প্রকাশ : ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
স্বপ্নই রয়ে গেল বাবাকে দেখার স্বপ্ন!
(বাবাহীন সন্তানের আর্তনাদ)
বাবা শব্দটি অনেক ছোট্ট হলেও এর ব্যাপকতা বিশাল। অপরিমাপযোগ্য। বাবা মানেই এমন এক ব্যক্তি, যিনি বিভিন্ন চাপ সামলিয়ে সন্তানদের আগলে রাখেন ভালোবাসায়। তার ভালোবাসাটা কিছুটা সুপ্ত। কিন্তু অনেক গভীর। সন্তানের সাথে পিতা-মাতার সম্পর্কের কোনো স্বার্থ লুক্কায়িত থাকে না।
বাবাহীন একজন ছেলের জীবন যে কতোটা বিয়োগান্তক হয়, তা হয়তো যাদের বাবা বেঁচে আছেন তারা কখনোই বুঝতে পারবে না। প্রতিটি মুহূর্তে মনে হয় সত্যি আমি বড়োই একা। একটু ভালোবাসা দেওয়ার, সান্ত¡না দিয়ে সামনে চলার প্রেরণা জোগানোর মানুষটি আজ বেঁচে নেই। বাবাকে ছাড়া বাঁচতে পারবো এটা কখনো কল্পনা করিনি। কিন্তু বাস্তবতা বড়ই কঠিন।
আমার বাবা মোঃ আলমাস আলী গত ২৯ মে ২০২১ শনিবার দুপুরে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে কাঁদিয়ে গেলেন আমাদের (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। এই পৃথিবীর কত ব্যস্ততা, অথচ বাবাকে প্রাণভরে বাবা বলে ডাকতে না পারার এতোটা দিন কতোটা নিঃস্ব হয়ে যাওয়া; এ কেবল জানে বাবাহীন সন্তানেরা। বুকের ভেতর হাহাকার করে কেঁদে ওঠা প্রতিটা স্পন্দন জানে বাবা ছাড়া পৃথিবী কতোটা কঠিন, যন্ত্রণার, হাহাকারের, অসহায়ত্বের।
একেকটা দিন বড়ো একা লাগে। অনুভব করি--বাবার স্পর্শটুকু, বাবার সেই মায়াভরা ডাক অথবা মাথায় হাত ভুলিয়ে দেয়া। বাবা থাকতে ভাবতাম, বাবা যদি না থাকেন, তবে আমি কীভাবে থাকবো! কেটে যাচ্ছে একেকটি দিন, মাস আর বছরের পর বছর–বাবা নেই, আছে বাবার অনেক স্মৃতি, অনেক কথা, যা ভুলতে পারি না, ভোলা যায় না।
আমার দেখা সাধারণ্যে অসাধারণ মানুষদের একজন আমার বাবা। সহজ-সরল অনাড়ম্বর জীবনযাপন করা সৎ ও কর্মনিষ্ঠ এই মানুষটি আমার জীবনের আদর্শ। বর্তমান পৃথিবীতে যখন এতো কষ্ট, রোগ ও শোক, তখনও বাবা আমার এগিয়ে যাওয়ায় অব্যক্ত শক্তি।
আমার বাবা আমার কাছে বিশেষ এক আবেগ, ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, গর্ব। সেই গৌরব হারানোর বেদনা পৃথিবীর কোনো কিছুর বিনিময়েই প্রশমিত হবার নয়। এ এক অবর্ণণীয় শূন্যতা, যা কেবল মিশে আছে হৃদয়ের রক্তক্ষরণে। বাবা সশরীরে বেঁচে নেই, তবু বেঁচে আছেন আমাদের মাঝে প্রতি মুহূর্তে। আমাদের ভালোর জন্যে বাবা জীবনের প্রায় সবকিছুই নির্দ্বিধায় ত্যাগ করেছেন। কখনো নিজেকে ভালো রাখার চিন্তা করেন নি। বাবার চোখেই আমরা দেখেছি এই পৃথিবীর রূপ, রং ও আলোর দর্শন। বাবা শাশ্বত, চির আপন, চিরন্তন।
আমার জীবনে যদি বলি প্রাপ্তি, তবে তা হলো--বাবা আমাদের মাঝে সততার বীজ বুনে দিয়েছিলেন। শিখিয়েছিলেন সততার চেয়ে নেই কিছু মহান এই পৃথিবীতে। বাবাই আমাদের শিখিয়েছেন কীভাবে মাথা উঁচু করে পৃথিবীতে টিকে থাকতে হয়।
২০২১ সালের মে মাসের শুরুতেই কোভিড-১৯ মহামারীর করোনাকালে আমার বাবা মরণব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। তখন পুরো স্পেনে করোনার মহামারী রূপ। আমরা হোম কোয়ারেন্টিন থেকে প্রতিদিন ভিডিও কলে কথা বলাই ছিল একমাত্র ভরসা। যখন ভিডিও কলে বাবার সাথে কথা হতো, তখন বাবা একটি কথাই বলতেন, বাবা তুমি দেশে আসো আমি তোমাকে দেখবো। আমিও বাবাকে দেখার জন্যে আকুল হয়ে উঠেছিলাম।
