প্রকাশ : ২৩ আগস্ট ২০২১, ০০:০০
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
৪
দু’দিন পর, শহরের একটি জনবহুল স্থানে, চায়ের দোকানে চা খাচ্ছিলেন হাসান মাসুদ। সেসময় পাশেই মোটরবাইক রেখে চা’র অর্ডার করে এক ভদ্রলোক। হাসান মাসুদ তাকিয়ে দেখে, মাহাতাব নামের সেই ভাদ্রলোক। যাকে একবার দেখার জন্য বাড়ির গেইটের সামনে দাঁড়িয়েছিলো শায়লা। মাঝেমাঝেই দাঁড়িয়ে থাকে অনিশ্চিত সম্ভাবনা নিয়ে। স্ত্রীর সামনে যে ভদ্রলোকটি বিব্রত হতে হতে ঘেমে নেয়ে উঠছিলো, কণ্ঠস্বর ক্ষীণতর হয়ে আসছিলো তিনিই ইনি, চিনতে একটুকুও ভুল হচ্ছে না হাসান মাসুদের। যাকে কেন্দ্র করে আজও পাগলী মেয়েটির হাসিকান্না আবর্তিত। লক্ষ লক্ষ টাকার হিসেব মেলাতে পারেনি যাকে ভালোবেসে, তার সাথে কি একবার কথা বলা উচিত? বুঝে উঠতে পারে না সে। ভদ্রলোক একবার হাসান মাসুদকে দেখে, তারপর আবার চোখ নামিয়ে নেয়। চিনতে পারে, না চেনার ভান করে খানিকক্ষণ, বিব্রত হতে চায় না বোধকরি। তাই চা শেষ না করেই বিল মিটিয়ে তড়িঘড়ি চলে যেতে উদ্ধত হয়। ইতস্তত করতে করতে সামনে গিয়ে দাঁড়ায় হাসান মাসুদ।
কেমন আছেন মাহাতাব সাহেব? বলেই হাসিমুখে হ্যান্ডশেক করার জন্য হাত বাড়িয়ে দেয় সে।
চিনলাম না ঠিক। মাহাতাব উত্তর দেয়।
আপনি আমাকে চিনেছেন। না চেনার অভিনয়টা খুব ভালো হচ্ছে না জনাব। আপনার স্ত্রীর সামনেও সেদিন ভালো অভিনয় করতে পারেন নি। তবে শায়লার সাথে অভিনয় ভালোই করেছিলেন।
কথাগুলো খুব সাহস নিয়ে বলছেন ঠিকই, কিন্তু ভেতরে ভেতরে অস্বস্তি হচ্ছে তার। অচেনা শহরে, পরিচয় না জানা, স্থানীয় একজন মাঝবয়সী ভদ্রলোকের সাথে, এ ধরনের সংবেদনশীল কথাবার্তা বলা যায় কি! তবু বলে সে, অনুসন্ধিৎসা থেকেই বলে। অন্যায়কারী নৈতিকভাবে দুর্বল, এ চিরন্তন বিশ্বাস থেকেই বলে।
জ্বী আমি মাহাতাব উদ্দিন এটা ঠিক বলেছেন, বাকি কথাগুলো সত্য নয়। ঠিকাদারি বিজনেস করি। আপনি?
আমি হাসান মাসুদ। ডেভেলপমেন্ট সেক্টরে কাজ করি। বছর দু-এক হলো আপনাদের শহরে আছি। চা টা শেষ করলেন না যে?
এমনিই, ভালো লাগছিলো না। খুব ঠাণ্ডা মাথায় উত্তর দেয় মাহাতাব।
অন্যকিছু দিতে বলি? টিপ্পনী কাটে হাসান মাসুদ।
না না লাগবে না। আমি বাসায় যাবো। লাঞ্চের সময় হয়ে এলো। স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করছে মাহাতাব।
চলুন দুজনে আজ হোটেলে লাঞ্চ করি। শায়লা বলছিলো, চাইনিজ খাবার আপনি খুব পছন্দ করেন। আপনি চাইলে শায়লাকেও সাথে নিতে পারি। ঐতো প্লে- গ্রাউন্ডের বরই তলাতে সে থাকে। কথাগুলো বলতে পেরে খুব স্বস্তি বোধ করে হাসান মাসুদ। যেনো বলতেই হবে, এটা তার জনম জনমের কোনো দায়বদ্ধতা। এ তার অনধিকার চর্চা, বুঝে সে, তবু অভ্যাস ভেঙ্গে বেরুতে পারে না যেনো।
শায়লা কে, ঐ পাগলী মেয়েটা? মাহাতাব জিজ্ঞেস করে।
এইতো চিনতে পেরেছেন। আচ্ছা, টাকাগুলো কি একবারে নিয়েছিলেন, না কি ধীরে ধীরে ইমোশনালি ব্লাকমেইল করে?
