প্রকাশ : ০৪ জুলাই ২০২৪, ০০:০০
হাউজ অব কমন্সের প্রবেশাধিকারী বাঙালির সংখ্যা বাড়ছে
আজ ৪ জুলাই ব্রিটেনে সাধারণ নির্বাচন হবে। এবার হাউজ অব কমন্সে প্রবেশের জন্যে লড়ছেন রেকর্ড সংখ্যক বাঙালি। তারা বিভিন্ন দল থেকে এ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। সংবাদপত্রের মাধ্যমে জানা যায়, ৩৩ জন বাঙালি প্রার্থী ব্রিটিশ এমপি হতে ভোট চাচ্ছেন। এর মধ্যে ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ থেকে ২ জন, স্কটিশ ন্যাশনাল পার্টি থেকে একজন, লিবডেম থেকে একজন, লেবার পার্টি থেকে ৮ জন, স্বতন্ত্র থেকে ৮ জন এবং বাকি ৫ জন ওয়ার্কার্স পার্টি অব ব্রিটেন, রিফর্ম ইউকে ও গ্রিন পার্টি থেকে নির্বাচন করছেন। এদিকে সান নিউজ আয়োজিত এক বিতর্কে যুক্তরাজ্যে অবৈধভাবে প্রবেশ করা অধিবাসীদের নিয়ে কথা বলার সময় বাংলাদেশকে উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরে লেবার পার্টির প্রধান কিয়ার স্টারমার বলেন, তিনি ক্ষমতায় আসলে এসব মানুষকে ফেরত পাঠাবেন দেশে। বিশেষ করে বাংলাদেশের মানুষ পড়ালেখা, ওয়ার্ক পারমিট, ভ্রমণ এবং ফ্যামিলি ভিসায় এদেশে আসেন। তারা অবৈধভাবে আসেন না। তাই তার এই বক্তব্যকে কেউ কেউ মনে করেন, একটি জাতিকে আঘাত করা হয়েছে। এজন্যে সাথে সাথে তার দলের এমপি রুশনারা আলী এবং আপসানা বেগমসহ অনেকে প্রতিবাদ করেন। পত্রিকায় ও এরকম শিরোনাম আসে বাংলাদেশী অভিবাসী নিয়ে লেবার নেতার কাণ্ডজ্ঞানহীন মন্তব্য। সব মিলিয়ে লেবার পার্টি বেকায়দায় পড়ে যায়। বাংলাদেশীদের মনে প্রশ্ন জাগে, এই দেশে অনেক জাতির মানুষ থাকা সত্ত্বেও তিনি কেন বাংলাদেশীদের কথা বললেন। এ কারণে রুশনারা আলী বলেন, তিনি ভুল করেছেন। আপসানা বেগম বলেন, আমি কোনদিন আমার দেশের মাইগ্রান্টের বিরুদ্ধে যাব না এবং এর তীব্র প্রতিবাদ করে যাব। এদিকে বিষয়টি কিয়ার স্টারমার যখন জানতে পারেন তখন অন্য একটি সাক্ষাৎকারে বিষয়টি পরিষ্কার করে বলেন, বাংলাদেশের সাথে তার দলের মজবুত সম্পর্ক রয়েছে। তিনি বলেন, আমি বাংলাদেশীদের মর্মাহত করতে চাইনি। আমরা কাজ করছি বাংলাদেশী কমিউনিটির সাথে। তিনি জানান, তার এ রকম কোনো ইচ্ছা নেই। তিনি আরো বলেন, এ কথার উদ্দেশ্য বাংলাদেশী ছিল না। অন্যান্য দেশের কথা বলেছেন, যারা অবৈধভাবে এ দেশে প্রবেশ করেছেন। এরপর থেকে আবার মানুষের সমর্থন লেবার পার্টির দিকে ফিরে আসছে। মূল ধারার রাজনীতিতে বাঙালিদের সম্পৃক্ততা তুলনামূলকভাবে কম বলা যায়। কিন্তু দিনদিন এই সংখ্যা বাড়ছে। অনুমান করা হয়, প্রায় ১০ লাখের কাছাকাছি বাংলাদেশি ব্রিটেনে বিভিন্ন কারণে বসবাস করছেন। আজ ৪ জুলাইর ব্রিটেনের সাধারণ নির্বাচনে এই বাঙালিদের কৌশলী হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন গুণীজনরা। এবার ৩৩ জন বাঙালি প্রার্থী লড়ছেন এই ভোটযুদ্ধে। তাদের