প্রকাশ : ২০ মে ২০২৩, ০০:০০
ঠুনকো আবেগের সঙ্গে হিমুর সংস্রব নেই। আবেগী মানুষ হাসি আর কান্নাকে সস্তা বানিয়ে ফেলেছে। কারণে-অকারণে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়া বা সামান্য আঘাতে নয়নযুগলে অশ্রুর বন্যা বইয়ে দেয়া মানুষ আনন্দ ও কষ্ট দ্রুত ভুলে যায়। হিমু তা পারে না। তার জগতে কান্না-হাসি থাকতে নেই। তবে এই একটা দিনেই তার মন খারাপ হয়। আড়ালে লুকিয়ে কিছুক্ষণ কাঁদে। গায়ের হলুদ পাঞ্জাবিকে ফ্যাকাসে মনে হয়। পৃথিবীকে মনে হয় ধূসর। শুধু আকাশটাকেই আপন মনে হয়। হাঁটতে গিয়ে বারবার ওই বিশাল আকাশের দিকে তাকায়। চার বছর আগে ধরণীর সঙ্গে সম্পর্ক চুকিয়ে ওখানেই আসন গেড়েছেন তার স্রষ্টা হুমায়ূন আহমেদ!
হিমুর হাতে খোলা চিঠি। প্রাপকের স্থানে হুমায়ূন আহমেদের নাম লেখা। ঠিকানার জায়গা ফাঁকা। হিমু জানে না কোন ঠিকানায় পাঠালে চিঠি পৌঁছাবে জাদুকরের কাছে। যদি পৌঁছায়, চিঠিটা স্যারের পছন্দ হবে তো! নাকি হিমু-সত্তার বাইরে গিয়ে লেখার জন্য তিনি কষ্ট পাবেন? এপারে দুঃখণ্ডকষ্ট আছে, ওপারে এসব অনুভূতি আছে কি? হিমু জানে না। আকাশে ঘন মেঘের ইতস্তত ছোটাছুটি। যে কোনো মুহূর্তে বৃষ্টি নামবে অঝোর ধারায়। ঝাপসা চোখে চিঠির অক্ষরগুলোর দিকে দৃকপাত করে। সম্বোধনহীন চিঠিতে লেখাথ
‘চলে যাওয়া মানেই প্রস্থান নয়’- এ সত্য বোঝাতেই বুঝি না-ফেরার জগতে চলে গেলেন শ্রাবণের মন খারাপ করা ঘোর অমাবস্যায়! আপনার মতো জীবনকে উপভোগ করা, ভালোবাসতে পারার ক্ষমতা কজনের ছিল? সাহিত্যের নির্মল যে রসে আমাদের ভিজিয়েছেন তা অনন্য, অনবদ্য। কতজন নাওয়া-খাওয়া ভুলে গিয়ে আপনার সুরভিত লেখায় ডুব দিয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই। এ প্রজন্মের বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে পাঠকপ্রিয় লেখক হয়ে আছেন, থাকবেন আগামী প্রজন্মের মনের মুকুরে। আমার মতো মিসির আলি, বাকের ভাই, শুভ্ররা থাকতে আপনি কখনও বিস্মৃত হবেন না। বাস্তবতার বিভ্রম সৃষ্টিকারী এসব চরিত্রের মধ্যে পাঠক খুঁজে নেবে আপনাকে। অনাগত ‘চান্নি পসর রাইত’ কাঁদবে আপনার অন্তর্ধানের সঙ্গী হতে না পারার দুঃখে।