যখন মরণব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে বাবার শরীরের একটা অংশ কিছুটা অবশ হয়ে গেলো, তখন হাঁটতে অসমর্থ হলেন। বাবাকে তখন আমার ভাই-বোনেরা মিলে আবার হাঁটতে শেখাতে লাগলো বাচ্চাদের মত। ঠিক যেমন বাবা আমাদের শিখিয়েছিলেন। আসলে এর পর থেকেই বাবা হয়ে গেলেন আমাদের সন্তানের মত। বাবাকে মুখে তুলে খাওয়নো এবং গোসল করিয়ে দিতো আমার ভাই-বোনেরা। আমি প্রতিনিয়ত এসব দৃশ্য দেখতাম ভিডিও কলে। আমারও ইচ্ছা জাগতো-- আমিও বাবাকে মুখে তুলে খাওয়াবো, গোসল করিয়ে দিবো, হাঁটাবো এবং বাবাকে আলিঙ্গন করে বাবার গায়ের ঘ্রাণ নিজের শরীরে মেখে নিবো। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, আমার ভাগ্যে তা জোটেনি। তখন প্রচণ্ড উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় কেটেছিলো প্রতিটা সেকেন্ড প্রতিটা মিনিট। বাবার কী হবে? বাবা সুস্থ হয়ে উঠবেন তো? বেঁচে থাকলে সুস্থ হবেন তো আগের মতো? করোনা পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলে দেশে যাবো এবং বাবাকে সুস্থ করে তুলবো। আমি তখনও আশাবাদী, কারণ আল্লাহ সব পারেন। কিন্তু সেই স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে গেলো। ২০২১ সালের ২৯ মে শনিবার বাবা না-ফেরার দেশে চলে গেছেন। প্রায় তিন বছর হতে চললো, বাবার আদর এবং শাসন কোনোটিই পাইনি। এই অভাববোধ আমার জীবনে রয়েই যাবে।
বাবার মৃত্যুর পর অনেক কিছুই পাল্টে গেছে। আমি দেশে গিয়ে বাবার কবর জিয়ারত করে আসলাম। বাবা যদি জানতেন তাঁর ছেলে দেশে আসছে তিনি কতোই না খুশি হতেন ! হয়তো খুশিতে আমাকে একবার জড়িয়ে ধরতে চাইতেন! যদিও এটা আর কখনো সম্ভব হবে না। তবে আমি আজও বাবার স্মৃতিগুলো আঁকড়ে ধরে বেঁচে আছি। বাকি জীবনের জন্যে খুঁজে পাচ্ছি আত্মবিশ্বাস।
মনে অনাবিল আনন্দ আর গর্ব নিয়ে বেঁচে থাকি এমন বাবার সন্তান হতে পেরে। বাবা ছিলেন একজন সৎ ও ভাল মানুষের সবচেয়ে ভাল উদাহরণ। বাবার সবচেয়ে বড় গুণ ছিল, তিনি মানুষকে খুব ভালবাসতেন এবং বিশ্বাস করতেন। যে কোনো মানুষকে ভালবাসতেন, কাছে ডাকতেন পরম স্নেহ-মমতা নিয়ে। কখনো কাউকে ছোট করে দেখতেন না। বাবা আজীবন শুধু মানুষের উপকার করতে চাইতেন। সেইসব মানুষের অবারিত ভালবাসায় বাবাকে সিক্ত হতে দেখেছি।
বাবার মৃত্যুর পর কত শত মানুষ বাবার জন্যে কান্না করেছে, আমাদেরকে জানিয়েছে। নীরবে নিভৃতে বাবা সব সময় মানুষের ভালো চাইতেন। সেই পথে চলতে আমাদের বাবা অদৃশ্য এক ছায়া হয়ে থাকেন আমাদের সাথে। অনেকদিন হয় কেউ ডাকে না আমায় প্রিয় নাম ধরে, কেউ বলে না 'বাবা তুমি কবে আসবে দেশে'? পরম স্নেহের পরশে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়ার কেউ নেই আজ। তবু আমার বাবার মতো এমন অসংখ্য বাবা বেঁচে আছেন তাদের সন্তানদের কর্মে-ভাবনায়-অনুপ্রেরণায়।
জানি বাবা দূর আকাশের নক্ষত্র হয়ে আমাদের দেখে প্রাণভোলানো সেই হাসি দেবেন। যে হাসি আরো একটিবার দেখার জন্যে আকুল হয়ে আমাদের প্রাণ কাঁদে।
এখনো ঘুমের মধ্যে বাবাকে স্বপ্নে দেখি। আশপাশের সবকিছুতেই যেন বাবার অস্তিত্ব খুঁজে পাই। মনে হয় বাবা আমার সঙ্গেই আছেন।
আমাদের বাবাসহ এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়া প্রত্যেক বাবাকে যেন মহান আল্লাহতা'লা জান্নাতবাসী করেন। ‘হে আমার রব! তাঁদের প্রতি দয়া করো যেভাবে শৈশবে তাঁরা আমাদের প্রতিপালন করেছিলেন।’ আমীন।
লেখক : সাধারণ সম্পাদক, ইউরোপ বাংলাদেশ প্রেস ক্লাব, স্পেন।