মধ্যে লেবার পার্টি থেকে মনোনয়ন পেয়েছেন নুরুল হক আলী (গর্ডন এবং বুকান), রুমি চৌধুরী (উইথাম), রুফিয়া আশরাফ (দক্ষিণ নর্থহ্যাম্পটনশায়ার), নাজমুল হোসাইন (ব্রিগ এবং ইমিংহাম), রুশনারা আলী (বেথনাল গ্রিন অ্যান্ড বো), আপসানা বেগম (পপলার ও লাইমহাউস), ড. রূপা হক (ইলিং সেন্ট্রাল এবং অ্যাক্টন) এবং টিউলিপ রিজওয়ানা সিদ্দিক (হ্যাম্পস্টেড এবং হাইগেট)। লিবড্যাম থেকে মনোনয়ন পেয়েছেন রাবিনা খান (বেথনাল গ্রিন এবং স্টেপনি), তিনি রুশনারা আলীকে বেশ চ্যালেঞ্জে ফেলেছেন কেউ কেউ একথা বলছেন। একই আসন থেকে গাজা ইস্যুকে সামনে নিয়ে স্বতন্ত্র নির্বাচন করছেন আজমল মাসরুর (বেথনাল গ্রিন এবং স্টেপনি), ব্যারিস্টার শাম উদ্দিন (বেথনাল গ্রিন ও স্টেপনি) ও মোঃ সুমন আহমেদ (বেথনাল গ্রিন ও স্টেপনি )।
অন্যদিকে পপলার লাইম হাউসে বর্তমান লেবার এমপি আপসানা বেগমকে স্বতন্ত্র হিসেবে চ্যালেঞ্জ দিয়েছেন তাঁরই একসময়ের ঘনিষ্ঠজন এহতাশামুল হক। আপসানা বেগম বাঙালি ইস্যু নিয়ে সব সময় সরব থাকেন। দেখা যাক ভোটারের রায় কোন্ দিকে যায়। বর্তমান লেবার লিডার, সব জরিপে যিনি ভবিষ্যৎ ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী সেই স্যার কিয়ার স্টারমারকে চ্যালেঞ্জ দিয়েছেন, ব্রিটিশ বাংলাদেশি ওয়াইস ইসলাম (হলবর্ন এবং সেন্ট প্যানক্রাস)। এখানে গাজা ইস্যু নিয়ে কথা বলে ভোটারদের আস্থা অর্জনের চেষ্টা করছেন ওয়াইস ইসলাম।
ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টি থেকে মনোনয়ন পেয়েছেন আতিক রহমান (টটেনহ্যাম), সৈয়দ শামীম আহসান (ইলফোর্ড দক্ষিণ)। স্কটিশ ন্যাশনাল পার্টি (এসএনপি) থেকে মনোনয়ন পেয়েছেন নাজ আনিস-মিয়াহ (ডানফার্মলাইন এবং ডলার)।বাংলাদেশি অধ্যুষিত বো-স্ট্রাটফোর্ড আসনে ব্যারিস্টার ওমর ফারুক ও হালিমা খাতুন স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। এই দুই ব্রিটিশ বাংলাদেশি গাজা ইস্যু এবং হালিমা লেবার পার্টির বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তুলে ক্যাম্পেইন চালিয়েছেন। এছাড়া ইলফোর্ড সাউথ থেকে গ্রিন পার্টির মনোনয়ন পেয়েছেন সৈয়দ সিদ্দিকী। একই আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন নূরজাহান বেগম। একই আসনে জর্জ গ্যালওয়ের ওয়ার্কার্স পার্টি থেকে নির্বাচন করছেন গোলাম টিপু। একই পার্টি থেকে হ্যাকনি সাউথ শোরডিচে মোহাম্মদ শাহেদ হোসেন নির্বাচন করছেন। এছাড়া ওয়ার্কার্স পার্টি থেকে বেডফোর্ডে নির্বাচন করছেন প্রিন্স সাদিক চৌধুরী। এর আগে তিনি লেবার পার্টি থেকে নির্বাচন করেছিলেন ২০১৫ সালের নির্বাচনে। হঠাৎ করে নির্বাচনের ঘোষণা দিয়ে চরম রক্ষণশীল দল রিফর্ম ইউকে থেকে ইলফোর্ড সাউথ থেকে প্রার্থী হয়েছেন রাজ ফরহাদ। ওল্ডহাম ওয়েস্ট, চ্যাডারটন এবং রয়স্টন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন রাজা মিয়া, স্ট্রাটফোর্ড এবং বো থেকে নিজাম আলী (স্বতন্ত্র), বেক্সহিল এবং বেটল থেকে আবুল কালাম আজাদ (স্বতন্ত্র), ফয়সাল কবির (ওয়ার্কার্স পার্টি, আলট্রিনচাম এবং সেল ওয়েস্ট) থেকে, সৈয়দ সামসুজ্জামান (শামস) (গ্রীন পার্টি, ওল্ডহ্যাম ওয়েস্ট, চ্যাডারটন এবং রয়স্টন), মোহাম্মদ বিলাল (ওয়ার্কার্স পার্টি, ম্যানচেস্টার রুশোলমে), হাবিব রহমান (স্বতন্ত্র, নিউক্যাসল সেন্ট্রাল এন্ড ওয়েস্ট ) এবং মমতাজ খানম (সমাজবাদী, ফোকস্টোন)।
জানা যায়, বেশির ভাগ স্বতন্ত্র প্রার্থী নির্বাচন করছেন মূলত গাজা ইস্যুতে মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকাকে সমালোচনা করে। এতে বেশ চাপে আছেন চারবারের নির্বাচিত এমপি রুশনারা আলী। তিনি গাজায় যুদ্ধ বন্ধের ইস্যুতে পার্লামেন্টে ভোটদান থেকে বিরত থাকায় তার এলাকার ভোটাররা বেশ নাখোশ। লোকমুখে জানা যায়, এরই মধ্যে বিভিন্ন এলাকায় ক্যাম্পেইন করতে গিয়ে বাধার সম্মুখীন হয়েছেন তার সমর্থকরা। তার এক নির্বাচনী ক্যাম্পেইনে তিনি বলেন, ২০০০ সালে প্রথম ব্রিটিশ বাঙালি নির্বাচিত সাংসদ হিসেবে আমি গর্বিত। আমার সংসদীয় কর্মজীবনে আমি যুক্তরাজ্য ও বাংলাদেশের মধ্যে বন্ধন জোরদার করার জন্যে কাজ করেছি। আমি বাংলাদেশ সর্বদলীয় সংসদীয় গ্রুপের সভাপতিত্ব করেছি এবং বাংলাদেশের জন্যে যুক্তরাজ্যের বাণিজ্য দূত হিসেবে কাজ করেছি। এর ফলে আমাদের দুই দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক সম্পর্ক আরও গভীর করেছে।’ এখানে উল্লেখ্য যে, রুশনারা আলী ২০১৬ সাল থেকে ব্রিটিশ সরকারের বাংলাদেশ বিষয়ক বাণিজ্য দূত হিসেবে দায়িত্বরত। ‘ডিপার্টমেন্ট অব বিজনেস এন্ড ট্রেড’ এবং ‘ফরেন অফিস ও অন্যান্যকে নিয়ে বাংলাদেশের সাথে বাণিজ্য বাড়ানো, শ্রমিকদের জীবনমান উন্নতকরণে কাজ করেছেন। এভিয়েশনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সাথে একটি চুক্তি নিশ্চিত করেছেন, যার মূল্যমান হবে এক বিলিয়ন পাউন্ডের বেশি। এতে বাংলাদেশের মানুষের জন্যে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। এভিয়েশন সেক্টরে নতুন কাজের সুযোগ করে দেবে। এই সেক্টরটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ বৈশ্বিক উষ্ণায়ন প্রতিরোধে বাংলাদেশের উন্নত প্রযুক্তির প্রয়োজন রয়েছে। রুশনারা আলী আরো বলেন,’আমি ব্রিটিশ বাঙালিদের জন্যে অত্যন্ত গর্বিত, যারা ব্রিটিশ সমাজ, সংস্কৃতি এবং অর্থনীতিতে অবদান রেখেছেন। ব্যবসা থেকে রাজনীতি, খেলাধুলা, শিক্ষা এবং আরও অনেক ক্ষেত্রে বাঙালি অগ্রগামীরা রয়েছেন। লেবার পার্টির সাথে ব্রিটিশ বাঙালি সম্প্রদায় এবং বাংলাদেশের মধ্যে সম্পর্ক গভীরভাবে প্রোথিত। এটি ১৯৭১ সালের মতো যখন আমার পূর্বসূরি পিটার শোর সহ লেবার পার্টি বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকে সমর্থন করেছিল। ভবিষ্যতের শ্রমনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে ব্রিটিশ বাঙালিদের স্বার্থ ও উদ্বেগ নিশ্চিত করার জন্যে আমি সবসময় কাজ করব।' ফিলিস্তিনের ব্যাপারে তিনি বলেন, অক্টোবরের ২৭ তারিখে আমি আমার সহকর্মী কয়েকজন মিলে সিজ ফায়ারের দাবি জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছি। জাতিসংঘও এ ব্যাপারে আহ্বান জানিয়েছে। সাধারণ মানুষ যাতে ভুক্তভোগী না হয়, বিশেষ করে গাজায় যেভাবে হামলা করা হয়েছে, সেটি আমরা কোনোভাবেই সমর্থন করি না। সিজফায়ারের বিষয়ে পরবতীর্তে স্কটিশ ন্যাশনাল পার্টি (এসএনপি) পালার্মেন্টে একটি প্রস্তাব আনে। আমরা আমাদের দলের নীতি অনুযায়ী অন্য পার্টির প্রস্তাব সমর্থনও করিনি বা এর বিরুদ্ধেও যাইনি। আমরা বিরত থেকেছি। এর মানে হলো প্রস্তাবটিকে এগিয়ে যেতে দেয়া। আমাদের পলিসি হলো, আমাদের নিজস্ব প্রস্তাবকে এগিয়ে নেয়া। আমাদের প্রস্তাবে যুদ্ধবিরতি রয়েছে। কিন্তু এটা নিয়ে অনেকেই বলেছেন, আমরা সিজফায়ারে সমর্থন দিচ্ছি না। এটি একেবারেই সঠিক নয়। এছাড়া পার্লামেন্টে এসব প্রস্তাব আসার আগেই আমি আমার ওয়েবসাইটে এবং বিৃবতিতে যুদ্ধ বন্ধের দাবি জানিয়েছি। আমি আমার পার্লামেন্টারি জীবনের পুরোটাই ফিলিস্তিনিদের জন্যে ক্যাম্পেইন করেছি। আমার প্রথম বক্তব্য থেকে গাজার অবরুদ্ধ অবস্থার অবসান ঘটানোর জন্যে কথা বলে আসছি। আমি ২০১১ সালে দখলকৃত ফিলিস্তিনি এলাকাসহ অনেক স্থান সফর করেছি। ফিরে এসে পালার্মেন্টে ক্যাম্পেইন করেছি। আমাদের পার্টি ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতির বিষয়টি সমর্থন করছে।
জানা যায়, যুক্তরাজ্যের হাউস অফ কমন্সে সংখ্যালঘু জাতিগত পটভূমি থেকে আনুমানিক ৬৫ জন সংসদ সদস্য (এমপি) রয়েছেন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক এশিয়ান বংশোদ্ভূত। এই পরিসংখ্যানে লেবার এবং কনজারভেটিভ উভয় দলের এমপিরাই রয়েছেন।
দাদাভাই নওরোজি (১৮২৫-১৯১৭) : দাদাভাই নওরোজি ছিলেন প্রথম ভারতীয় যিনি যুক্তরাজ্যের সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন। তিনি ১৮৯২ সালে সেন্ট্রাল ফিনসবারি নির্বাচনী এলাকায় লিবারেল ডেমোক্রেট পার্টির প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হন। এই ধাবাহিকতায় যুক্তরাজ্যের রাজনীতিতে এশিয়ান এমপিদের প্রতিনিধিত্ব বিশেষভাবে কয়েক বছর ধরে বেড়েছে। এর মধ্যে ভারতীয়, পাকিস্তানি এবং বাংলাদেশি এমপিরা উল্লেখযোগ্য্য।