আপনার লেখার সম্মোহনীতে বুঁদ হয়ে আছে বাংলার অগণিত পাঠক। তারা আনন্দে হাসে, ব্যথায় কাতর হয়ে চোখের পানি ফেলে আপনার বই পড়ে, নাটক-চলচ্চিত্র দেখে। পাঠকেরা যা করতে চায়, অথচ পারে নাথ ঠিকরে পড়া জোছনায় রাস্তায় হাঁটা, ভিজে যাওয়া বৃষ্টিকে স্পর্শ করা, খুব সাধারণ একটি ছেলের অসম্ভব সুন্দর কোনো তরুণীকে পাশে পাওয়া, সহজ ধরনের পরিবার, সহমর্মী বাবা-মা, এক রকম চিন্তাহীন নির্বিকার ভাসাভাসা জীবনে স্বপ্ন নিয়ে খেলা করার চাপা ইচ্ছেগুলোর প্রতিফলন পাওয়া যায় অপনার উপন্যাস ও নাটকে। বহুমাত্রিক সৃষ্টিকর্ম দিয়ে যে ইন্দ্রজাল বুনেছেন, তা অনিঃশেষ। মেঘের ওপর বাড়ি কেন বানাবেন, ওপারের জগৎটা আপনার স্বপ্নের নুহাশপল্লীর চেয়ে কি কম সুন্দর? ‘নন্দিত নরকে’র স্রষ্টার জন্য কেন থাকবে না একটা ‘নন্দিত স্বর্গ’? মানুষকে ভালো রাখার কঠিনতম কাজটি করে গেছেন অবিশ্বাস্য সার্থকতায়। আপনার ভালো না থাকার কোনো কারণ নেই। বাদল দিনের প্রথম কদমটা আপনার জন্য ঠিকই তুলে রাখবে বাংলার প্রকৃতি। মন কাঁদলেই আকাশের সবচেয়ে উজ্জ্বল তারা হয়ে ফুটে উঠবেন স্নিগ্ধ আকাশে। অনন্ত নক্ষত্র বীথি কেবল আপনারই জন্য। পঞ্চমীর চাঁদ ডুবে গিয়েও আপনার জন্য ফিরে ফিরে আসবে জোছনার ফুল হয়ে। মাতাল হাওয়া কিংবা লিলুয়া বাতাস আপনাকে না নিয়ে বইবে না ভুল করেও। আপনি থাকবেন বাংলার অপরূপ প্রকৃতিতে, পাঠকের হৃদমাঝারে।
চিঠি পড়তে গিয়ে ভ্রমের মধ্যে চলে যায় হিমু। এটা মায়ার জগৎ। চাইলেই যে কারও সঙ্গে কথা বলা যায়। হিমু এ মুহূর্তে একজনকেই অনুভব করছে। কী আশ্চর্য! সে হুমায়ূন স্যারের কণ্ঠ শুনতে পাচ্ছে!
‘কী খবর হিমালয়? মন খারাপ নাকি?’
হিমুর চোখে অশ্রু। কণ্ঠ কাঁপা-কাঁপা, ‘স্যার, আপনি...!’
‘অবাক হলি কেন? তোর তো বিস্মিত হতে নেই। তোর কাছে সব স্বাভাবিক। ওসব কান্না-টান্নাও তোর জন্য না।’
এই একটা দিন... কাল থেকে দেখবেন, সব ঠিক।'
সময় ভালো না। আবেগকে একেবারেই প্রশ্রয় দিবি না। আত্মকেন্দ্রিক হওয়া চলবে না। মহামানবদের জন্য দুঃখণ্ডকষ্ট না।
‘স্যার কি আমার সঙ্গে একটু বৃষ্টিতে ভিজবেন? শ্রাবণের বৃষ্টি...!’
‘আজ না। মিসির আলি, শুভ্র মন খারাপ করে আছে। ওদের কাছে যাব। তুই বৃষ্টির মধ্যে হারিয়ে যা। কোনদিন দেখবি আমিও তোর সঙ্গে হাঁটছি!’
ঝুম বৃষ্টির মধ্যে খালি পায়ে হাঁটছে হিমু। এই বৃষ্টির একটা সুবিধা আছে। কান্না আড়াল করা যায়। এই বৃষ্টির নাম হওয়া উচিত 'কান্না লুকানো বৃষ্টি'! তার হাতে ধরা চিঠির অক্ষরগুলো বৃষ্টির জলে একটা অন্যটার সঙ্গে লেপ্টে যাচ্ছে। সবাই যেন একই পরিবারের! তার কেবলই মনে হচ্ছে, পেছন থেকে কেউ একজন সূক্ষ্মভাবে তার হাঁটা পর্যবেক্ষণ করছে। উথাল-পাথাল জোছনা গায়ে মাখতে শিখিয়েছেন। খুব ইচ্ছা করছে পেছনের মানুষটাকে একবার দেখার। কিন্তু সে তাকাচ্ছে না। বাস্তব কখনও কখনও বড় নির্মম হয়। পেছন ফিরে যদি সে কাঙ্ক্ষিত মানুষকে দেখতে না পায়!