রবিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২০ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   শনিবার চাঁদপুরে ৪ শতাধিক নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে ম্যারাথন প্রতিযোগিতা
  •   মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের পুত্রবধূ মাদকসহ যৌথ বাহিনীর হাতে আটক।
  •   মহাখালীতে ট্রেন থামিয়ে শিক্ষার্থীদের হামলা, শিশুসহ কয়েকজন রক্তাক্ত
  •   কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে শিক্ষক লাঞ্ছনা ও ভাংচুরের ঘটনা গৃদকালিন্দিয়া কলেজে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ॥ পাঠদান স্থগিত
  •   চট্টগ্রামে মধ্যরাতে ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিল থেকে অর্থদাতাসহ দুজন গ্রেপ্তার।

প্রকাশ : ০৪ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০

কোটা ও দুর্নীতি : স্বাধীনতার আলোকে আমাদের দায়িত্ব

রহমান মৃধা

অনলাইন ডেস্ক

আমি একজন যুদ্ধস্মৃতিধারী স্বাধীন বাংলার বর্তমান প্রবাসী বাংলাদেশী নাগরিক। কোটা নিয়ে কিছু বলার আগে আসুন কিছু তথ্য নতুন করে জানি।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পেছনে অসংখ্য বীর মুক্তিযোদ্ধার রক্ত, ত্যাগ ও সংগ্রাম রয়েছে। এ লেখাটি আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে রচিত, যেখানে আমি একজন সরাসরি যুদ্ধের সাক্ষী হিসেবে আমার অনুভূতি ও মতামত প্রকাশ করছি।

যুদ্ধের সময় আমি নিজ দেশেই ছিলাম শরণার্থী। দীর্ঘ নয় মাস কোথায় থেকেছি, কী খেয়েছি, বাঁচব কি মরব, এসব ভাবনা প্রতিনিয়ত তাড়িয়ে বেড়িয়েছে। বাবা এবং বড়ে তিন ভাইয়ের দেখা কি মিলবে? মা কি পারবেন এত বড় যুদ্ধে জয়ী হতে? আমি কি মুক্তিযুদ্ধের সেই খুদে সৈন্য হিসেবে গর্বের সঙ্গে স্বাধীন দেশের নাগরিক হতে পারব? সেই সময়কার প্রশ্নগুলো এখনো মনের গভীরে দাগ কেটে আছে।

যুদ্ধের পর সবাই একটি সুন্দর ও সমৃদ্ধশালী দেশ গড়ার স্বপ্ন দেখেছিল। আমরা অনেকেই সেই স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে কাজ করেছি। কিন্তু আমি মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট নিতে পারিনি রাষ্ট্রের কাছ থেকে। কেন জানেন? যারা রাষ্ট্র গড়ার শপথ নিয়েছিল, তারা কথা রাখেনি। আমার বাবা-মা আমার সত্যিকারের সার্টিফিকেট। তাদের হৃদয়ের সার্টিফিকেট নিয়েই চল্লিশ বছর আগে আমার সোনার বাংলাকে ছেড়েছিলাম নিজেকে, নিজের পরিবার এবং দেশকে গড়তে। কিন্তু যারা বার বার ক্ষমতায় এসে দেশ গড়ার শপথ নিয়েছে, তারা সেই শপথ পূর্ণ করেনি।

আজ ৫৩ বছর পেরিয়ে গেছে আমাদের স্বাধীনতার। ১৭ কোটি মানুষের এই দেশে, সেই মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেটধারীরা সব সুযোগ ভোগ করছে। তবে আমি কেন সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত? আমারও তো একটি পরিবার আছে। আমরা তো কোটার সাহায্যে প্রতিষ্ঠিত হইনি। দেশ স্বাধীন করা গৌরবের বিষয়, তার ঋণ কোটার মাধ্যমে শোধ হবার কথা নয়।

বঙ্গবন্ধু কন্যা নিশ্চয় বাবার পরিচয়ে প্রধানমন্ত্রীত্বের দায়িত্ব পালন করছেন না, করছেন নিজ যোগ্যতায়। তাহলে কেন কোটাকে এত গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে? আমরা তো সবাই বাঙালি এবং বাংলাদেশী, সবারই সমান অধিকার থাকার কথা। এত দেরি করা হচ্ছে কেন এই সত্যটি বুঝতে?

আমার পরিবার মুক্তিযোদ্ধা এবং শহীদ পরিবার। এতবছর বিদেশে থেকেও কোনোদিন কোটার সুযোগ নেওয়া হয়নি। মেধার জোরেই আমরা এগিয়ে গেছি। কৃষকের ছেলে এখন নিজ যোগ্যতায় এসপি, ডিসি হচ্ছে, কারণ মেধা দিয়েই তারা এগিয়ে যাচ্ছে। কোটা তো দান বা খয়রাত, এটা তখনই নিতে হবে যখন আর কোনো উপায় নেই যেমন পঙ্গু বা মৃত্যুশয্যায় অর্থের সংকট তখন এ ধরনের সুযোগ বা সাহায্য নেওয়া যেতে পারে, কিন্তু যারা দেশ স্বাধীন করেছে জীবন দিয়ে তারা এত নিচু মানের সুযোগ নেবে ভাবতেই গা শিউরে উঠে!

