প্রকাশ : ০৮ এপ্রিল ২০২৩, ০০:০০
যখন বর্ণহীন অপরিচিত দোকানটায় প্রবেশ করলাম, তখন চারদিক ছিল ঝাপসা। অনেকটা শীতের সকালে পতিত ঘন কুয়াশার মতো। ডানদিক, বামদিক সবদিক। যেদিকেই তাকাই দূর্দৃষ্টিতে সবকিছুই কেমন যেন অস্পষ্ট লাগছিল। দোকানের ভেতরে কেন প্রবেশ করলাম তা মনে করতে পারছিলাম না। প্রবেশ করার পর দোকানের ভেতরে যে মুখগুলো প্রত্যক্ষ করলাম, তাদের কাউকেই আমি ঠিকভাবে চিনি না। এদিক-ওদিক তাকিয়ে ক্যাশকাউন্টার কিংবা দোকানদার, কাউকেই উপস্থিত বুদ্ধিতে বিবেচিত করতে পারিনি। নিজের দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে উপলব্ধি করলাম, অল্প সময়ের ব্যবধানে আমি, আমার অস্তিত্ব এবং বর্তমানে নিজেকে যেখানে আবিষ্কার করছি, তার প্রায় সবকিছুই অস্বাভাবিকভাবে বদলে গেছে। দোকানের মধ্যে থাকা পণ্যসামগ্রী চোখে পড়েনি, কেন পড়েনি তা বুঝতে চেষ্টা করেও যথেষ্ট বেগ পেতে হয়। তবুও বোঝা হয়ে ওঠেনি।
আমার অবস্থান ছেড়ে তার আশপাশে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম। নিজের চোখ থেকে শুরু করে সম্মুখের অল্প কিছু জিনিস বাদে বাকিসব দেখার ব্যর্থ চেষ্টা নিয়ম করে কেবল ঝাপসা অন্ধকারই উপহার দিচ্ছিল। এমন এক পরিস্থিতিতে বিরাজ করছিলাম যেন আমার দৃষ্টিশক্তি কেউ নিয়ন্ত্রণ করছে। কেউ হয়তো নির্দিষ্ট করে দিয়েছে, এই অপ্রস্তুত পরিবেশে আমি কী কী দেখব আর কী কী দেখবো না। কী কী আমার দেখা উচিত আর কী কী দেখা উচিত না। এরই মাঝে অপরিচিত এই দোকানের সামনে নিজের অনাকাঙ্ক্ষিত আগমন আমাকে ভাবিয়ে ভাবিয়ে অস্থির করে তুলছিল। কীসের দোকানে আসলাম, কেন আসলাম! এসব নিয়ে ভাবনার যেন বুঁদ হয়ে ব্যর্থ হচ্ছি। দোকানের সামনে প্রয়োজনহীন একটানা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ইতোমধ্যে সেখানে আগে থেকেই উপস্থিত এমন লোকজনের নজরে পড়ে যাই। সিগারেট হাতে দু-তিনজন লোককে দেখলাম। দেখে মনে হলো আমার প্রতি তাদের দৃষ্টি বেশ তীক্ষè!
