প্রকাশ : ১৮ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০
কর্মীর দক্ষতা উন্নয়নের মাধ্যমে রেমিটেন্স বৃদ্ধি : প্রয়োজন সুনির্দিষ্ট উদ্যোগ
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে প্রবাসী শ্রমিকদের অবদান অপরিসীম। বর্তমানে প্রায় এক কোটির বেশি বাংলাদেশি বিভিন্ন দেশে কর্মরত আছেন এবং তাদের পাঠানো রেমিটেন্স দেশের অর্থনীতির প্রধান চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করছে। এই রেমিটেন্সের পরিমাণ আরও বৃদ্ধি করা সম্ভব, যদি প্রবাসী এবং প্রবাসে যেতে আগ্রহী শ্রমিকদের দক্ষতা উন্নয়নের জন্যে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়, তাহলে তাদের কর্মসংস্থান ও আয় বৃদ্ধি পাবে। এ লক্ষ্যে 'বিশেষ ভোকেশনাল ট্রেনিং সেন্টার' প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা বিশেষভাবে বিবেচনা করা উচিত। এই সেন্টারগুলো হবে দুর্নীতিমুক্ত এবং আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন, যা প্রবাসী শ্রমিকদের দক্ষতা বাড়াতে সহায়তা করবে।
১. কারিগরি প্রশিক্ষণের প্রয়োজনীয়তা
আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে এবং আরও কার্যকর ভূমিকা রাখতে হলে প্রবাসী শ্রমিকদের কারিগরি দক্ষতা থাকা অপরিহার্য। কারিগরি প্রশিক্ষণ শুধুমাত্র তাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি করবে না, এটি তাদের আয়ের পরিমাণও উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়িয়ে তুলবে। উন্নত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মীরা সাধারণত উচ্চতর বেতন পান এবং চাকরির ক্ষেত্রে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়।
কারিগরি প্রশিক্ষণের সুবিধাসমূহ :
-উচ্চতর বেতন ও সুবিধা; দক্ষ শ্রমিকরা সাধারণত বেশি বেতন পান এবং তাদের কর্মস্থলে উন্নতির সুযোগও বেশি থাকে।
-চাকরির নিরাপত্তা : দক্ষ কর্মীদের জন্যে চাকরির সুযোগ এবং নিরাপত্তা দুটোই বেশি থাকে।
-ভিন্ন কর্মক্ষেত্রে স্থানান্তরের সুযোগ : একাধিক দক্ষতা অর্জন করার মাধ্যমে একজন শ্রমিক ভিন্ন কর্মক্ষেত্রে স্থানান্তরিত হতে পারেন।
-সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি : দক্ষতা অর্জনের মাধ্যমে প্রবাসী শ্রমিকদের সামাজিক মর্যাদা ও আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি পাবে।
২. অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কর্মক্ষেত্র
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে দক্ষ কর্মীর সংকট রয়েছে। বাংলাদেশি শ্রমিকরা যদি এইসব ক্ষেত্রে দক্ষতা অর্জন করেন, তবে তারা আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারে আরও ভালো অবস্থানে যেতে পারবেন।
কিছু উল্লেখযোগ্য কর্মক্ষেত্র হলো :
-স্বাস্থ্যসেবা (নার্স, ডাক্তার) : উন্নত বিশ্বে দক্ষ নার্স ও ডাক্তারদের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। সঠিক প্রশিক্ষণ এবং প্রয়োজনীয় ভাষার দক্ষতা অর্জনের মাধ্যমে এই খাতে বাংলাদেশি কর্মীরা বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারেন।
-প্রকৌশলী (ইঞ্জিনিয়ার) : নির্মাণ, মেকানিক্যাল, এবং ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং খাতে দক্ষ কর্মীদের চাহিদা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। উন্নত প্রশিক্ষণ এবং আন্তর্জাতিক মানের সনদ অর্জনের মাধ্যমে এই খাতেও বাংলাদেশিরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবেন।
-বাড়ি ও ব্যক্তিগত সেবা (গৃহকর্মী, বাবুর্চি, বিউটিশিয়ান, শিশু পরিচর্যা কর্মী) : গৃহকর্মী, বাবুর্চি, বিউটিশিয়ান, এবং শিশু পরিচর্যা কর্মী হিসেবে দক্ষ কর্মীদের চাহিদা উন্নত বিশ্বে বাড়ছে। বাংলাদেশি শ্রমিকরা এই কাজগুলোতে উন্নত প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে আরও ভালো বেতন ও দীর্ঘমেয়াদি কর্মসংস্থান পেতে পারেন।
-নিরাপত্তা (সিকিউরিটি গার্ড) : বিভিন্ন দেশে নিরাপত্তা কর্মীর চাহিদা রয়েছে। প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও ভাষাগত দক্ষতা অর্জনের মাধ্যমে বাংলাদেশি শ্রমিকরা এই খাতেও নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করতে পারেন।
-বাগান পরিচর্যা (গার্ডেনার) : মধ্যপ্রাচ্য এবং ইউরোপের অনেক দেশে দক্ষ বাগান পরিচর্যাকারীদের চাহিদা রয়েছে। উন্নত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এই খাতেও বাংলাদেশের শ্রমিকরা ভালো কাজের সুযোগ পেতে পারেন।
