আমার ওপরে তার দ্বিতীয় ব্যবসায়িক পলিসি প্রয়োগ করলেন- এ নিয়ে কিছুটা দ্বিধায় পড়ে গেলাম।
২.
পরদিন থেকে আমি পাঠাও-এর নিয়মিত রাইডারের খাতায় নিজের নাম তুললাম। বাইক কিনলে কেউ বাইকার বন্ধুদের নিয়ে পাল্লা দিতে দিতে দূরে কোথাও যায়। আর আমি পাল্লা দিয়ে বেড়াই এই শহরের রাজপথে। অপরিচিত বাইকারদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নিয়মিত যাত্রী আনা-নেওয়া করি। আসলে, কথায় আছে না- টাকায় টাকা আনে। আমি টাকা খরচ করি বাইকের তেলের পেছনে, সেই টাকায় পকেট ফুলে ফেঁপে উঠতে লাগল। আমার এমন সুখের দিনে হঠাৎ করেই জ্যোতির হামলা।
‘এই, তুমি কই কই ঘুরে বেড়াও? নাগাল পাই না। টবিকে বাঁধার রশি দিয়ে বেঁধে রাখব কিন্তু!’
জ্যোতির কথা শুনে বার কয়েক ঢোক গিললাম। টবি ওদের বাসার কুকুর। তাকে বাঁধার রশি দিয়ে আমাকে বাঁধলে...
ইয়ে মানে...
কোনো ইয়ে-টিয়ে নাই। যত ইয়ে আছে আমার সঙ্গে। গত এক সপ্তাহ ধরে আমার কোনো খোঁজখবর নাওনি। আমিও দেখেছি, তুমি কতটা বাড়তে পারো। এখন থেকে প্রতিদিন আমার সঙ্গে দেখা করতে হবে। এটাই তোমার শাস্তি।
একই শহরে থাকলেও দু'জনের বাসার মধ্যকার দূরত্ব অনেক। আগে জ্যোতির এমন কথা শুনলে ভয় পেতাম। আসা-যাওয়া করতে করতেই তো পকেট খালি হয়ে যেত! কিন্তু এখন আমি মোটেও ভীত নই। এখন আমি পাঠাও রাইডার। ওদের ওখানে যেতে-আসতে দু-দুটো খ্যাপ মারা যাবে। তাতে ডেটিং খরচ হয়ে, বাড়তিও কিছু থাকবে।
৩.
কদিন ধরে এক তরুণীকে রাইড দিচ্ছি। সে প্রত্যহ জ্যোতিদের বাসার কিছুটা পর থেকে আমার বাইকে ওঠে। আমার বাসার কিছুটা কাছাকাছি এসে নেমে যায়। এমনিভাবে কয়েকটা দিন চলার পর বালিকার আচরণ অনেকটাই চেঞ্জ হয়ে গেল। নিজে থেকেই আমাকে ফোন দেয়। রাতভর কথা বলে। বালিকার নাম তিশা। ওদিকে আমি তো মনে মনে দারুণ উচ্ছ্বসিত। মনে হলো- এ শহরে যার বাইক আছে, সে ফকির নয়, অন্তত মেয়ে ভাগ্যের দিক দিয়ে তো বটেই! এমনও দিন গেছে, নির্দিষ্ট সময়ে ডেটিং স্পটে যেতে না পারায় জ্যোতি আমাকে কান ধরে ওঠ-বস পর্যন্ত করিয়েছে। অথচ এখন সে বাইকে ঘোরার জন্য অনেক আগেই এসে দাঁড়িয়ে থাকে!
