প্রকাশ : ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০০:০০
১.
ফোন রিসিভ করতেই রাফিয়ার সিরিজ প্রশ্ন শুরু হয়ে যায়। ‘আজ কত পর্যন্ত গুনেছি, বলতে পারবে?’
‘না।’
‘আহা, একটু চেষ্টা করো না!’
‘আমার অনুমান ঠিক হয় না, তুমি জানো।’
‘তারপরও বলো।’
‘আমি বললে ভুল হবে, তার চেয়ে তুমিই বলো।’
‘মাত্র ২৮!’
ওর এ ব্যাপারটা বেশ অদ্ভুত। আমার সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছা হলেই মাইন্ড গেম খেলে। নিবিষ্ট মনে ১০০ থেকে কাউন্টডাউন শুরু করে। ১-এ পৌঁছানোর আগেই নাকি আমি ফোন করি! ঘটনার সত্য-মিথ্যা যাচাইয়ের চেষ্টা করিনি কখনো। তবে ফোন রিসিভ করেই যেভাবে কথা শুরু করে তাতে বোঝা যায়, আমি ফোন করব এটা ওর অনুমিতই ছিল।
২.
আমরা পাশাপাশি দুই শহরের বাসিন্দা ছিলাম। শহর দুটির দূরত্ব ২০ কিলোমিটারের মতো। যখন লুকিয়ে দেখা করতে যেতাম, এ পথটাই ২০০ কিলোমিটারের মতো লম্বা হয়ে যেত। রাফিয়াই সমাধান বাতলে দেয়। দুই শহরের মাঝামাঝি একটা নির্জন জায়গা আমাদের সাক্ষাতের স্থান হিসেবে নির্ধারণ করে।
‘একজন ২০০ কিলোমিটার পাড়ি দেওয়ার চেয়ে দুজনই ১০০ কিলোমিটার করে যাওয়া ভালো। কী বলো?’
‘এ প্রক্রিয়া কত দিন চলবে?’
‘আজীবন।’
‘মানে!’
‘বিয়ের পরও আমরা এমন একটা জায়গা বেছে নেব। আলাদা পথ ধরে সেখানে যাব। তারপর শুধুই গল্প। ঘরে ফেরার তাড়া থাকবে না। নিজেদের কথা শেষ হলে চুইয়ে পড়া চাঁদের আলো মাখব কিংবা জোনাক পোকার দলে ভিড়ে রাত পোহাব।’
আমাদের অপেক্ষার প্রহর দীর্ঘ হয় না। সম্পর্কের পথে যাদের বড় বাধা হয়ে দাঁড়ানোর কথা, সে পরিবারের সম্মতিতেই পরিণতির স্বপ্ন ছোঁয়ার আয়োজন শুরু হয়।
৩.
ঈদের দিন। কিছুদিন বাদেই আমাদের বিয়ে। এমন একটা সময়ে রাফিয়ার পাগলামি নতুন মাত্রা নিল।
‘আজ একটা মাইন্ড গেম খেলব। আমি যে রঙের শাড়ি পরব, তোমাকেও সে রঙের পাঞ্জাবি পরে আসতে হবে।’
‘আমি বুঝব কী করে তোমার শাড়ির রং কী?’
‘সেটাই তো খেলা!’
‘রং যদি না মেলে?’
‘বিয়ের পর আমাদের মতের মিল হবে না।’
ওর কথায় আমার ভেতরটা কেঁপে ওঠে। কী বলে এসব! এমন তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে সিরিয়াস রসিকতা কেউ করে!
রাফিয়ার দেওয়া মেরুন রঙের পাঞ্জাবিটা গায়ে চাপাই। অনিশ্চয়তা আর উদ্বেগ সঙ্গে নিয়ে বের হই। কিন্তু রাফিয়াকে সেদিন নির্জন খোলা প্রান্তরে নয়, হাসপাতালের শক্ত বিছানায় মানুষের কোলাহলের মধ্যে দেখতে হয়েছিল। সিঁড়ি দিয়ে তাড়াহুড়ো করে নামতে গিয়ে দুর্ঘটনা ঘটে। আঘাত মারাত্মক না হলেও চোখের জখম গুরুতর ছিল। সেটি ঘিরে আশঙ্কাটাই শেষ অবধি সত্যি হয়। দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে যখন ওর অন্ধকারের দিনযাপন শুরু হয়, তখন আমিও যেন নিজেকে ঘোর আঁধারে হারিয়ে ফেলেছি।
৪.
আজ আরেকটা ঈদের দিন। আমাদের দুজনের প্রিয় জায়গাতে একা বসে আছি। এমন বিবর্ণ ঈদ আগে আসেনি। রাফিয়া চিকিৎসা শেষে সদ্য দেশে ফিরেছে। চিকিৎসকেরা কোনো আশার বাণী শোনাতে পারেননি। ও ইচ্ছা করেই আমার সঙ্গে যোগাযোগ কমিয়ে দিয়েছে। এখন উল্টো আমিই ওর ফোনের অপেক্ষায় থাকি। মাইন্ড গেম খেলি। কাউন্টডাউন করি। কখনো মিলে যায়, কখনো মেলে না। মনে হয়, জীবনটাই নিজের সঙ্গে নিজের একটা মাইন্ড গেম!
হঠাৎ রিকশা থেকে কাউকে নামতে দেখে বুকের ভেতরটা দুলে ওঠে। রাফিয়াই তো! ও এমন স্বাভাবিকভাবে একা হেঁটে আসছে বিশ্বাস করতে পারছি না। আমি ছুটে যাই। ওর হাত ধরি।
‘তুমি দেখতে পাচ্ছ?’
‘তোমার কী মনে হয়?’
‘আমি ঠিক মেলাতে পারছি না।’
‘ইচ্ছা করেই ঈদের দিনটা বেছে নিলাম। এ কদিন অবশ্য তোমার কাছ থেকে লুকাতে কষ্ট হয়েছে। তবু এ দিনটার চেয়ে ভালো উপলক্ষ ছিল না।’
আমি কোনো কথা বলতে পারি না। আনন্দ কখনো এমন ভাষাহীন হয়! ‘জানতাম এ কষ্টের সময়ে তুমি নীল পাঞ্জাবি পরে আসবে’—রাফিয়ার কথায় খেয়াল হয় ওর শাড়ির রংও নীল। ‘সেই দুর্ঘটনার দিনে আমি তোমার দেওয়া মেরুন রঙের শাড়িটা পরেছিলাম। তুমি?’ তাই তো, আমার পরনেও ছিল মেরুন পাঞ্জাবি! কী অদ্ভুত! মাইন্ড গেমে দারুণ সফল এ মেয়েটার পাশে একটা জীবন কাটাতে হলে আমাকেও অনেক কিছুতে জিততে হবে। অসহায় আত্মসমর্পণ করা যাবে না কোনোভাবেই।