সব প্রধান রাজনৈতিক দল ইতোমধ্যে তাদের নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করেছে এবং ভোটারদের আকৃষ্ট করতে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করছেন। সোশ্যাল মিডিয়া, বিভিন্ন সামাজিক আচার অনুষ্ঠান এবং মসজিদ ভিত্তিক প্রচারণা চলছে।বিগত সাধারণ নির্বাচনে চারজন বাংলাদেশি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার মর্যাদা অর্জন করেছিলেন। যুক্তরাজ্যে ব্রিটিশ বাংলাদেশি জনসংখ্যার আকারের তুলনায় এই প্রতিনিধিত্বকে খুব বড় করে দেখতে অনেকেই নারাজ। প্রথম থেকেই বিভিন্ন সেক্টরে বাঙালিরা কাজ করে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে যাচ্ছেন। সেই তুলনায় বাঙালিরা তেমন সুযোগ-সুবিধা লাভ করতে পারছেন না।এজন্যে বাঙালিদের ঐক্যের বিকল্প নেই, সুশীলরা মনে করেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ১৯৭০ এবং ১৯৮০ এর দশকে যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশী সম্প্রদায়ের সংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে যুক্তরাজ্যের মূলধারার রাজনীতিতে ব্রিটিশ বাংলাদেশীদের প্রথম দিকের উল্লেখযোগ্য সম্পৃক্ততা শুরু হয়। এখন তারা অনেকটা সফল হয়েছেন। ব্রিটিশ বাংলাদেশীদের প্রথম উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক অগ্রগতি হয় স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে।
প্রথমে বেশ কিছু ব্রিটিশ বাংলাদেশি স্থানীয় কাউন্সিলে কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। বিশেষ করে পূর্ব লন্ডনের টাওয়ার হ্যামলেটের হল বাঙালিদের এলাকা। এখানকার প্রায় ৯৫ জন লোক সিলেটি। এই এলাকার রাজনীতিবিদরা তাদের সম্প্রদায়ের সমস্যা এবং সম্ভাবনা নিয়ে কাজ করেন। শিক্ষা এবং বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনে তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। যুক্তরাজ্যে প্রথম বাংলাদেশি ব্রিটিশ পার্লামেন্ট সদস্য (এমপি) হলেন রুশনারা আলী। তিনি ২০১০ সালের সাধারণ নির্বাচনে বেথনাল গ্রিন অ্যান্ড বো থেকে লেবার এমপি নির্বাচিত হয়ে ইতিহাস রচনা করেছিলেন। ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশের সিলেট জেলার বিশ্বনাথে জন্মগ্রহণকারী মিসেস আলী সাত বছর বয়সে তার পরিবারের সাথে যুক্তরাজ্যে চলে আসেন। তিনি পূর্ব লন্ডনের টাওয়ার হ্যামলেটস-এ বড়ো হয়েছেন।
রুশনারা আলীর সাফল্যের পর, অন্যান্য ব্রিটিশ বাংলাদেশীরাও ব্রিটিশ রাজনীতিতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছেন। হ্যাম্পস্টেড এবং কিলবার্নের লেবার এমপি হিসেবে ২০১৫ সালে নির্বাচিত হন বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ রেহানার মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিক। ৪১ বছর বয়সী টিউলিপকে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা লেবার পার্টির মধ্যে নতুন প্রজন্মের অন্যতম প্রতিশ্রুতিশীল রাজনীতিবিদ হিসেবে মূল্যায়ন করেন। টিউলিপ প্রথমবারের মতো লেবার পার্টির অনিরাপদ আসনে বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন। লেবার পার্টির ছায়া