তিশা আমার বাইকের নিয়মিত যাত্রী হয়ে গেছে। অন্য রাইডারদের পেলেও, সে তাদের ছেড়ে দেয়। দেরি হলেও আমার জন্য অপেক্ষা করে। একদিন কথায় কথায় জানলাম, সকালে সে পাঠাওতে চেপে ভার্সিটিতে যায়। ক্লাস শেষে আমার বাইকে করে বাসায় ফেরে। তিশার সঙ্গে সম্পর্কটা এমন পর্যায়ে পৌঁছল যে, জ্যোতির সঙ্গে সম্পর্ক না থাকলে তার সঙ্গেই কিছুমিছু হয়ে যেত! মেয়েরা প্রেমিক নামক সম্পত্তিতে ভাগ পছন্দ করে না, তাই জ্যোতিকে আমার প্রেমিকা হিসেবে রাখলেও, তিশাকে বাধ্য হয়েই গার্লফ্রেন্ড (মেয়েবন্ধু) কোটায় রেখে দিতে হলো। সেই সঙ্গে তিশার থেকে নির্ধারিত ফি নিতেও কেমন যেন দ্বিধায় ভুগতে শুরু করলাম। সেও দেখি ইদানীং পার্স থেকে টাকা বের করতে 'ইচ্ছে করেই' দেরি করে, যাতে আমি বলে ফেলি- থাক লাগবে না। বন্ধুর কাছ থেকে আবার কিসের ফি!
৪.
জ্যোতির সঙ্গে আনুষ্ঠানিক প্রেম, জ্যোতির সঙ্গে অনুষ্ঠানিক রোমাঞ্চ- ভালোই চলছিল। ভাবলাম, এভাবে যদি শহরে বিভিন্ন প্রান্তে ব্রাঞ্চ খোলা যায়, তাহলেও ব্যাপারটা খুব একটা খারাপ হয় না। নিজেকে দেখেই উপলব্ধি হলো- ডেটিং খরচ নিয়ে কোনো টেনশন না থাকলে, এ দেশের ছেলেরা এক ডজন প্রেমও নির্দ্বিধায় চালিয়ে যেতে পারত! তবে, আবার কিছুটা সমস্যাও আছে। সবাই (যাত্রীরা) যদি তিশার মতো হয়ে যায়, তখন তেলের টাকাই উঠবে না!
একদিন সকাল সকাল জ্যোতি ডেকে পাঠাল। ভাবলাম, ওদিকেই যখন যাচ্ছি, তিশাকে সঙ্গে করেই নিয়ে যাই। ওকে না জানিয়ে ওদের বাসার কাছাকাছি গিয়ে বাইক নিয়ে দাঁড়ালাম। একটু পরে তিশা গেট থেকে বাইরে বেরিয়ে এলো। আমাকে অবাক করে দিয়ে আধা ঘণ্টা ধরে ওর জন্য অপেক্ষমাণ (আমিও ততক্ষণ ধরেই দাঁড়িয়েছিলাম কি-না!) এক রাইডারের বাইকে চেপে বসল। কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে তার পিছু পিছু চললাম। বাইক চালক তিশাকে নিয়ে তার ভার্সিটির সামনে গিয়ে দাঁড়াল। আমাকে অবাক করে দিয়ে সে তিশার কাছ থেকে টাকা না নিয়ে উল্টো তিশার হাতেই কিছু টাকা ধরিয়ে দিল! তিশা ভার্সিটির গেটের ভেতরে ঢুকে পড়তেই এবার উল্টো পথ ধরল সে। আমি তাকে অনুসরণ করলাম। দেখি- সে আরও কিছুটা দূরত্বে গিয়ে একটি অফিসের ভেতরে ঢুকে পড়ল!
এবারে মনে হলো- হিংসা কেবল মেয়েদের একক সম্পত্তি নয়। আমরা, ছেলেরাও হিংসায় জ্বলে-পুড়ে ছারখার হয়ে যেতে পারি। টানা এক সপ্তাহ তিশাকে ফলো করলাম। সেই একই রাইডার। শেষমেশ কয়টা দিন রাইডার মহাশয়ের পিছে লেগে থাকলাম। সন্দেহ নয়, মনে দৃঢ় বিশ্বাস জন্মাল- বেচারা নির্ঘাত তিশার প্রেমিকপ্রবর হবে। সাতসকালে তিশাকে ভার্সিটিতে পৌঁছে দিয়ে যায় সে। তারপর সারাদিন অফিসের কাজে বাইক নিয়ে এখানে- সেখানে দৌড়াদৌড়ি করতে হয় বলে তিশাকে ক্লাস শেষে বাসায় ফেরার সময় অন্য বাইকে ট্রিপ নিতে হয়। ট্রিপ খরচ যে তিশার প্রেমিক মহাশয়ই দিয়ে থাকেন, তা আর নাইবা বললাম।
৫.