কী সব আবোল তাবোল বলছেন? আমি কেনো পাগলের টাকা নিতে যাবো?
হা হা হা জনাব, আমি কিন্তু একবারও বলিনি আপনি শায়লার টাকা নিয়েছেন। এখন আপনার কথায় নিশ্চিত করলেন, শায়লার সব টাকা আপনিই নিয়েছেন।
আপনি খুব বাড়াবাড়ি করছেন, শায়লা কে হয় আপনার? মাহাতাবকে খুব উত্তেজিত দেখায়, খানিকটা অপ্রস্তুতও সে।
আমার কেউ না, আপনারও নিশ্চয়ই কেউ হয় না?
হুম, তাইতো। কোথাকার কোন পাগলী আমার কেউ হতে যাবে কেনো? রাগত স্বরে বলে।
কিন্তু আপনিতো তার আপনজন। ছিলেন, আছেন এখনও। খুব আবেগাপ্লুত দেখায় হাসান মাসুদকে। মাহাতাব মাথা নিচু করে থাকে। রাগ সামলে নেয়ার চেষ্টা করে।
তাকে আপন করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। ভালোবাসার অভিনয় করেছিলেন। আপনি তখন অবিবাহিত হয়েও এক সন্তানের মাকে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। মিথ্যে বললাম?
মাহাতাব বুঝতে পারে, আর কিছু লুকানোর সুযোগ নেই। ঠাণ্ডা মাথায় পরিস্থিতি সামাল দেয়ার চেষ্টা করে সে। এটি তার বৈশিষ্ট্য বোধকরি। কোনো কিছুতেই বিশেষ উত্তেজনা নেই, তাড়াহুড়া নেই। হাসান মাসুদকে হাত ধরে টেনে নিয়ে যায় অদূরে, একটি নির্জন স্থানে।
আপনি এতোসব কী করে জানেন, শায়লা আপনার আত্মীয়?
না। অনধিকার চর্চার অভ্যাস থেকেই জানি। যতোটা শুনে জানি, তারচেয়ে বেশি উপলব্ধি করি। এটা আমার বদ অভ্যাস বলতে পারেন।
শায়লা আমাকে খুব পছন্দ করতো। প্রথমবার স্বীকার করে মাহাতাব।
আপনি করতেন না? হাসান মাসুদের এ প্রশ্নে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকে মাহাতাব।
শায়লা বিধবা, এক বাচ্চার মা। আমি-----
আপনি অবিবাহিত, বিশাল স্বপ্নের এক সম্ভাবনা আপনার সামনে। সামাজিক মর্যাদা যতোই থাকুক, তার সাথে প্রেম করা যায়, তাকে নিয়ে ঘর করা যায় না, এইতো? ক্ষোভের সঙ্গে একদমে কথাগুলো বলে হাসান মাসুদ।
দেখুন, আপনি আর আমি প্রায় সমবয়সী মানুষ। ডেভেলপমেন্ট সেক্টরে কাজ করেন, আপনি অনেককিছু বুঝেন আমি জানি। সামাজিক, পারিবারিক বাস্তবতাকে তো মানতেই হয়। খুব সাবধানে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার চেষ্টা করে মাহাতাব। বুঝতে পারে, কোনোভাবেই হাসান মাসুদকে রাগান্বিত করা যাবে না।
বুঝলাম, বিধবার সাথে সংসার করতে সামাজিক বাধা ছিলো, ওর টাকাগুলো হাতিয়ে নিলেন কেনো?
দেখুন, সে সময় আমার ব্যবসা খারাপ যাচ্ছিলো, ও আমাকে কিছু টাকা দিয়ে সাহায্য করেছিলো মাত্র। আমিও মাঝেমধ্যে তার উপকার করেছি।
হা হা হা, সে আপনাকে ভালোবেসে টাকা দিয়েছিলো, আর আপনি মাঝেমধ্যে উপকার করে তার প্রতিদান দিয়েছিলেন? এর নাম প্রেম! গলা ছেড়ে বলুন জনাব, টাকা হাতিয়ে নেয়ার জন্য আপনি তার সাথে প্রেমের অভিনয় করেছিলেন।
সত্য নয়। ক্ষোভ চেপে রেখে এবারও শান্তভাবে উত্তর দেয় মাহাতাব।
সত্য না হয়ে থাকলে তার সামর্থ্য, সক্ষমতা জানার চেষ্টা করেন নি কেনো? ভালোবাসার মানুষটির দেয়ার সামর্থ্য কতোটা আছে, সেটাতো জানতে হয়, নাকি? আপনাকে খুশি করতে গিয়ে সে কতোটা ঋণগ্রস্ত হয়েছিলো, খবর নিয়েছেন?
আমি আসলে আপনাকে বুঝাতে চাইছি----, মাহাতাবের কথা শেষ না হতেই হাসান মাসুদ তার দু’হাত চেপে ধরে।
মাহাতাব সাহেব, টাকা আমি নেইনি আমি দেইওনি। যে কথাগুলো আমাকে বলতে চাইছেন, সেগুলো অসহায় মেয়েটাকে গিয়ে বলুন, সান্ত্বনা পাবে, সুস্থ হয়েও যেতে পারে। মাহাতাব বিস্মিত হওয়ার চেষ্টা করে, মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে হাসান মাসুদের দিকে।
আপনাদের দুজনের মধ্যে আমি কারোরই বিশেষ আপনজন না। লেনদেনের সাক্ষী না থাকলেও বুঝতে পারছি, টাকার পরিমাণ লক্ষ লক্ষ। আপনার ব্যবসা এখন ভালো। স্ত্রী সন্তান নিয়ে সুখেই আছেন। শায়লার টাকাগুলো দয়া করে ফেরত দিন। আগামী জীবন ওর ভালো কাটবে।
আচ্ছা দেখি, হাত ছাড়িয়ে নিয়ে স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে বলে মাহাতাব।
শায়লার ছেলেটা মারা গেছে, রাস্তায় রাস্তায় পাগলের মতো জীবন কাটছে ওর। একজন উচ্চশিক্ষিত নারীর এমন করুণ পরিণতির জন্য আপনি কি এতোটুকু দায়ী নন?
ধীর পায়ে একটু এগিয়ে গিয়ে একটা পিলারের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়ায় মাহাতাব। কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থাকে। আলতো করে একটা সিগারেট ধরায়। আরেকটা সিগারেট এগিয়ে দেয় হাসান মাসুদের দিকে।
জানেন, অভিককে আমি খুব স্নেহ করতাম। বলেই গলা কাঁপিয়ে কান্নার অভিব্যক্তি প্রকাশ করে সে। এ প্রকাশ ভেতরের না বাহিরের বুঝা দুঃসাধ্য। এরপর অন্যদিকে ঘুরে দাঁড়ায়। হাসান মাসুদ লক্ষ্য করে, পকেট থেকে টিস্যু পেপার বের করছে মাহাতাব। হতে পারে এ কোনো উচ্চমার্গীয় অভিনয়ের ক্ষুদ্রতর প্রকাশভঙ্গি। হাসান মাসুদের পক্ষে বুঝা কষ্টসাধ্য।
স্নেহ করতেন না স্নেহের অভিনয় করতেন সেটা জানার আগ্রহ আমার নেই মাহাতাব সাহেব। হয়তো অভিকের মৃত্যুর পেছনেও লুকিয়ে আছে অন্য কোনো ইতিহাস। সে যা হোক, আমি যা বললাম, ভেবে দেখবেন কেমন, চলি। বলতে বলতে একটি অটোরিক্সায় উঠে চলে যায় হাসান মাসুদ। সিগারেটে লম্বা টান দেয় মাহাতাব উদ্দিন।
৫
পরেরদিন সকালে হাসান মাসুদ অফিসের সামনে এসে রিক্সা থেকে নামতেই অদূরে সড়ক ভবনের সামনে শায়লাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। খুব বিমর্ষ অবস্থা তার। কাছে এগিয়ে যায় হাসান মাসুদ।
এখানে কী করছেন?
জানেন, ও প্রতিদিন সকালবেলা এখানে আসে। ওকে একবার দেখবো। তারপর ওর সাথে সারাদিন মোটরবাইকে ঘুরবো। দুপুরে একসাথে খাবো। ও বলেছে, আজকে আমাকে বকুলতলা নিয়ে যাবে। একদমে কথাগুলো বলতে বলতে কিশোরী মেয়ের মতো খিলখিল করে হেসে ওঠে। হাসতে হাসতে হাঁপিয়ে ওঠে। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয় তার। বসে পড়ে এক পর্যায়ে।
মাহাতাব সাহেব এদিকে আসবে না। আপনি আমার সাথে অফিসে চলুন। হাত ধরে দাঁড় করায় শায়লাকে।
আপনি মিথ্যে বলছেন, ও আমাকে বলেছেতো আসবে।
না, উনার সাথে আমার দেখা হয়েছিলো। হাসান মাসুদের কথা শেষ না হতেই উত্তেজিত হয়ে পড়ে শায়লা।
আমার কথা কিছু জিজ্ঞেস করেছে? অভিকের কথা? খুব উৎসুক দেখায় তাকে। চোখেমুখে খুশির ঝিলিক বয়ে যায়। এ আকুলতার কোনো ইতিবাচক উত্তর জানা নেই হাসান মাসুদের কাছে। তবু সে শেষ চেষ্টাটুকু করতে চায় অসহায় মেয়েটির জন্য।