মন্ত্রিসভায় দুবার দায়িত্ব পালন করা টিউলিপ সিদ্দিক আজকের নির্বাচনে জয়ী হলে এবং তার নিজের দল লেবার পার্টি ক্ষমতায় এলে মন্ত্রিসভায় তার স্থান হবে বলে অনেকে মনে করছেন। একই বছর ইলিং সেন্ট্রাল এবং অ্যাক্টনের লেবার এমপি হিসেবে নির্বাচিত হন রূপা হক। ৫২ বছর বয়সি ব্রিটিশ বাংলাদেশি মেয়ে রাজনীতিতে আসার আগে লন্ডনের কিংস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞান পড়াতেন। কলামিস্ট ও লেখক সর্বশেষ কিংস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র লেকচারার হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
এছাড়া আফসানা বেগম ২০১৯ সালে পপলার ও লাইমহাউস আসনের এমপি নির্বাচিত হন। গত নির্বাচনে লেবার পার্টির প্রার্থী অপ্সনা প্রায় ২৯ হাজার ভোটে কনজারভেটিভ প্রার্থী শিউন ওককে পরাজিত করে এমপি নির্বাচিত হন। ৩৪ বছর বয়সী উদ্যমী ভদ্রমহিলা টাওয়ার হ্যামলেটসের শ্যাডওয়েলে জন্মগ্রহণ করেন এবং বেড়ে ওঠেন। তার বাবার বাড়ি বাংলাদেশের সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুরে। অপসানার বাবা মনির উদ্দিন টাওয়ার হ্যামলেটসের কাউন্সিলর ছিলেন।
এই এমপিদের বাইরে এখন ফয়সল হোসেন চৌধুরী এমবিই ২০২১ সালের মে থেকে লোথিয়ান অঞ্চলের স্কটিশ সংসদের (এমএসপি) সদস্য হন।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ব্রিটিশ বাংলাদেশি এই রাজনীতিবিদরা যুক্তরাজ্যের রাজনীতিতে তাদের কর্মকাণ্ড চালিয়ে বিশেষ স্হান দখল করে রয়েছেন। বলা যায়,, সংসদীয় কমিটি এবং ছায়া মন্ত্রিসভার ভূমিকা সহ বিভিন্ন পদে তাঁরা কাজ করছেন। এবার লেবার ক্ষমতায় গেলে হয়তো এমপি থেকে মন্ত্রীও পেতে পারেন বাঙালিরা
তাই এই নির্বাচন অনেক গুরুত্ব বহন করে বলে জ্ঞানীরা মনে করছেন। এবার লেবার পার্টি থেকে মনোনয়ন পেয়েছেন নুরুল হক আলী (গর্ডন এবং বুকান), রুমি চৌধুরী (উইথাম), রুফিয়া আশরাফ ( দক্ষিণ নর্থহ্যাম্পটনশায়ার), নাজমুল হোসাইন (ব্রিগ এবং ইমিংহাম), রুশনারা আলী (বেথনাল গ্রিন অ্যান্ড বো), আপসানা বেগম (পপলার ও লাইমহাউস), ড. রূপা হক (ইলিং সেন্ট্রাল এবং অ্যাক্টন) এবং টিউলিপ রিজওয়ানা সিদ্দিক (হ্যাম্পস্টেড এবং হাইগেট)। লিবড্যাম থেকে মনোনয়ন পেয়েছেন রাবিনা খান (বেথনাল গ্রিন এবং স্টেপনি)। তিনি ১২ বছর স্থানীয় কাউন্সিলর ছিলেন এবং হাউস অফ লর্ডসের একজন বিশেষ উপদেষ্টাও বটে। তিনি রুশনারা আলীকে বেশ চ্যালেঞ্জে ফেলেছেন বলে অনেকে মনে করছেন। একই আসন থেকে গাজা ইস্যুকে সামনে নিয়ে স্বতন্ত্র নির্বাচন করছেন আজমল মাসরুর (বেথনাল গ্রিন এবং স্টেপনি), ব্যারিস্টার শাম উদ্দিন (বেথনাল গ্রিন ও স্টেপনি) ও মো. সুমন আহমেদ (বেথনাল গ্রিন ও স্টেপনি )। অন্যদিকে পপলার লাইম হাউসে বর্তমান লেবার এমপি আপসানা বেগমকে স্বতন্ত্র হিসেবে চ্যালেঞ্জ দিয়েছেন তাঁরই একসময়ের ঘনিষ্ঠজন