চুরি করার পর চোর ধরতে পারলে খিটখিটে মেজাজের লোকেরা যেমন উদম পিটুনি দেয়ার ফুরসত খোঁজে, তাদের চোখ দেখে আমারও ঠিক তেমনই মনে হচ্ছিল। সবগুলো অপরিচিত মুখ। ঝাপসা দৃষ্টিময় চোখে তাদের কাউকেই আমি চিনতে পারিনি। জায়গাটার নাম কী, আমি এখানে কীভাবে এলাম, কেনো এলাম এসবের কোনো উত্তরই তৎক্ষণাৎ খুঁজে পাইনি। জায়গার নামণ্ডধাম নিয়ে দোকানে বসা লোকদেরকে জিজ্ঞেস করবো ভাবলাম কিন্তু যখন তাদের তীক্ষè দৃষ্টির কথা মনে পড়লো তখনই আবার নিজেই নিজের ভেতর চুপসে গেলাম। নিজের মন তাদের কাছে গিয়ে প্রশ্ন করার দুঃসাহস দেখাতে বাধা দিলো। হঠাৎ দোকানের বাইরে একটু দূর থেকে সমস্বরে কিছু আওয়াজ আমার কানে এসে বাজতে লাগলো, সম্ভবত মেয়েলি কণ্ঠস্বর! আমি বুঝতে পারছিলাম না সেগুলো কাদের কণ্ঠ। দোকান থেকে বেরিয়ে সহসা রাস্তার মাঝখানে এসে দাঁড়ালাম। হ্যাঁ এইতো, ওদিক থেকে আওয়াজ আসছে। আমি তখনো মাতালপ্রায়! একযোগে হেঁটে আসা কয়েকজন তরুণীকে উদ্ধার করলাম। দূর থেকে সেই ঝাপসা দৃষ্টিতে মনে হলো এদের কাউকেই আমি চিনি না। অথচ এদের কণ্ঠস্বর আমাকে দোকান থেকে টেনে রাস্তায় নিয়ে এলো। আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছিলাম কেন এলাম, কী উদ্দেশ্য নিয়ে এলাম! এমনিতেই আমি নিজেকে সজ্ঞানে আবিষ্কার করতে পারছি না, তার উপর আবার অচেনা জায়গা, ঝাপসা দৃষ্টি। একি হলো আমার! আমি কী মারা গেছি, নাকি কোমায় আছি? কখনো তো মদ ছুঁয়ে দেখিনি, তাহলে হঠাৎ করে এমন মাতাল হওয়া কারণ কী? স্থির হয়ে দূর থেকে ভেসে আসা কণ্ঠস্বরের সেই তরুণীদের দিকে তাকিয়ে রই। এমনই কিছুক্ষণ কেটে যায়। ঝাপসা মুখগুলো ততক্ষণে অনেকটাই নিকটে চলে আসে, তবে পুরোপুরিভাবে স্পষ্ট হয়নি। এমনই একযোগে তাকিয়ে থাকা অস্পষ্ট দৃষ্টির মাঝে হঠাৎ একটা মুখ চোখে পড়লো। মুখটা পুরোপুরি উন্মুক্ত নয়, কালো মাস্ক দেয়া। ঠোঁট আর নাক মাস্কের ভেতর, কেবল চোখগুলো দেখা যায়। প্রথমে চেনা চেনা অনুমান করলেও মুখটা আরেকটু সামনে আসতেই অনুমানের রূপ স্থায়ী হয়ে ধরা দিতে দেরি করলো না, ‘সুরভি’। এত অস্পষ্টতার মাঝেও ঐ একটা মাত্র মুখ! যেই মুখটা চিনতে আমার একটুও বিলম্ব হলো না। চোখ দেখেই বোঝা যাচ্ছিল, চেহারা আগের চেয়েও অধিক উজ্জ্বল হয়ে গেছে। প্রথমে একটু মোটা মোটা লাগছিল, কিন্তু পরক্ষণেই মনে পড়লো তার চাচাতো বোনের কথা। বেশকিছু দিন আগে যে কি-না বলেছিল, ‘আবির! কয়েকদিন পর মামা হবে!’ সুরভির চাচাতো বোনের সে কথার অর্থ বুঝতে অত একটা বেগ পেতে হয়নি। সে সময় মনে মনে কল্পনা করতে লাগলাম তার চেহারা, তার চোখজোড়া! আহ সে সময় সুরভিকে দেখতে কী সুন্দরই না লাগবে। নারীত্বের পূর্ণ স্বাদ পাবে ও! মা হবে। আহ, কী দারুণ ব্যাপার। তা-ই না! সেই ঘোরময় ঝাপসা দৃষ্টিতেও এই একটা চেহেরা এত স্পষ্ট দেখতে পেয়ে আমি অপলক তাকিয়ে থাকি কিয়ৎকাল। মির্চা এলিয়াদ যেমন মৈত্রেয়ীকে বলেছিল তাকে জীবনসঙ্গী হিসেবে না পেলেও অন্তত তিনবার দেখতে চান! সুরভিকে তৎক্ষণাৎ দেখে আমার সে কথাই মনে পড়লো। আমার মনে হলো, মির্চা এলিয়াদের সেই তিন ইচ্ছের প্রথমটার সাথে আমার ইচ্ছে প্রায় হুবহু মিলে যাচ্ছে! এই অপরিচিত জায়গায়, অপ্রস্তুত মগজ আর ক্লান্তির সমস্যা আভা ফেলে দিয়ে আমি কেবল প্রথম ইচ্ছে পূর্ণ হওয়ায় আনন্দ আত্মঅস্তিত্বে সঞ্চয় করতে লাগলাম। আমি যা অবলোকন করেছি সেটা মির্চা এলিয়াদ করতে পারেনি। সুতরাং প্রায়োগিক দিক দিয়ে এলিয়েদের চেয়ে নিজেকে একটু বড় মনে হতে লাগলো। হঠাৎ খেয়াল হলো আমার আর সুরভির পথমধ্যদংশে একটা গলি ছুটে গেছে। সুরভি ঠিক সেই পথেই বাঁক নিচ্ছে। আমি যে তাকে এতক্ষণ যাবৎ প্রত্যক্ষ করছি, তাকে নিয়ে ভাবছি, ভেতরে ভেতরে তার প্রতি দুর্বলতা অনুভব করছি, সেটা সে টের পাচ্ছে না। গলিপথে তার বাক্ দেখে আমি আর স্থির থাকতে পারলাম না। আস্তে আস্তে পা ফেলে আমিও নিজেকে এগিয়ে নিতে লাগলাম তার দিকে। হাঁটার মধ্যে একটা দুরন্তপনার সূচনা ঘটিয়ে গলি পথের দিকে এগোতে লাগলাম। কয়েক কদম হাঁটার পর মনে হলো, হেঁটে তার কাছে পৌঁছাতে পারবো না, মগজ যেনো পরামর্শ দিলো দৌড় দেয়ায়। খুব দ্রুত তার কাছাকাছি যাওয়ার অনুপ্রেরণায়, আমি প্রাণপণে দৌড়ানোর চেষ্টা করলাম, কিন্তু হায়! আমার পা চলছে, আমার দেহ অসাড় হয়ে আসছে, আমি টের পাচ্ছিলাম; মনে হলো কেউ আমায় টেনে ধরে রাখছে, আমি আমার শরীরের দিকে তাকালাম। আমার শরীর অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে, গলিপথ, পথের সীমানা, পেছনে ফেলে আসা দোকান, তীক্ষè দৃষ্টিসম্পন্ন মানুষ এবং যাবতীয় সব। সবকিছুই যেন আস্তে আস্তে পূর্বের চেয়েও অধিক ঝাপসা হতে লাগলো। আমি চিৎকার করতে লাগলাম। পাশের লোকজন, দোকান, মেয়েদের হাসিভরা কণ্ঠস্বর আর আশপাশের অস্পষ্টতা আমার কাছে মূল্যহীন মনে হলো। কেবল মূল্যবান মনে হলো সুরভিকে ভালো করে আরেকবার চাক্ষুষ দেখার প্রবল ইচ্ছে। আমি চিৎকারের পর চিৎকার করছি। আমাকে ছেড়ে দেয়ার জন্য, অদৃশ্য শক্তির কাছে নিবেদন করছি কিন্তু কেউ আমায় ছাড়ছে না, ছাড়াতে আসছে না। আমি অনুরোধ করেছি, আমার অস্তিত্ব টেনে ধরা ভ্রমকে। আমি অনুরোধ করছি আমার অদৃশ্য দেহের কারণকে। কিন্তু আমার চিৎকার আমার মুখের মধ্যেই বিলীন হয়ে যাচ্ছিলো। আমি ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছিলাম বারবার। অথচ ক্লান্ত হয়েও চিৎকার থামাচ্ছিলাম না। শেষে যখন আরেকটু জোর দিয়ে চিৎকার দিতে যাব। ঠিক তখনই আমি নিজেকে আবিষ্কার করলাম বিছানার উপর ক্লান্ত একপ্রাণ। আমি হাঁপাতে হাঁপাতে বিছানায় উঠে বসলাম। পাশের টেবিলে রাখা জগ থেকে ঢকঢক করে খানিকটা পানি খেয়ে নিলাম গ্লাস ছাড়াই। বুকের ভেতরে অবস্থিত হৃদপি-টা খুব দ্রুত উঠানামা করছিলো। ঘনঘন শ্বাসপ্রশ্বাস কার্যক্রম চলতে লাগলো। একটু একটু করে টের পাচ্ছিলাম চারদিকের শুনশান অন্ধকার, কপাল বেয়ে গড়িয়ে পরা ঘাম! গায়ে জড়িয়ে থাকা লেপটাও অনুভবের বাহিরে ছিল না। আর এতকিছুর মাঝে সবচেয়ে বেশি যে জিনিসটা অনুভব করলাম তা ছিল, সুরভিকে আরেকবার দেখতে চাওয়ার করুণ পিপাসার্ত চোখ।