আপনি চলুন আমার সাথে। অনেকটা টেনেই নিয়ে যায় শায়লাকে। অফিসে ঢুকে নাস্তার অর্ডার দেয়।
স্যুপ ছাড়া ও সকালের নাস্তা খেতেই পারে না। ডিম আর সবজির মিক্স নুডুলসটা ও খুব পছন্দ করে, টমেটো সস আনতে ভুল হয় না যেনো কেমন, সস ছাড়া ও আবার নুডুলস খেতে চায় না।
আধুনিক বাড়ির একটা ডাইনিং টেবিলের বর্ণনা দিয়ে ফেলে সে অনায়াসে। বলতে বলতেই কাঁদে, হাসে।
আপনার জন্য নুডুলস আনতে বলবো? প্রশ্ন করে হাসান মাসুদ। কোনো উত্তর দেয় না শায়লা। অনেকক্ষণ সুনসান নীরবতা বয়ে যায় অফিস রুমে। এদিকে অফিসের সহকর্মীরা কী ভাবছে, সেটাও চিন্তা করতে হয় খানিকটা। একবার নিজের রুম থেকে বেরিয়ে সহকর্মীদের সাথে প্রয়োজনীয় আলাপ সেরে আসে। শায়লা ততক্ষণ টেবিলে মাথা দিয়ে চুপচাপ বসে থাকে। হাসান মাসুদ রুমে ঢুকে পত্রিকায় চোখ বুলায়। শায়লা ঘুমিয়েই পড়েছিলো, কলিংবেলের শব্দে হকচকিয়ে ওঠে। নাস্তা নিয়ে এসেছে অফিসের জুনিয়র সহকর্মী। শায়লা খুব তাড়াতাড়ি দু’হাতে রুটি ছিঁড়ে নুডুলস-এর সাথে মিশিয়ে গোগ্রাসে খেতে শুরু করে। স্যুপের বাটিতে সস ঢেলে দেয়। নিজে খায় না সেটা। হাসান মাসুদের দিকে এগিয়ে দেয়। অবচেতন মনে মাহাতাবকেই যেনো এগিয়ে দেয় স্যুপের বাটি।
চা খাবেন? শায়লার খাওয়া শেষ হলে হাসান মাসুদ জিজ্ঞেস করে।
না না ওতো যেনো তেনো চা খেতে পছন্দ করে না। সাত পদের তরকারি ছাড়া ভাতই খেতে চায় না।
আপনি এখনও তাকে ভালোবাসেন? টেবিলে কনুইয়ের ভর রেখে, গালে হাত দিয়ে খুব আদরমাখা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে।
জানিনা তো। ভালোবাসায় দিনক্ষণের হিসেব হয় বুঝি? খুব সাবলীল প্রশ্ন মিশ্রিত উত্তর দেয় শায়লা।
আচ্ছা, অভিকের কী হয়েছিলো?
এবার আর চটপট উত্তর দেয় না শায়লা। কিছুটা অন্যমনস্ক দেখায় তাকে। কপালে ঘাম জমে ওঠে। চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ায়। বারান্দায় যায়। কিছুক্ষণ পায়চারি করে। শীতের সকালে পাতা ঝরা গাছগুলোর দিকে তাকায় বারবার। খুব আপন মনে হয় ইলেকট্রিক তারে বসে রোদ পোহানো কাকটাকে। ময়লামাখা আঁচল দিয়ে চোখ মুছতে গিয়ে চোখ জ্বলে ওঠে। হাসান মাসুদ পেছনে দাঁড়িয়ে টিস্যু এগিয়ে দেয়।
আমি তাকে মেরে ফেলেছিতো। নিজের হাতে মেরে ফেলেছি। আমি মা না, রাক্ষুসি। হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে। হাসান মাসুদের সহকর্মীরা এসে দরজায় দাঁড়ায়। সে তাদেরকে ইশারায় সরে যেতে বলে। তারা চলে যায়।
কী অসুখ হয়েছিলো?
জানিনা, মাসের পর মাস জ্বরে ভুগছিলো, টাকার জন্য চিকিৎসা করাতে পারিনি।
টাকার জন্য? অবাক হয় হাসান মাসুদ। অপলক তাকিয়ে থাকে শায়লা বাইরের দিকে।
হুম, ওর ব্যবসার জন্য সব জমানো টাকা দিয়ে দিয়েছিলাম। ওদের পরিবারের মাসিক খরচের টাকাও দিতাম নিয়মিত। ওর মায়ের চিকিৎসা খরচ, আরও কতো কি। ক্রেডিট কার্ডের লক্ষ লক্ষ টাকার ঋণের বোঝা তখন আমার মাথার উপরে।
তারপর?
কলেজের বেতন পাওয়ার সাথে সাথেই লোনের ইন্সটলমেন্ট দিতে হতো। বাকি টাকা ওকে দিয়ে দিতাম। মাঝেমাঝে ও বাজার করে নিয়ে আসতো।
অভিকের অসুস্থতার কথা উনি জানতেন না?
জানতো। দু-একবার সরকারি হাসপাতালে গিয়েছিলো আমার সাথে। ডাক্তার ঢাকায় রেফার করেছিলো। নিয়ে যেতে পারিনি। অতো টাকা আমার কাছে তখন ছিলো না।
উনার সাহায্য চাইতে পারতেন। অনেকটা ক্ষোভ প্রকাশ করে হাসান মাসুদ।
আমি যখন ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ি, তারপর থেকে ও আর আমার সাথে যোগাযোগ রাখেনি। শায়লা আর কথা বলতে পারে না, নির্বাক তাকিয়ে থাকে দূরের ছাতিম গাছটার দিকে। হাসান মাসুদের আর বুঝতে বাকি থাকে না, যা হবার তা-ই হয়েছিলো। সামর্থ্যরে চেয়ে বেশি ভালোবাসলে সুযোগ সন্ধানীরা কতোটা সুযোগ নেয়, এই তার প্রমাণ।
কলেজের চাকুরিটা ছাড়লেন কেনো?
ছাড়িনি, কলেজ থেকে আমাকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছিলো। হাসান মাসুদ লক্ষ্য করে, শায়লা এই প্রথম বারের মতো দীর্ঘসময় ধরে স্বাভাবিক আচরণ করছে। স্বাভাবিকভাবে কথা বলছে। প্রশ্নোত্তরের ধারাবাহিকতা চলমান রয়েছে। শায়লা কি তবে সুস্থ হয়ে উঠছে? প্রচণ্ড আশাবাদী হয়ে ওঠে সে, নিজেকে প্রবোধ দেয়। কথাবার্তা চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। একটার পর একটা প্রশ্ন করতে থাকে। ট্র্যাকলেস হতে দেয়া যাবে না, খুব সাবধানে এগিয়ে যেতে হবে।
কেনো? অব্যাহতি দিলো কেনো? অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে।
অভিকের মৃত্যুর কিছুদিন পর থেকে আমি কলেজে যাওয়ার কথা ভুলে যেতে থাকি। সারাদিন ঘরেই বসে থাকতাম, ঘরে রান্নাবান্না করতাম না। সহকর্মীদের কেউ কেউ দু-একবার খাবার দিয়ে যায়, বাড়িওয়ালা এসে ঘুরে যায়, ভাড়া দিতে পারিনি। এভাবে কয়েকমাস কেটে যায়। দৈনন্দিন সব কাজকর্ম প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। একদিন কলেজ থেকে এসে একটি অব্যাহতি পত্র দিয়ে যায় কেউ একজন। সেদিনই বাড়িওয়ালা অনেকটা টেনেহিঁচড়ে বাড়ি থেকে বের করে দেয় আমাকে। বরখাস্ত পত্রে লিখা ছিলো, আমি মানসিক ভারসাম্যহীন। আমার চাকুরি করার যোগ্যতা নেই।
মাহাতাব সাহেবের খোঁজ করেন নি? উৎসুক হয়ে জিজ্ঞেস করে হাসান মাসুদ।
না। খুব অপমানিত বোধ করেছিলাম। আমার দুঃসময়ে যে মানুষটি স্বেচ্ছায় সরে গিয়েছে তাকে কেনো খুঁজবো আমি। পাহাড় প্রমাণ স্বপ্ন দেখিয়েছিলো যে মানুষটি, তাকেইতো ভালোবেসেছিলাম। অভিকের বাবার শূন্যস্থান পূরণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলো বলেইতো আপন করেছিলাম। সবই ছিলো অভিনয়, বুঝতে পারিনি, তাই অমানুষ মনে হয়েছিলো নিজেকে। অসভ্য মনে হয়েছিলো বারবার। লজ্জা, ঘৃণা, অপমানে আর কাছে যাওয়ার প্রয়োজন মনে করিনি।
তারপর কী হলো?
হাতে টাকা নেই, ব্যাংকে টাকা নেই, ক্রেডিট কার্ডের লোন পরিশোধ করতে অভিকের বাবার শেয়ার সার্টিফিকেট বিক্রি করে দিয়েছিলাম অনেক আগেই। ওগুলো অভিকের নামেই কেনা হয়েছিলো।
তারপর? হাসান মাসুদ আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। চিকিৎসা বঞ্চিত ছেলেটির মুখ ভেসে ওঠে চোখের সামনে। নিজের সন্তানদের কথা মনে হয়। টিস্যু পেপারে চোখ মুছে।
তারপর নিঃস্ব আমি রাস্তাায় হাঁটতে হাঁটতে একদিন হঠাৎ মাহাতাবের সাথে দেখা হয়। আমি কিছু বলার আগেই, সে খুব দ্রুত আমাকে নিয়ে একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকে পড়ে। খাবারের অর্ডারও দেয়। কিছুক্ষণ পর তাকে আর দেখতে পাই না। পেছন থেকে পালিয়ে যায়। হোটেলের লোকজন আমাকে চিনতো। টাকা ছাড়াই আমাকে খেয়ে যেতে বলে। তাদের মধ্যে কানাকানি শুনতে পাই, ‘কলেজের এই ম্যাডাম অন হাগল অই গেছে গা’। আমি পাগল, বাইরের মানুষের কাছে এই শব্দটি প্রথম শুনতে পাই। আমি না খেয়েই বেরিয়ে যাই।
মাহাতাব সাহেবের বাড়িতে যান নি কেনো?