আজ পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধার পরিচয় ব্যবহার করে লেখাপড়া, চাকরি বা জীবনের কোনো ক্ষেত্রে কোনো ফায়দা নিইনি। নিজের পরিশ্রম আর যোগ্যতায় যা কিছু করেছি। মুক্তিযোদ্ধার সন্তানেরা কিংবা তাদের নাতি-নাতনীরা ফায়দা নেবে এটা ভেবে মুক্তিযোদ্ধারা দেশ স্বাধীন করেননি। তাই কোটাকে পুঁজি করে কিছু করার ইচ্ছা থেকে মুক্ত থাকুন।

শুধু মুক্তিযোদ্ধা কোটা নয়, সব ধরনের কোটা তুলে দেওয়া হোক। যোগ্যতা আর মেধার জয় হোক। কিন্তু আসলেই কি মেধার জয় হবে? যেখানে বিসিএসের প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়, সেখানে এত আন্দোলন নিছকই বোকামি। যতদিন না দেশ থেকে দুর্নীতি, কালোবাজারি বন্ধ না হবে, ততদিন প্রদীপের নিচে এভাবেই অন্ধকার থাকবে।

গত কয়েকদিন আগে স্পেনের ফুটবল এবং টেনিসের সাফল্য গোটা বিশ্ব সহ আমাদেরকে একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দিয়েছে, সেটা হলো দৃঢ়তা, কঠোর পরিশ্রম এবং জাতিগত ঐক্য কিভাবে একটি দেশকে শীর্ষে নিয়ে যেতে পারে। যখন স্পেন তাদের অর্জন নিয়ে উল্লাস করছে, তখন আমার জন্মভূমি বাংলাদেশ দুর্নীতির গভীরে নিমজ্জিত এবং কোটা নিয়ে ব্যস্ত। এটি আমার হৃদয়কে কষ্ট দিতেছে, কারণ আমি জানি আমাদেরও সেই সক্ষমতা আছে যা স্পেন দেখিয়েছে। আমাদের দেশের মানুষের মধ্যেও সেই অসম্ভব মেধা, কঠোর পরিশ্রম করার মানসিকতা এবং প্রতিভার অভাব নেই।

আমরা কি পারি না সেই দুর্নীতির বেড়াজাল ভেঙ্গে, কোটাকে সরিয়ে নতুন এক বাংলাদেশ গড়ে তুলতে? পারি, অবশ্যই পারি। স্পেনের উদাহরণ থেকে শিক্ষা নিয়ে, আমাদেরকেও সেই পথ অনুসরণ করতে হবে। প্রথমে আমাদের নিজেদেরকে পরিবর্তন করতে হবে। প্রত্যেকটি স্তরে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে এবং সৎ ও ন্যায়পরায়ণতার পথে চলতে হবে।

আমাদের নিজেদেরকে প্রশ্ন করতে হবে, আমরা কেন পেছনে পড়ে আছি? কারণ আমাদের মধ্যে ঐক্যের অভাব, সঠিক নেতৃত্বের অভাব এবং দুর্নীতির বিষবাষ্প আমাদের সমাজকে গ্রাস করেছে। কিন্তু এ অবস্থা থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ হলো ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা, শিক্ষা এবং নৈতিকতার পথে চলা।

আমাদের দেশের যুব সমাজের কাছে আমার আহ্বান : এসো আমরা একসঙ্গে হয়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করি। আমরা আমাদের প্রতিভা ও মেধা দিয়ে বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশের নাম উজ্জ্বল করি। স্পেন আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে যে, যদি ইচ্ছা থাকে, সঙ্কল্প থাকে, তবে কোনো কিছুই অসম্ভব নয়। আমরা যদি একতাবদ্ধ হতে পারি, সততা ও ন্যায়ের পথে চলতে পারি, তবে আমরাও একদিন স্পেনের মতো বিজয়ের পতাকা উড়াতে পারব।

স্পেনের একই দিনে টেনিস ও ফুটবলে জয়ী হওয়ার গৌরবময় সাফল্য আমাদেরকে অনুপ্রাণিত করুক। আমাদের বাংলাদেশেও আছে সেই সম্ভাবনা, শুধু প্রয়োজন দৃঢ় সংকল্প, একতাবদ্ধ প্রচেষ্টা এবং দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠনের। ইউরোপের ফুটবলের মাঠে যখন সবাই এক সঙ্গে গাইতে শুরু করল ‘উই আর দি চ্যাম্পিয়ন মাই ফ্রেন্ড’ তখন মনে পড়ে গেল হৃদয়ে বাংলাদেশের কথা।

আসুন, আমরা একতাবদ্ধ হয়ে বরং দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করি এবং একটি উন্নত, গর্বিত বাংলাদেশ গড়ে তুলি।

আমাদের এই বর্তমান সিস্টেম বদলাতে হবে। আমরা সবাই বাঙালি এবং বাংলাদেশী। পরিশেষে, জাতির সূর্য সন্তান একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বলতে চাই-কোটার পিছে সময় না দিয়ে দুর্নীতি দমনে সঙ্গবদ্ধ হোন, দেশকে ডিজিটাল করুন, ক্যাশ টাকা তুলে নিন, সঠিক শিক্ষায় শিক্ষিত হোন, নৈতিকতা এবং মানবতার ফেরিওয়ালা হোন, ইগো এবং স্বার্থপরতা ত্যাগ করুন। সব ধরনের কোটা পদ্ধতির সংস্কার হোক, মেধাবীদের মূল্যায়ন হোক। মানবতা এবং সততার জয় হোক, জয় হোক সকল বাংলাদেশীর।

রহমান মৃধা : সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়