প্রকাশ : ০৮ এপ্রিল ২০২৩, ০০:০০
অনিলাকে কখনো কাঁদতে দেখিনি। দুঃখণ্ডব্যথা গোপন করার আশ্চর্য ক্ষমতা নিয়ে জন্মেছে মেয়েটা।
একই বাসে করে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাই। ও যেখান থেকে ওঠে, তার আগেই বাসের সব সিট দখল হয়ে যায়। প্রায়ই ওকে দাঁড়িয়ে যেতে হয়। আজ একটা টিউটোরিয়াল। কাল রাতে আমাকে ফোন করে জায়গা রাখতে বলেছিল। সকালে মেসেজও দিয়েছিল। অথচ আমি দিব্যি ভুলে বসে আছি! দোতলা বাসের ওপরের তলায় হেডফোন কানে গুঁজে রোজকার মতো এফএম রেডিওতে আরজেদের বাংলিশ উপস্থাপনা আর ফাঁকতালে বেতাল গান শুনছি। চমৎকৃত হলাম অনিলার ধাক্কায়।
-তোকে না আমি সিট রাখতে বলেছিলাম?
-সরি, ভুলে গেছি রে! তুই তো জানিস, পারলে আমি নিজেকেই ভুলে যাই। তুই বরং আমার জায়গায় বোস। বাকি পথটুকু আমি দাঁড়িয়ে যাচ্ছি।
অনিলা কোনো কথা না বলে নিচে নেমে যায়। আমিও ওকে অনুসরণ করে নিচে নামি। সারা পথ অনর্গল কথা বলেও ওর মুখ থেকে টুঁ শব্দ বের করতে পারি না। ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করার আপাতত সহজ কোনো পথ নেই। অনিলার পরীক্ষা শেষ হওয়া পর্যন্ত তাই অপেক্ষা করি।
-খুব রেগেছিস আমার ওপর, না?
-রাগের কী আছে! আমাকে ভুলে যাওয়া তোর কাছে তো নতুন কিছু না। কত উপলক্ষই তো ভুলে গেলি!
-তুই রাগলে চেহারার তেমন কোনো পরিবর্তন ঘটে না। রাগের মাত্রা নির্ণয় করতে পারি না কোনোভাবেই।
-আমাকে তুই কী করতে বলছিস? তোর সামনে ভ্যা ভ্যা করে কাঁদব?
-তা অবশ্য মন্দ বলিসনি। মেয়েরা তো অকারণেও কাঁদে। মায়াকান্না, বোবাকান্না, চোরাকান্না- কত রকমের কান্না! অথচ তোকে কোনো কারণেই কাঁদতে দেখি না কেন?
-আমি কাঁদি তাই কি তুই চাস?
-তা না। কিন্তু এই যে তোকে এত কষ্ট দিই, বিব্রত করি। কখনো ভুল করেও তো কাঁদিস না!
-আমার কান্না তোকে দেখাতে হবে কেন?
-তার অর্থ তুই আড়ালে কাঁদিস?
-আমি কাঁদতে পারি না রে। কে জানে, হয়তো ভবিষ্যতের জন্য সব কান্না জমা করে রাখছি। বাকি জীবন কেঁদেই কাটাতে হবে।
-কী যা-তা বলিস!
-কান্না সবাইকে ছোঁয় না। দেখিস, তুইও কখনো কাঁদবি না।
২.
আজ অনিলার জন্মদিন। আগের দুবার খুব করে যেতে বলেছিল। শেষ মুহূর্তে এসে ভুলে গিয়েছিলাম। সে কারণেই এবার বোধ হয় আমাকে আর যাওয়ার কথা বলেনি। তবু আজ যাব। আমাকে দেখে অনিলা নিশ্চয় চমকে উঠবে! বিশেষ এ দিনটি মনে রাখার জন্য আমার ওপর জমা হওয়া অভিমানের মেঘ কিছুটা হলেও দূর হবে। ভাঁজ করা নতুন পাঞ্জাবিটা বের করি। সেটি গায়ে চড়িয়ে ওর পছন্দের চকলেট আর একটা কবিতার বই নিয়ে বাসে উঠি। মুঠোফোন হাতে নিয়ে শুভেচ্ছাবার্তা পাঠাতে গিয়েও রেখে দিই। কোনোভাবেই চমকটা নষ্ট করা যাবে না। নিজেকে যথাসম্ভব প্রস্তুত করে দরজার সামনে দাঁড়াই। খানিক বাদে অনিলা দরজা খোলে। আমাকে এ সময় প্রত্যাশা করেনি, তা ওর অবয়ব দেখেই বোঝা যায়। যেখানে আনন্দমাখা বিস্ময় উছলে উঠছে। ‘তুই...!’ -অনিলার কণ্ঠ ধরে আসে। চকলেটের প্যাকেট আর বইটা বাড়িয়ে শুভেচ্ছা জানাতেই ডুকরে কেঁদে ওঠে। ওকে থামাতে ইচ্ছা করে না। কারও কান্না যে এত সুন্দর হয়, আগে জানা ছিল না। খুব বলতে ইচ্ছা করে, ‘অনিলা, তুই কাঁদতেও পারিস! তোর কান্না এত মধুর কেন রে?’