হুম, সেদিনই সন্ধ্যায় গিয়েছিলাম। বাড়িতে আলোকসজ্জা চলছিলো। মানুষ থৈথৈ করছিলো। বরযাত্রার প্রস্তুতি চলছে। একটা মাইক্রোবাস সাজানো হচ্ছে। ওর বন্ধুরা আমাকে দেখে কাছে আসে। ওরা আমাকে আগে থেকেই চিনতো। তবে আমাদের সম্পর্কের একবিন্দুও তারা জানতো না। ও ইচ্ছে করেই জানায়নি, জানতে দেয়নি, কোনো সাক্ষী রাখতে চায়নি বলেই, সেটা এখন বুঝতে পারছি।
মাহাতাব সাহেবের বিয়ে?
হুম। ওর বন্ধুরা ভেবেছিলো, কলেজ শিক্ষক হিসেবে আমিও আমন্ত্রিত বরযাত্রী। আমি পাগল, এটা বোধকরি ওরা তখনও শোনেনি। আমিও তখন নিজেকে জানি না পুরোপুরি। ওর মা দৌড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে উল্লসিত হয়ে জানতে চায়, আমি আসতে এতো দেরি করলাম কেনো। ঐ বাড়িতে আগেও একবার গিয়েছিলাম, তাই চিনতেন। কলেজের ঠিকাদারি কাজ পেতে তার ছেলেকে সহযোগিতা করেছি, বিনিময়ে লক্ষ লক্ষ টাকা উপার্জন হয়েছে, বিয়ে করার সামর্থ্য তৈরি হয়েছে। উনি মাহাতাবের হঠাৎ ধনী হয়ে ওঠার ইতিহাসটা এভাবেই জানতেন। তাই আমার মতো উপকারী মানুষের অনুপস্থিতিতে সে বিয়ে হতেই পারে না, এমনই ছিলো তার অনুভূতি। প্রায়শই ভদ্র মহিলার সাথে ফোনে কথা হতো আমার। আমাকে দাতা হিসেবে, দেবী হিসেবেই সম্মান করতেন। আমার পরনে পুরাতন শাড়ি দেখে খুব অবাক হলেন, বরযাত্রায় পুরানো শাড়ি পরে যেতে নেই। তাই ঘর থেকে একটি নতুন শাড়ি এনে বারান্দায় দাঁড়িয়ে নিজের হাতে পরিয়ে দিলেন, নতুন বউয়ের দ্বিরাগমনের শাড়ি। জানালেন, হবু বউটির সাথে বছর তিনেক আগে থেকেই সম্পর্ক ছিলো মাহাতাবের। এ বাড়িতে অনেকবারই আসাযাওয়া করেছে সে। এসএসসি পাস করে মাত্র কলেজে ভর্তি হয়েছে। খুবই সুন্দর মেয়ে, লক্ষ্মী মেয়ে। সেই কিশোরী মেয়েটির সাথে গত তিনবছরের প্রেমের গল্প আমিও জানি বলেই তার ধারণা। তাই খুব উৎফুল্ল হয়েই বলছিলেন আমাকে। এমন সময় বর সেজে গাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়ালো মাহাতাব। নতুন শাড়ি পরা আমিও কিছু না ভেবেই তার মুখোমুখি গিয়ে দাঁড়ালাম। ও ইতস্তত করছিলো, আমি কানের কাছে মুখ নিয়ে আশ্বস্ত করে বললাম, ভয় নেই আমি তোমার বরযাত্রায় যাবো না। কিছু টাকা থাকলে দাও, অনেকদিন ভাত খাইনি। মাহাতাব চিৎকার করে বলে উঠলো, এই পাগলীকে কে ঢুকতে দিয়েছে বাড়িতে? আমার লাইফটা নষ্ট করে দিলো। এই ওরে এক্ষুণই বের করে দে বাড়ি থেকে। সৌম্যকান্ত সুপুরুষ মাহাতাবের মুখের দিকে একবার শুধু তাকাতে পেরেছিলাম। তারপর আর কিছু মনে নেই।
এতোক্ষণ বারান্দায় দাঁড়িয়ে দূরের প্রকৃতির দিকে তাকিয়েই বলে যাচ্ছিলো শায়লা। হাসান মাসুদের সারাজীবনের সঞ্চিত অভিজ্ঞতার মধ্যে শায়লা কাহিনি অন্যতম। দীর্ঘক্ষণ পরে সে নিজেকে আবিষ্কার করে স্বাভাবিক মননে। আবিষ্কার করে এতোক্ষণ শায়লার পেছনে দাঁড়িয়ে কী নির্মমতার গল্প শুনলো সে। মানুষের মধ্যে পৈশাচিকতার রূপ কতো রকমের থাকতে পারে এ তার প্রমাণ!
এতোদিন কোথায় ছিলেন?
আর কিছু মনে নেই। শায়লা উত্তর দেয়।
দু’সপ্তাহ আগে থেকে ঐ যে বরইতলায় থাকতে শুরু করেছেন, কী করে এলেন এখানে?
একদিন খুব সকালে আমাকে একটা বাস থেকে নামিয়ে দেয়া হয় এই রাস্তায়, আর কিছু মনে করতে পারছি না।
আবার চাকুরি করবেন?
পাগলকে কেউ চাকুরি দিবে না।
আপনি এখন পুরোপুরি সুস্থ।
আমার খুব ঘুম পাচ্ছে, আমি যাই।
আপনি আমার সাথে চলুন।
আপনার মহানুভবতায় আমি মুগ্ধ। আমার জন্য সামাজিক নিন্দার শিকার হবেন, আমি তা চাই না। হেসে বলে শায়লা।
কিন্তু রাস্তায় থাকলে আপনার ক্ষতি হতে পারে।
ক্ষতির কি আর কিছু বাকি আছে? দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উত্তর দেয় সে।
জীবন অনেক বড়। আরও লম্বা সময় বেঁচে থাকতে হবে আপনাকে। তার জন্য নির্ভরতা প্রয়োজন।
হুম, জীবনটা সত্যিই অনেক বড়। অভিকের মৃত্যু, মাহাতাবের বিয়ে, তারপর সম্ভাবনাময় ক্যারিয়ার ধ্বংস করে পেরিয়ে এলাম দীর্ঘ পনেরো বছর। এতোদিন যেহেতু মরিনি, বাঁচতে তো হবেই।
তবে? এককালের মেধাবী কলেজ শিক্ষক শায়লার কাছ থেকে একটি যৌক্তিক উত্তরের জন্য অপেক্ষা করে হাসান মাসুদ।
দেখি, আজকের দিনটা এখানে থেকে কাল এক দূর সম্পর্কের আত্মীয় বাড়ি যাবো। ওরা চট্টগ্রামে থাকে।
তারপর? আবারও একটি যৌক্তিক উত্তর আশা করে হাসান মাসুদ। শায়লার মানসিক সুস্থতা সম্পর্কে পুরোপুরি নিশ্চিত হতে চায় সে বারবার।
আপনার কথা আমার মনে থাকবে হাসান মাসুদ সাহেব। বাকি জীবনটা বাঁচার জন্য নির্ভরতা খুঁজবো। নিজের উপরেই যেনো থাকে সে নির্ভরতা। হাসে শায়লা। তাকে খুব আত্মপ্রত্যয়ী দেখায়। যেতে উদ্ধত হয় সে।
মাহাতাব সাহেবের কাছে আর টাকা ফেরত চাইবেন না?
না! ভুল করে যে টাকায় প্রেম কিনেছিলাম, সে দায় তো আমারই।
গতকাল উনার সাথে আমার দেখা হয়েছিলো। আমি কিন্তু উনাকে বলেছিলাম আপনার টাকাগুলো ফেরত দিতে। খানিকটা ইতস্তত বোধ করে বলে হাসান মাসুদ।
সে আপনার দায়িত্ববোধ, মহানুভবতা। কিন্তু বিষয়টি এখন আমার রুচিবোধের বাইরে। শায়লার ব্যক্তিত্ব, রুচিবোধের কাছে আরেকবার যেনো হার মানে হাসান মাসুদ। ‘দ্য গড অফ স্মল থিংকস’ মনে পড়ে আরেকবার। যেতে যেতে একবার পেছন ফিরে তাকায় শায়লা। তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে বলে-
কৃতজ্ঞতা জানিয়ে ছোট করবো না আপনাকে। ভালো থাকবেন। আপনার মতো ভালো মানুষেরা যেনো দীর্ঘজীবী হয়। চলে যায় শায়লা। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে হাসান মাসুদ। সিদ্ধান্ত নেয় মনে মনে, আজ লম্বা সময় ধরে ফোনে কথা বলবে স্ত্রীর সাথে। শায়লার পুরো ঘটনা বলবে। তার মানসিক সহযোগিতায় একজন বিপর্যস্ত মানুষ সুস্থ হয়ে উঠেছে, এটা তার জীবনের পরম পাওয়া। বেশ ক’দিন ধরে শায়লার বিষয়ে অস্বস্তিতে ছিলো সে। ভালোভাবে কথাই বলা হয়নি বাসায়, না স্ত্রীর সাথে না বাচ্চাদের সাথে। আজ সে প্রাণ খুলে কথা বলবে। প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিবে। খুব প্রশান্তি নিয়ে অফিসের কাজে মনোনিবেশ করে সে আজ। এরপর ঠিক পাঁচটায় বেরিয়ে পড়ে। রিক্সায় যেতে যেতে ডানদিকে তাকিয়ে দেখে শায়লা ঘুমাচ্ছে তার ডেরায়। দ্রুত বাসায় চলে যায় সে।
