প্রকাশ : ২৯ এপ্রিল ২০২৩, ০০:০০
শাহবাগ মোড়ে বাস থেকে নামতেই দেখি, রবীন্দ্রনাথ দাঁড়িয়ে আছেন! হাতটি বাড়িয়ে দিয়ে বললাম, ‘কেমন আছেন রবীদা?’
‘হ্যাঁ, আছি বেশ বেশ। হাতে হাত মিলালে তো আমি শেষ! তোমাকে তো চিনলাম না ভায়া, তোমার বাড়ি কোন দেশ?’
‘আপনি আমাকে চিনতে পারেননি! আমি সেই কবি। ওই যে, আপনি গত তিন বছর আগে লাইক দিয়েছিলেন আমার কবিতায়। মনে পড়ে দাদা?’
‘মনে পড়ে না সে কথা, তাই তো পাই হৃদয়ে ব্যথা।’
আমি বললাম, ‘টিএসসিতে গিয়ে চা পান করবেন?’
তিনি জানালেন, ‘টিএসসিতে নয়, বইমেলায় প্রবেশের পর যদি চা পান হয়, তবে কেমন হয়?’
আমিও মাথা নেড়ে সম্মতি দিলাম। মনে মনে ভাবতে লাগলাম, যেভাবে হোক রবীদাকে আমার বইয়ের স্টলে নিয়ে যাব। জোর করে একখানা বই ধরিয়ে দেব হাতে। তারপর ছবি তুলব। লজ্জায় পড়ে বেচারা আমার বই নিতে বাধ্য হবে। এ রকম কত মানুষকে বাধ্য করেছি!
এই তো ক’দিন আগেই এক বন্ধুর খালাতো বোনের ভাইয়ের শ্যালিকা এসেছে বইমেলায়। সঙ্গে অনেক মেয়ে। ভাবলাম, এই তো সুযোগ! এমন সুযোগ হাতছাড়া করা ঠিক হবে না। আমি এগিয়ে গিয়ে বললাম, ‘তোমার নাম তো জানি না। তুমি অমুকের অমুক হও না? একদিন কয়েক সেকেন্ড তোমার সঙ্গে কথা হয়েছিল। তোমার মনে নেই বোধহয়। আমার বই বেরিয়েছে। নিতে হবে না, হাত দিয়ে একটু নেড়ে দেখে যাও।’
তারা লজ্জায় পড়ে আমার স্টলে এসে বই হাতে নিয়ে দাম পরিশোধ করল। আমি কিছুক্ষণ অন্য দিকে তাকিয়ে ফোন এসেছে- এমন ভাব ধরে কথা বলতে থাকি। মূল্য পরিশোধ শেষ হয়েছে বুঝতে পেরে ওদের বললাম, ‘এই, তোমরা বই নিয়েছ কেন! আমি তো এমনি দেব। আচ্ছা, যেহেতু নিয়েছ এবার একজন একজন করে আমার পাশে বই হাতে নিয়ে দাঁড়াও। আমি অটোগ্রাফ মুডে কিছু ছবি তুলি।’
তারপর সেই দলবল এক এক করে আসে। আমি ছবি তুলি। সেই ছবি ফেসবুকে পোস্ট করি। আহা! কত কমেন্ট, কত লাইক! তারা বিরক্ত হলো, তাতে আমার কী! আমার তো বই বিক্রি হলো!
সে যাই হোক, বইমেলায় আমি আর রবীদা একসঙ্গে প্রবেশ করলাম। রবীদা বললেন, ‘বাংলা একাডেমির স্টলটা কোন পাশে?’
বললাম, ‘আমি চিনি। চলুন ওদিকে।’ বলে বাংলা একাডেমির স্টল খোঁজার ছলে রবীদাকে আমার স্টলে নিয়ে এলাম। এবার বাছাধন বই না কিনে যাবে কোথায়!
‘আরে এটা তো বাংলা একাডেমির স্টল না! তুমি কোন স্টলে নিয়ে এলে?’ রবীদা খানিকটা রেগে গেলেন।
বললাম, ‘দাদা, বাংলা একাডেমির স্টল তো সামনেই। আর এটা আমার বইয়ের স্টল। আপনি আমার বইটি একটু হাত দিয়ে নেড়ে দেখতে পারেন। আপনাকে টাকা দিতে হবে না, বইটি আমি আপনাকে গিফট করতে চাই।’
রবীদা মাথার চুল নাড়লেন। তারপর কোনো জবাব না দিয়ে বইটি প্যাকেট করতে বললেন। আমি বললাম, ‘বইটি আগে দেখুন দাদা।’
তিনি বললেন, ‘দেখতে হবে না।’ তারপর মানিব্যাগ বের করলেন। আমার বইটিও বেশ ঢাউশ আকৃতির। রাতে বালিশের সমস্যা হলে কাজে দেবে। মুখ কাচুমাচু করে বইটি নিলেন রবীদা। তিনি দাম পরিশোধ করতেই আমি খুশিতে আত্মহারা।
বললাম, ‘দাদা, আমি এবার একটি ফটোগ্রাফ নেব আপনার সঙ্গে। আমি অটোগ্রাফ দিচ্ছি, আপনি আমার লেখার দিকে মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়ে আছেন- এমন একটি ফটোগ্রাফ হলে খুব ভালো হয়।’
শুনে মুখ ভর্তি বিরক্তি নিয়ে তিনি বইটি হাতে নিলেন। এদিকে আরেক কাণ্ড! আমার পকেট থেকে ফোন বের করে দেখি চার্জ নেই! রবীদাকে অনুরোধ করে শেষে তার ফোনটিই নিলাম। একজনকে দাঁড় করিয়ে অনুরোধ করলাম, আমাদের একটা ছবি তুলে দিতে। রবীদা বললেন, ‘আমি বাংলা একাডেমির স্টলে যাব না। আমি ফিরে যাব।’
‘আরেক মিনিট দাদা, আপনার ফোনের ছবিগুলো আমার হোয়াটসঅ্যাপে দিচ্ছি। তারপর না হয় আপনি যান।’ রবীদা মুখ ভর্তি বিরক্তি নিয়ে বললেন, ‘তার চেয়ে আমার ফোনটাই রেখে দাও বাপু!’
আমি ছবিগুলো আমার ফোনে পার করে রবীদাকে তার ফোনটা ফেরত দিলাম। তিনি যতই বলুন, আমি তো আর তার ফোন নিতে পারি না। আমি তো অভদ্র না! ফোনটি ফেরত দিতেই ছোঁ মেরে সেটি নিয়ে চলে গেলেন রবীদা।
এদিকে আমি মনে মনে ভাবছি, রবীন্দ্রনাথ আমার বই কিনতে এসেছিলেন! ফেসবুকে পোস্ট দেব, কত লাইক পাব, কমেন্ট পাব। ভাবতেই আনন্দে ডিগবাজি দিতে ইচ্ছে করছে আমার। হঠাৎ বউ জোরে চিৎকার করে উঠল, ‘এবার দয়া করে ঘুম থেকে ওঠো। বাজারে গিয়ে আমাকে উদ্ধার করো! ঘরে এক হালি আলু ছাড়া আর কিছু নাই কিন্তু!’ আহা! এতক্ষণ তাহলে স্বপ্ন দেখছিলাম, ভাবতেই চোখে জল এসে গেল!