-বৃদ্ধাশ্রম এবং ব্যক্তিগত পরিচর্যা : চীনে বৃদ্ধাশ্রম এবং ব্যক্তিগত পরিচর্যার ক্ষেত্রে কর্মীর চাহিদা ক্রমাগত বাড়ছে। চীনের বৃদ্ধ মানুষের গড় আয়ু প্রায় ১০০ বছর, ফলে এই ধরনের কাজে নিয়োজিত হতে ন্যূনতম চাইনিজ ভাষা জানা থাকা জরুরি। ভাষাগত দক্ষতা অর্জনের মাধ্যমে বাংলাদেশি শ্রমিকরা চীনের বৃদ্ধাশ্রমে বা ব্যক্তিগত পরিচর্যার কাজে নিয়োজিত হয়ে উল্লেখযোগ্য আয় করতে পারেন।
অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্যে কর্মীর চাহিদা ক্রমাগত বাড়ছে। সেক্ষেত্রে আরবি ভাষার প্রতি ন্যূনতম দক্ষতা অর্জনের মাধ্যমে বাংলাদেশি কর্মীরা আরব দেশগুলোর বৃদ্ধাশ্রমে বা ব্যক্তিগত পরিচর্যার কাজে নিয়োজিত হয়ে উল্লেখযোগ্য আয় করতে সক্ষম হবেন।
৩. সরকারের দায়িত্ব ও কর্তব্য
এই উদ্যোগের সফল বাস্তবায়নে সরকারের দায়িত্ব অপরিসীম। সরকারের দায়িত্ব ও কর্তব্যগুলোকে নিম্নলিখিতভাবে শ্রেণীবদ্ধ করা যায় :
-দুর্নীতিমুক্ত প্রশিক্ষণ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা; প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলো দুর্নীতিমুক্ত রাখার জন্য সরকারকে কঠোর নজরদারি এবং নিরপেক্ষ প্রশাসন নিশ্চিত করতে হবে। নিয়মিত পরিদর্শনের মাধ্যমে কেন্দ্রগুলোর কার্যক্রমের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে।
-অবকাঠামো ও সরঞ্জাম প্রদান : উন্নত মানের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলো গড়ে তুলতে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো ও সরঞ্জাম প্রদান করতে হবে। প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলোতে আন্তর্জাতিক মানের যন্ত্রপাতি এবং প্রশিক্ষক নিশ্চিত করা জরুরি।
-তহবিল ও প্রণোদনা : সরকারকে এ উদ্যোগের জন্যে প্রয়োজনীয় তহবিল বরাদ্দ করতে হবে এবং বেসরকারি খাতের অংশীদারিত্বে বিনিয়োগের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। এছাড়া প্রশিক্ষণ গ্রহণকারী কর্মীদের জন্যে প্রণোদনা প্রদান করতে হবে, যাতে তারা প্রশিক্ষণ গ্রহণে আগ্রহী হয়।
৪. কর্মীদের ন্যূনতম যোগ্যতা ও ভাষাগত দক্ষতা
প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্যে কর্মীদের কিছু ন্যূনতম যোগ্যতা ও ভাষাগত দক্ষতা থাকা আবশ্যক।
-শিক্ষাগত যোগ্যতা : কর্মীদের ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকা প্রয়োজন, যা প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্যে সহায়ক হবে।
-ভাষাগত দক্ষতা : প্রাথমিক ভাষাগত দক্ষতা থাকা আবশ্যক। প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে নির্বাচিত ভাষার প্রাথমিক জ্ঞান থাকা কর্মীদের অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। এছাড়া ভাষার ওপর অভ্যন্তরীণ পরীক্ষার মাধ্যমে কর্মীদের দক্ষতা যাচাই করা হবে।
৫. রাষ্ট্রদূত ও দূতাবাসের শতভাগ প্রচেষ্টা
বাংলাদেশি দূতাবাস এবং রাষ্ট্রদূতদের এই উদ্যোগের বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে :
-আন্তর্জাতিক সম্পর্ক উন্নয়ন : দূতাবাসগুলোর মাধ্যমে বিভিন্ন দেশের সরকারের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে। এতে করে সংশ্লিষ্ট দেশে বাংলাদেশি কর্মীদের জন্যে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে।
-কর্মীদের সহায়তা ও সুরক্ষা : প্রবাসী কর্মীদের যে কোনো সমস্যায় দূতাবাস এবং রাষ্ট্রদূতদের সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালাতে হবে। কর্মীদের অধিকার সংরক্ষণ, সুরক্ষা, এবং অন্যান্য আইনি সহায়তা প্রদানের জন্য দূতাবাসকে নিরলস কাজ করতে হবে।
-স্থানীয় নিয়োগকর্তাদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন : স্থানীয় নিয়োগকর্তাদের সাথে সংযোগ স্থাপন করে বাংলাদেশি কর্মীদের জন্যে আরও সুযোগ তৈরি করতে হবে এবং এটি দূতাবাসগুলোর একটি প্রধান দায়িত্ব হিসেবে বিবেচিত হবে।
প্রবাসী শ্রমিকদের দক্ষতা উন্নয়নের মাধ্যমে রেমিটেন্স বৃদ্ধির এই উদ্যোগ বাংলাদেশের অর্থনীতিতে একটি বিপ্লব ঘটাতে পারে। এজন্যে সরকারের দায়িত্বশীলতা, কর্মীদের ন্যূনতম যোগ্যতা এবং দূতাবাসগুলোর সক্রিয় অংশগ্রহণ অত্যন্ত জরুরি।
সরকারের উচ্চ পর্যায়ে এই প্রস্তাবনাটি তুলে ধরলে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে সম্মিলিতভাবে এ উদ্যোগ বাস্তবায়নে এগিয়ে আসার আহ্বান জানাচ্ছি।
রহমান মৃধা : সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন।