রবিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০২৪  |   ১৮ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   শনিবার চাঁদপুরে ৪ শতাধিক নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে ম্যারাথন প্রতিযোগিতা
  •   মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের পুত্রবধূ মাদকসহ যৌথ বাহিনীর হাতে আটক।
  •   মহাখালীতে ট্রেন থামিয়ে শিক্ষার্থীদের হামলা, শিশুসহ কয়েকজন রক্তাক্ত
  •   কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে শিক্ষক লাঞ্ছনা ও ভাংচুরের ঘটনা গৃদকালিন্দিয়া কলেজে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ॥ পাঠদান স্থগিত
  •   চট্টগ্রামে মধ্যরাতে ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিল থেকে অর্থদাতাসহ দুজন গ্রেপ্তার।

প্রকাশ : ২৪ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০

মা-ই দেশ, দেশ-ই মা

মোঃ ইয়াকুব আলী
মা-ই দেশ, দেশ-ই মা

জীবনে প্রথমবারের মতো বাড়ির বাইরে থাকা শুরু করলাম বুয়েটে ভর্তি হবার পর। প্রথম সপ্তাহের ক্লাস শেষ হবার পরই পেট পোড়া শুরু করলো কুষ্টিয়ার জন্যে, মায়ের জন্যে। এমন না যে কুষ্টিয়া থাকাকালীন সারাক্ষণ মায়ের আঁচলে আঁচলে ঘুরতাম। কিন্তু বাড়ির বাইরে আসার পর মায়ের সাথে নাড়ির টানটা উপলব্ধি করতে পারলাম। বন্ধু সানজাদ আর আমি বুদ্ধি করলাম সপ্তাহ শেষে বাড়ি যাবার। তখন আমাদের ছুটি ছিলো শুক্র এবং শনিবার। শেষ কর্মদিবস বৃহস্পতিবার ক্লাস করে আমরা দুই বন্ধু সন্ধ্যার পর চলে গেলাম কল্যাণপুর বাসস্ট্যান্ডে। শেষ সময় বাসের একদম শেষের সারির জে লাইনের টিকেটগুলোই অবিক্রিত থাকে। আমরা দুই বন্ধু সেখান থেকে দুটো টিকেট কিনে বাসে চড়ে বসলাম। বাস যখন কুষ্টিয়া পৌঁছে তখন মাঝরাত গড়িয়ে গেছে। কুষ্টিয়া বাসস্ট্যান্ড থেকে রিকশা নিয়ে বাড়ির উঠানে পৌঁছে মাত্র একবার মা বলে ডাক দিয়েছি। সাথে সাথে দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এলেন। আমিতো রীতিমত অবাক। পরে আব্বা বলেছিলেন, আমি ঢাকায় যাওয়ার পর মা একটা রাতও ঠিকমত ঘুমাতে পারেনি। প্রতি রাতে একাধিকবার দরজা খুলে বাইরে এসে দেখতো আমি ফিরেছি কি না। তখন আমি আমার প্রতি মায়ের এবং মায়ের প্রতি আমার ভালোবাসার স্বরূপ কিছুটা হলেও বুঝেছিলাম।

প্রবাসী হবার পর দেশের প্রতি ভালোবাসাটাও একইভাবে টের পেয়েছিলাম। তাই বছর শেষের ছুটিতে যখন সবাই বিভিন্ন দেশে বেড়াতে যায়, আমি তখন প্রতিবার আমার মায়ের কাছে, আমার দেশের কাছে ফিরে আসি। এসেই দেশের দরজা এয়ারপোর্টে এসে ধাক্কা খেতে হয়। এইবার ইমিগ্রেশনের লাইনে দাঁড়িয়ে একদম কাউন্টারের সামনে এসে পড়েছি। আমার পেছনে দাঁড়ানো এক স্বদেশী ভাইকে বলতেছিলাম, পুলিশের এই চাকরি একটা 'থ্যাংকলেস জব'। একজন পুলিশ তার নির্ধারিত সময়ের চেয়ে বেশি সময় ডিউটি করেন। তখন হঠাৎ ইমিগ্রেশন কাউন্টারের পুলিশ ভদ্রলোক উঠে এসে বললেন, আপনারা উন্নত দেশ থেকে এসে লাইনে দাঁড়ান না কেন? আমিতো আকাশ থেকে পড়লাম। এরপর উনি আমাদের নিয়ে দাঁড় করালেন লাইনের একদম শেষে। আমরা আবারও লাইনে দাঁড়িয়ে আধা ঘণ্টার কাজ দুই ঘন্টায় শেষ করে আসার সময় সেই পুলিশ ভদ্রলোককে ধন্যবাদ দিলাম। লাগেজের লাইনে এসে দেখি, শুধু আমাদের ব্যাগগুলো পড়ে আছে। দুজন ভদ্রলোক বললেন, তারা আমাদের দেরি দেখে গুছিয়ে রেখেছেন। এরপর ট্রলি নিয়ে সেগুলো কুড়িয়ে নিলাম। উনাদের ধন্যবাদ দিয়ে বখশিশ স্বরূপ কিছু টাকা দিলাম। মনে হলো, উনারা খুশি হননি।

বাংলাদেশের এয়ারপোর্ট নিয়ে বহু লেখালেখি হয়। কিন্তু সেগুলো শুধু লেখার জন্যেই লেখা। আমি অবশ্য কখনওই দেশের কোনো কিছু নিয়ে তেমন অভিযোগ করি না। দেশে থাকতে একটু আধটু বিষোদগার করলেও এখন তার বিন্দুমাত্র অবশিষ্ট নেই। আমাদের মেয়েটা জানে, বাবাকে দেশের কোনো বিষয় নিয়ে জিজ্ঞেস করলে বাবা এমন একটা ব্যাখ্যা দিবেন, যাতে মনে হবে এটাই স্বাভাবিক। তাই আজকে যখন আমাদের সাথে এই ঘটনাগুলো ঘটছিল তখন দেখি সে মিটিমিটি হাসছে। পরে আমি তাকে বললাম, পুলিশের দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা। আর বাংলাদেশের এতো বড় জনগোষ্ঠীকে কাজ করে খেতে হবে। কিন্তু সবাই তো আর কাজ পায় না। তাই এয়ারপোর্টে এই বাড়তি মানুষগুলো নিজেদের একটা কাজ খুঁজে নেন। শুনে মেয়েটা বললো, আমি জানতাম দেশের কোনো কিছুই তোমার খারাপ লাগে না, তোমাকে বিরক্ত করে না। তখন আমি বললাম, দেশ তো আমার মা। আমার মা আমাকে জন্ম দিয়েছেন। আর এই দেশ মাতৃকার আলো বাতাসে আমি বড় হয়েছি। পরে যখন স্বাবলম্বী হয়েছি, তখন দেশের মানুষের কোনো কাজে না এসে স্বার্থপরের মতো নিজের আরও একটু সুখের আশায় সাত সমুদ্র তেরো নদী পাড়ি দিয়েছি। তাহলে কীভাবে আমি আমার মাকে খারাপ বলি, কীভাবে দেশ মাতৃকাকে দোষারোপ করি।

বাংলাদেশের একেবারে প্রত্যন্ত এলাকা চরভবানীপুরে আমার জন্ম। তারপর নানা চড়াই উৎরাই পেরিয়ে এখন প্রবাসী। এই ছোট্ট জীবনে অভিজ্ঞতার ঝুলি অনেক সমৃদ্ধ। এক জীবনে যাপন করেছি বহু জীবন। নামমাত্র খরচে পড়াশোনা করেছি বাংলাদেশের সর্বোচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। যার খরচ জুগিয়েছে এই দেশের রিকশাচালক থেকে শুরু করে গার্মেন্টসে নিরলসভাবে কাজ করে যাওয়া মেয়েগুলো, প্রবাসী বাংলাদেশের রেমিট্যান্স। আর খাবার জুগিয়েছে গ্রাম বাংলার সোনার সন্তান চাষীরা। এরপর পেশাগত জীবনে চাকুরি করেছি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে। এরপর বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের পরীক্ষার মাধ্যমে চাকুরি করেছি প্রথম শ্রেণির সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে একেবারে উপজেলা পর্যায় থেকে ঢাকায়। এরপর দেশ ছাড়ার আগে দৌড়াদৌড়ি করতে হয়েছে সচিবালয়ের বারান্দায়।

দেশে দুই রকমের উন্নয়ন হয়। একটা হলো বাস্তব উন্নয়ন আরেকটা হলো কাগজের উন্নয়ন। এবং এই দুই উন্নয়নের মধ্যে ব্যবধান আকাশ পাতাল। তবুও দেশটা টিকে আছে সাধারণ মানুষের অক্লান্ত পরিশ্রমের কারণে।

আমি বাস্তব অভিজ্ঞতায় দেখেছি, দেশটাকে টিকিয়ে রেখেছে দেশের আপামর সাধারণ মানুষেরা। উত্তরবঙ্গে দেখেছি নারীরা শাড়ি পরে ছেলেদের ফুলহাতা শার্ট পরে মাঠে নেমে পড়েছেন। পাহাড়ে দেখেছি আদিবাসীরা নারীরা পাহাড়ি শস্যের বিশাল ঝুড়ি নিয়ে পাহাড়ে উঠানামা করেন। গার্মেন্টসের মেয়েগুলো একটা সাধারণ চপ্পল পরে আর টিফিন বাক্সের একটামাত্র বাটিতে সামান্য একটু খাবার নিয়ে হাড়ভাঙ্গা খাটুনির পরিশ্রম করছেন। চাষীদের কথা আর কী বলবো। নিজে না খেয়ে ক্ষেতের সবচেয়ে ভালো ফসলটা তুলে দেন আমাদের পাতে। কিন্তু নিজের ভাগ্য আর বদলাতে পারেন না। দিনে দিনে হাড্ডিসার হতে হতে একসময় মাটির সন্তান মাটিতেই মিশে যান। আর প্রবাসীদের কথা কী বলবো। যাদের রক্ত পানি করা উপার্জন আমাদের অর্থনীতির চাকা সচল রাখে, তাদেরকে আমরা হয়রানি করি প্রতিটা পদক্ষেপে। পাসপোর্ট বানানো থেকে শুরু করে ভিসা নেয়া প্রত্যেকটা বিষয়ে ঘুষ দিয়েও তারা নির্দিষ্ট সার্ভিসটা পান না। আর এয়ারপোর্টে তাদের সাথে যে ব্যবহারটা করা হয়, সেটা আমরা রাস্তার কুকুরের সাথেও করি না।

বাংলাদেশের সংবিধানে বলা আছে, প্রজাতন্ত্রের সর্বময় ক্ষমতার উৎস জনগণ। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে দেশের সর্বময় ক্ষমতার উৎস দেশের আমলারা। রাজনীতিবিদরা তো দেশের ইজারাদার মাত্র। প্রতি পাঁচ বছর অন্তর অন্তর তাদের হাত বদল হয়৷ এই রাজনীতিবিদ আর আমলারা দেশের সাধারণ মানুষের টাকায় বেতন তো নেনই। আর উপরি নিয়ে সেটা বিদেশে পাচার করে বিভিন্ন দেশে গড়ে তোলেন বেগমপাড়া। আমি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় বেশ কিছু মানুষকে চিনি, যাদের এমনভাবে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়েছে। এদের স্বামী-স্ত্রী থেকে শুরু করে সন্তানাদি এমন ভাব করেন, যেন দেশটা তাদের পূর্বপুরুষদের একান্ত ব্যক্তিগত সম্পত্তি। তার দেশের সাথে দেশের মানুষের সাথে যা খুশি তা-ই করার অধিকার তাদের আছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, দেশটা জোঁকের মতো শুষার পরও দিনশেষে দেশের মুণ্ডুপাত করেন আর দেশে দেশে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যে গড়ে তোলে নিরাপদ আবাস। কিন্তু সাধারণ মানুষ দেশের শত প্রতিকূলতা নিয়েও দেশেই থেকে যান। এই দেশের কাদামাটি বুকে নিয়ে পার করে দেন এক একটা সাধারণ জীবন। তাদের নেই কোনো ক্ষমতার মোহ, না আছে কোনো গোপন মনোবাঞ্ছা। কী অসাধারণ এইসব সাধারণ জীবন!

আমার কাছে দেশ-ই মা। মা-ই দেশ। আমি তাই দিনশেষে, বছরশেষে মায়ের কাছেই ফিরে ফিরে আসি। আমি যেমন আমার মাকে নিয়ে কোনো খারাপ কথা বলি না, দেশকে নিয়েও খারাপ কথা বলি না। দেশকে নিয়ে খারাপ কথা বলা মানে নিজের গায়ে নিজে থুথু দেয়া। আমি তাই নিজের সম্মান রাখার জন্যেই দেশের ভালো দিকগুলোর দিকে তাকাই। তার মানে এই নয় যে, দেশের খারাপ বিষয়গুলো আমাকে ভাবায় না। কিন্তু সেই দুঃখ মনেই পুষে রাখি আর আশাবাদ ব্যক্ত করি, একদিন এগুলোরও সমাধান হবে। মুক্তিযুদ্ধের পর পুরোপুরি একটা পঙ্গু অর্থনীতি থেকে আজ বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার এমনকি বিশ্বের অন্যান্য অনেক দেশের জন্যে রোল মডেল। যেটা কোনো হিসেবেই বিশ্বের জ্ঞানী-গুণীরা মেলাতে পারেন না৷ আসলে অনেক বিষয়ই আছে, যেখানে গণিতের, অর্থনীতির সব সূত্র সবসময় খাটে না। তাই ১৯৭১ সালের তলাবিহীন ঝুড়ি আজ অনেক সম্পদের ভাণ্ডার। প্রতি বছর বিজয় দিবস সামনে আসলে এই সত্যটা নতুন করে অনুভব করি।

ফিরে আসি প্রসঙ্গে। আপনি যদি আপনার মাকে ভালোবাসেন, তাহলে অবশ্যই আপনি আপনার দেশকেও ভালোবাসেন। আপনি যেভাবে চান আপনার মা ভালো থাকুক, একইভাবে যদি চান আপনার দেশটা ভালো থাকুক, তাহলে কিন্তু দেশের সত্যিকারের উন্নয়ন আর কোনো কাগজে বন্দি হয়ে থাকবে না। সামান্য যা কিছু সমস্যা আছে সময়ের সাথে সাথে সেগুলো মিলিয়ে যাবে বলেই আমার বিশ্বাস। তাই আসুন বিজয় দিবসকে সামনে রেখে আবারও আমরা নতুন করে মাকে ভালোবাসি, দেশকে ভালোবাসি। কারণ মা-ই দেশ, দেশ-ই মা।

মোঃ ইয়াকুব আলী : অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে বসবাসরত।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়