এহতাশামুল হক। এখন অপেক্ষার পালা। আজ ৪ জুলাই জানা যাবে ভোটারের রায়। লেবার লিডার, সব জরিপে যিনি ভবিষ্যৎ ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী সেই স্যার কিয়ার স্টারমারকে চ্যালেঞ্জ দিয়েছেন ব্রিটিশ বাংলাদেশি ওয়াইস ইসলাম (হলবর্ন এবং সেন্ট প্যানক্রাস)। এখানে গাজা ইস্যু নিয়ে কথা বলে ভোটারদের আস্থা অর্জনের চেষ্টা করছেন ওয়াইস ইসলাম।
ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টি থেকে মনোনয়ন পেয়েছেন আতিক রহমান (টটেনহ্যাম), সৈয়দ শামীম আহসান (ইলফোর্ড দক্ষিণ), (স্কটিশ ন্যাশনাল পার্টি (এসএনপি) থেকে মনোনয়ন পেয়েছেন নাজ আনিস-মিয়াহ (ডানফার্মলাইন এবং ডলার)।বাংলাদেশি অধ্যুষিত বো-স্ট্রাটফোর্ড আসনে ব্যারিস্টার ওমর ফারুক ও হালিমা খাতুন স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। এই দুই ব্রিটিশ বাংলাদেশি গাজা ইস্যু এবং হালিমা লেবার পার্টির বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তুলে ক্যাম্পেইন চালাচ্ছেন। এ ছাড়া ইলফোর্ড সাউথ থেকে গ্রিন পার্টির মনোনয়ন পেয়েছেন সৈয়দ সিদ্দিকী। একই আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন নূর জাহান বেগম। একই আসনে জর্জ গ্যালওয়ের ওয়ার্কার্স পার্টি থেকে নির্বাচন করছেন গোলাম টিপু। একই পার্টি থেকে হ্যাকনি সাউথ শোরডিচে মোহাম্মদ শাহেদ হোসেন নির্বাচন করছেন। এ ছাড়া ওয়ার্কার্স পার্টি থেকে বেডফোর্ডে নির্বাচন করছেন প্রিন্স সাদিক চৌধুরী। এর আগে তিনি লেবার পার্টি থেকে নির্বাচন করেছিলেন ২০১৫ সালের নির্বাচনে। হঠাৎ করে নির্বাচনের ঘোষণা দিয়ে চরম রক্ষণশীল দল রিফর্ম ইউকে থেকে ইলফোর্ড সাউথ থেকে প্রার্থী হয়েছেন রাজ ফরহাদ। ওল্ডহাম ওয়েস্ট, চ্যাডারটন এবং রয়স্টন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন রাজা মিয়া, স্ট্রাটফোর্ড এবং বো থেকে নিজাম আলী ( স্বতন্ত্র), বেক্সহিল এবং বেটল থেকে আবুল কালাম আজাদ ( স্বতন্ত্র), ফয়সাল কবির (ওয়ার্কার্স পার্টি, আলট্রিনচাম এবং সেল ওয়েস্ট) থেকে, সৈয়দ সামসুজ্জামান (শামস) (গ্রীন পার্টি, ওল্ডহ্যাম ওয়েস্ট, চ্যাডারটন এবং রয়স্টন), মোহাম্মদ বিলাল (ওয়ার্কার্স পার্টি, ম্যানচেস্টার রুশোলমে), হাবিব রহমান (স্বতন্ত্র, নিউক্যাসল সেন্ট্রাল এন্ড ওয়েস্ট ) এবং মমতাজ খানম (সমাজবাদী, ফোকস্টোন)।
গণমাধ্যমে সূত্রে জানা যায় ইউগভ নামের একটি সংস্থার জরিপে বলা হয়েছে, কিয়ার স্টামারের নেতৃত্বাধীন লেবার পার্টি হাউস অব কমন্সের ৬৫০ আসনের মধ্যে ৪২৫ আসন সহজেই পাওয়ার পথে রয়েছে। এটা লেবার পার্টির ইতিহাসে সর্বোচ্চ আসন পাওয়ার ঘটনা হতে পারে। সাভান্তার জরিপ অনুযায়ী, লেবার পার্টি ৫১৬ আসন পেতে পারে। মোর ইন কমনের জরিপে দেখা গেছে, লেবার পার্টি ৪০৬ আসন পেতে পারে। সাভান্তার জরিপ অনুযায়ী, এবারের