মেয়েটা কে? অগ্নিমূর্তি ধারণ করে জ্যোতি প্রশ্নটা করল। কোন মেয়ের কথা বলছ- তা বুঝতে পারলেও না বোঝার ভান ধরলাম।
কোন্ মেয়ে?
যাকে রোজ ভার্সিটি হতে বাড়ি পৌঁছে দাও!
বুঝলাম- জালে আটকা পড়ে গেছি। পুরোটা মিথ্যা বলতে গেলে ধরা খেয়ে যাব। তারচেয়ে বরং সত্যের মধ্যে কিছুটা মিথ্যা বলে দেখি- পাড় পাই কি-না!
আরে, আমার বাইকে তো অনেকেই ট্রিপ নেয়। এর মাঝে কেউ কেউ একটু নিয়মিতই।
কিন্তু, দেখে মনে হলো- মেয়েটির সঙ্গে তোমার একটু বেশিই ঘেঁষাঘেঁষি চলছে!
জ্যোতির কথা বুঝতে পারলাম- ও আমাকে অনেক দিন ধরেই ফলো করছে। বললাম, আরে নাহ! বাইক চালিয়ে টাকা পাই। কে বাইকে চড়ল তা খেয়াল করার জো আছে নাকি। টাকা পেলেই হলো। দেখনি- আমি কি কাউকে মাগনা ট্রিপ দিয়েছি? কেবল তুমি বলেই কোনো হিসাব নাই। তুমি আর অন্যরা কি এক হলো!
এবারে জ্যোতির মুখে হাসি ফুটে উঠল। বলল, এই শোনো, তুমি একটা ছোটখাটো চাকরি নাও। বাবাকে বলেছি। তিনি আমাদের বিয়েতে রাজি আছেন।
আমার মনেও খুশির রঙ ছড়াল। আজ আমি পাঠাও রাইডার বলে- বড়লোক শ্বশুরও তার মেয়েকে আমার সঙ্গে বিয়ে দিতে রাজি হয়েছেন!
একটু পরেই অবশ্য জ্যোতি আমার এই আনন্দে পানি ঢেলে দিল।
বিয়ের পরে তোমাকে আর ওসব ফালতু বাইক-টাইক চালাতে দেব না। বাবা বলেছেন, তিনি আমাদের একটা গাড়ি গিফট করবেন। ড্রাইভারও থাকবেন। পেছনের সিটে তুমি-আমি বসে প্রেম করব! অনেক মজা হবে, তাই না?
৬.
এর পরের ঘটনা খুবই মর্মান্তিক। এখন আর আমি পাঠাও রাইডার নই। আমার ব্যবসায়ী বাবা বাইকটিকে ভাড়া দিয়ে পয়সা কামাচ্ছেন।
অন্যদিকে বাইক নেই বলে এখন আর আমার পকেটে গরমগরম টাকাও আসে না। একটা চাকরি করি। মাস শেষে যা পাই, তার পুরোটাই তুলে দিতে হয় জ্যোতির হাতে। মাঝে মাঝে অবশ্য বাথরুমে গলা ছেড়ে গান গাই, ‘আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম...’
সন্দেহবাতিকরা এতক্ষণ আমার কাহিনি শুনে ধারণা করতে পারেন, গানের কলি বুঝি এমন হয়- ‘আগে কি সুন্দর (বাইক চালিয়ে) প্রেম করিতাম...।