প্রকাশ : ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
ব্রাগানসা ও অতৃপ্ত হৃদয়ের অসম্পূর্ণ ভালোবাসার গল্প
রাকিব হাসান রাফি
দ্বিতীয় পর্ব
একদিন সন্ধ্যায় ক্লাসরুমে প্রবেশ করেছি। দেখলাম এক তরুণীকে আমাদের শিক্ষিকা মার্তার সাথে কথা বলতে। এর আগে তাঁকে কখনও ক্লাসে দেখিনি। পেছন থেকে তাঁর চেহারা সেভাবে স্পষ্ট হচ্ছে না। ফ্লুরোসেন্টের আলোয় তাঁর সোনালি চুলগুলো আলাদাভাবে চকচক করে উঠছে। মার্তার সাথে তাঁর কথোপকথনের দৃশ্য দেখে মনে হলো লেখাপড়ার প্রতি তাঁর আগ্রহ প্রবল এবং সত্যি সে বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান অর্জনের জন্যে বেশ ব্যাকুল। প্রথম দিকে সে কয়েকটি ক্লাস মিস করেছে, এ নিয়ে তাকে বেশ চিন্তিত মনে হলো। মার্তা তখন আমাকে ডেকে বললেন, ‘তুমি তাকে আমাদের ক্লাসের হোয়াটস অ্যাপ গ্রুপে অ্যাড করে দাও এবং যে সকল ক্লাসে সে সরাসরি অংশ নেওয়ার সুযোগ পায় নি ওই সকল ক্লাসে আমি তোমাদেরকে কী কী পড়িয়েছি সে বিষয়ে তাকে একটু ধারণা দিও’। তখনও আমি তার চেহারা ভালোমতো দেখতে পাইনি।
মার্তা আমাকে ক্লাসের দ্বিতীয় দিন সকল স্টুডেন্টকে এক করে একটি হোয়াটস অ্যাপ গ্রুপ খোলার দায়িত্ব দিয়েছিলেন, যাতে ক্লাস লেকচারের পাশাপাশি অন্যান্য সময়েও সকলের সাথে যোগাযোগ রাখা যায়। সত্যি কথা বলতে, অনেকটা উপযাজক হয়ে আমি এ দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলাম। তবে সকলের সাথে যোগাযোগ করে এরপর তাদের মোবাইল নাম্বার কালেক্ট করে হোয়াটস অ্যাপে গ্রুপ খুলতে দুই থেকে তিন সপ্তাহ সময় লেগে যায়।
ওইদিন ক্লাস শেষ না হতেই আমি দৌড়ে ছুটে যাই তার দিকে। কেনো জানি সামনে থেকে তাঁকে একবার দেখতে ইচ্ছা করছিল। ক্লাসে সে সামনে বসেছিল, পেছনে বসার কারণে পুরো ক্লাসে একবারের জন্যেও তার চেহারাটিকে ভালো মতো দেখার সুযোগ আসে নি। অনেকে আমাকে এভাবে দৌড়াতে দেখে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘রাকিব, হোয়াটস রং উইথ ইউ?’ এমনকি আমাদের এ ক্লাসে আরেকজন বাংলাদেশি স্টুডেন্ট ছিল। সে আমাকে পেছন থেকে বারবার বলছিল, ‘রাকিব ভাই, কী হয়েছে? আজকে এতো অস্থির কেন?’
আসলে ওই দিন ক্লাস শেষ হতে না হতে ওই তরুণী সবার আগে ক্লাস থেকে বের হয়ে গিয়েছিল। অন্যমনস্ক থাকার কারণে বের হওয়ার সময়ও তার চেহারাটিকে ভালোভাবে দেখতে পাই নি। হয়তো বা নতুন পরিবেশ, ক্লাসেও সে ছিল সম্পূর্ণ একা। কারো সাথে সেভাবে বন্ধুত্ব গড়ে উঠে নি। তাই সে সবার আগে ক্লাসরুম থেকে বাসার দিকে ছুটছিল। মার্তার সাথে কথা বলছিলাম, এ সময় হয়তো বা সে ক্লাসরুম থেকে বের হয়ে যায়। আমি যখন দৌড়ে তার কাছে পৌঁছাই, তখন সে ফ্যাকাল্টি অব এডুকেশনের মূল বিল্ডিংয়ের মেইন গেইট পেরিয়ে বাইরে পা দিবে এমন এক অবস্থায় ছিল। আমি পেছন থেকে তাঁকে উদ্দেশ্য করে বলি, “এক্সকিউজ মি।”
আমার গলার স্বর এমনিতে রূঢ় প্রকৃতির, কথা বলার সময় আওয়াজও বেশি হয়। পেছন থেকে এ অবস্থায় এভাবে ডাকতে থেকে সে বোধ হয় একটু ভয় পেয়েছিল। পেছনে ফিরে আমার দিকে তাকিয়ে বলে, ‘ইয়েস!’
এই প্রথমবার তাঁর মুখখানার দর্শন পেলাম। প্রথম দেখায় তাঁর প্রেমে পড়ে গেলাম। পূর্ণিমার চাঁদ যেনও তাঁর রূপের কাছে হার মানে। তাঁর থেকে কোনোভাবে চোখ সরাতে পারছিলাম না। সোনালি চুলের সাথে কচি সবুজ ঘাসের মতো সতেজ তাঁর মুখ, কিউটের ডিব্বা বললেও কম হয়ে যায়। চশমার ফাঁক দিয়ে তাঁর চোখ দুটিকে দেখছিলাম। মনে পড়ছিলো পল্লীকবি জসীম উদ্দিনের বিখ্যাত কবিতা ‘নিমন্ত্রণ’-এর সেই লাইন-
‘কালো জল তার মাজিয়াছে কেবা কাকের চক্ষু নিয়া’।
এতো সুন্দর চোখ জীবনে খুব কম দেখেছি। পলিনার সুন্দর চোখ দুটি বারবার আমার অন্তরের সকল পঙ্কিলতাকে মুছে দিচ্ছিলো। কাকের চোখের মতো স্বচ্ছ ও সুন্দর তাঁর দুইখানি চোখ। বাঁশের পাতার মতো সরু ও উঁচু নাকটিও যেন সৃষ্টিকর্তার নিপুণ হাতের ছাঁচে পূর্ণতা পেয়েছে।
কোনো ধরনের অ্যালকোহল কিংবা মাদকদ্রব্য মনে হয় মানুষের মাঝে এ ধরণের মাদকতা তৈরি করতে পারে না, আমার মাঝে সেদিন ঠিক যে ধরনের মাদকতা তৈরি হয়েছিল। বারবার মনে হচ্ছিলো, এই বুঝি স্বর্গলোক থেকে দেবী আফ্রোদিতি ব্রাগানসার বুকে নেমে এসেছে। সৃষ্টিকর্তা একজন মানুষকে এতো সুন্দরভাবে বানাতে পারে সেটা তাকে না দেখলে কোনোদিনও বিশ্বাস হতো না। ছিপছিপে শারীরিক গড়ন কিংবা উচ্চতা সব দিক বিবেচনায় একেবারে অ্যাবসুলেট পারফেক্ট বললেও ভুল কিছু বলা হবে না। জার সাম্রাজ্যের কোনো একজন রাণী কিংবা রাজকুমারীর সাথে রূপলাবণ্য ও সৌন্দর্যের দিক থেকে সে অনায়াসে পাল্লা দিতে পারবে। তার চেহারার মাঝেও রাশিয়ান, বেলারুশিয়ান কিংবা ইউক্রেনিয়ান অর্থাৎ স্লাভিক ছাপ স্পষ্ট।
আমার মাঝে ভয় কাজ করছিল, বারবার কথা আটকে যাচ্ছিলো। তবুও মনের ভেতরে সাহস সঞ্চার করে বললাম, "মার্তা আমাকে ক্লাসের অন্যান্য শিক্ষার্থীদেরকে নিয়ে হোয়াটস অ্যাপে একটি গ্রুপ খোলার পরামর্শ দিয়েছেন। এখনও আমি গ্রুপ খুলতে পারি নি, তবে গ্রুপ খুলতে গেলে তোমার হোয়াটস অ্যাপ নাম্বারের প্রয়োজন হবে।”
আমাকে কোনো কিছু জিজ্ঞেস না করে সে তার মোবাইল ফোনে ইনস্টল করা হোয়াটস অ্যাপ থেকে কিউআর কোড বের করে দিলো। আমি আমার আইফানের হোয়াটস অ্যাপ থেকে সে কিউআর কোডটিকে স্ক্যান করলাম। আমার ফোনের স্ক্রিনে তাঁর নাম ভেসে উঠলো। এই প্রথম জানতে পারলাম যে, তাঁর নাম পলিনা।