নির্বাচনে কনজারভেটিভ পার্টি মাত্র ৫৩ আসন পাবে। অন্যদিকে লিবারেল ডেমোক্র্যাটসরা পাবে ৫০ আসন। ইউগভের জরিপ অনুযায়ী, কনজারভেটিভ পার্টি ১০৮টি আসন পেতে পারে আর লিবারেল ডেমোক্র্যাটসরা ৬৭টি আসন পেতে পারে। মোর ইন কমনের জরিপ অনুযায়ী, কনজারভেটিভ ১৫৫ ও লিবারেল ডেমোক্র্যাটসরা ৪৯ আসন পেতে পারে। জরিপের তথ্য অনুযায়ী, ১৪ বছর কনজারভেটিভ পার্টি সরকার থাকার পর যুক্তরাজ্যে এবার লেবার দল জয়ী হবে। কিন্তু কনজারভেটিভ পার্টির অবস্থা আগে যেমন ভাবা হচ্ছিল, জরিপ অনুযায়ী তাদের অবস্থা তার চেয়েও শোচনীয় হতে পারে। ইউগভ গত সপ্তাহের জরিপে কনজারভেটিভ পার্টি যত আসন পাবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছিল, তা এক সপ্তাহ পরেই আরও ৩২টি কমিয়ে দিয়েছে। সাভান্তা ও ইউগভের পূর্বাভাস যদি মিলে যায়, তবে উইনস্টন চার্চিল ও মার্গারেট থ্যাচারের দল ২০০ বছরের নির্বাচনী ইতিহাসে সবচেয়ে কমসংখ্যক আসন পাবে।যুক্তরাজ্যের গণমাধ্যম টেলিগ্রাফের পক্ষ থেকে সাভান্তা জরিপ প্রকাশ করা হয়। এ জরিপে বলা হয়, যুক্তরাজ্যের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক নর্দান ইংল্যান্ডে নিজের আসনেও হেরে যেতে পারেন। আসনটিকে একসময় কনজারভেটিভসদের জন্য নিরাপদ মনে করা হতো।এবারের নির্বাচনে ঋষি সুনাকের মন্ত্রিসভার বেশ কয়েকজন জ্যেষ্ঠ মন্ত্রীর হেরে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। এর মধ্যে অর্থমন্ত্রী জেরেমি হান্টও রয়েছেন।জনমত জরিপে নাইজেল ফারাজের নেতৃত্বাধীন ডানপন্থী দলের জনপ্রিয়তা বাড়তে দেখা গেলেও তাদের ব্যাপক আসন জেতার পূর্বাভাস দেওয়া হয়নি। ইউগভের জরিপে তাদের মাত্র ৫ আসন দেওয়া হয়েছে। তবে সাভান্তার জরিপে কোনো আসন দেওয়া হয়নি। অধিকাংশ জনমত জরিপে ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টির তুলনায় কিয়ার স্টামারের লেবারকে ২০ শতাংশ পয়েন্টে এগিয়ে রাখা হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ের অন্য জরিপেও সুনাকের করুণ চিত্রই তুলে ধরা হয়েছে। একটি জরিপে তো কনজারভেটিভ পার্টিকে নির্বাচনী ব্যবস্থা থেকে বিলুপ্তই করে দেওয়া হয়েছে। এসব কারণে এবারের নির্বাচন কী হবে এই কৌতূহলের শেষ নেই। বাঙালিদের জন্যে সবচেয়ে বড় আনন্দের বিষয় হবে যদি এই দেশে কোনো বাঙালি মন্ত্রী হওয়ার ইতিহাস গড়তে পারেন। আর যদি লেবার সরকার গঠন করে, তবে রুশনারা আলী এবং টিউলিপ সিদ্দিক মন্ত্রী হওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে--এটি রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণা। তাই বাঙালিরা বসে থাকলে হবে না। এই ভোট যুদ্ধে আমাদের এই বীর সন্তানদের পাশে দাঁড়াতে হবে। বড় দাবি আদায়ের জন্যে ছোট স্বার্থ ত্যাগ করাই ভালো বলে গুণীজন মনে করেন।
ড. আজিজুল আম্বিয়া : কলাম লেখক ও গবেষক, লন্ডন।