৬
পরের দিন খুব সকালে ঘুম ভাঙ্গে হাসান মাসুদের। অনেকদিন পর রাতে ভালো ঘুম হয়েছে তার। আজ একটু তাড়াতাড়ি অফিসে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সে। সাড়ে সাতটায় বেরিয়ে পড়ে। বাসা থেকে অফিসের দূরত্ব খুব বেশি নয়। রিক্সাটা দার্জিলিং-এর কাছাকাছি আসতেই বরই তলায় লোকজনের জটলা দেখতে পায়। শায়লার ডেরার সামনে বেশকিছু লোক জড়ো হয়েছে ইতোমধ্যে। বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে তার। দ্রুত রিক্সা থেকে নেমে ছুটে যায় ডেরার কাছে। লোকজন কেউ কিছু বলছে না। সবাই নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছে। ভিড় ঠেলে ভেতরে উঁকি দিতেই দুঃস্বপ্নের চিত্রটি দেখতে পায়। এ অবিশ্বাস্য। এ কল্পনারও অতীত। শায়লার রক্তাক্ত নিথর দেহটি পড়ে আছে তেল চিটচিটে বিছানায়। দেহ থেকে মাথাটি বিচ্ছিন্ন অবস্থায় পড়ে আছে খানিকটা দূরে। লোকজন কানাকানি করে বলতে শুরু করেছে, জবাই করে হত্যা করা হয়েছে পাগলীকে। সে আর নিতে পারছে না, শরীর গুলিয়ে আসছে, শীতের সকালে অনবরত ঘামতে থাকে সে, বমি পাচ্ছে তার। ভিড় ঠেলে বেরিয়ে আসে। রাস্তায় বসে পড়ে। তার চেনাজানা দু-একজন লোক তাকে ধরে পিন্টু দাসের চা’র দোকানে নিয়ে যায়। মাথায় পানি দেয়। শেষ পর্যন্ত তার বমি হয়। চা’র দোকানেও লোকজনের জটলা শুরু হয়েছে ইতোমধ্যে। গবেষণাও চলছে সমানতালে। কেউ বলছে, ধর্ষণ পরবর্তী খুন। কেউ বলছে, পাগলীর কাছে অনেক টাকা ছিলো, খুন করে টাকা নিয়ে পালিয়ে গেছে খুনিরা। হাসান মাসুদ যা বুঝেছে তা বুঝতে তাকে দ্বিতীয়বার ভাবতে হয়নি, কিন্তু সে বুঝার গাণিতিক হিসেবটা আর কাউকেই বলে বুঝানো যাবে না, প্রমাণ করাতো যাবেই না। পুলিশের গাড়ির হুইসল শোনা যায়। সবার চোখ সেইদিকে। গাড়ি ভর্তি করে পুলিশ এসেছে। বেঁচে থাকতে খবর রাখে না একজন, মরে গেলে দল বেঁধে আসে প্রশাসন, এটাই সংস্কৃতি, এদেশীয় সংস্কৃতি। শায়লা হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে ইতোমধ্যে পুরো এলাকা লোকে লোকারণ্য। হাসান মাসুদ পুলিশের গাড়ির দিকে তাকিয়ে আছে। এ সময় পেছনে একটি পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনতে পায়, সে কণ্ঠস্বর পিন্টু দাসকে চা দিতে বলে। সে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে মাহাতাব উদ্দিন চা খেতে চাইছে। দু’জনের চোখাচোখি হয়। মাহাতাব নিজে থেকেই কথা বলে।
কেমন আছেন হাসান মাসুদ সাহেব? সুদর্শন মানুষটির ঠোঁটের কোণে একটুকরো হাসি লেগে আছে। সে হাসি অনেকটা বিজয় চিহ্নের মতো মনে হয়। হ্যান্ডশেক করার জন্য হাত বাড়িয়ে দেয় সে।
হাসান মাসুদ আর কথা বলে না, বলতে পারে না। হ্যান্ডশেক না করেই দোকানের পেছনে চলে যায়। তার গা ঘিনঘিন করে ওঠে, আবারও বমি পায়। ওয়াক ওয়াক করে বমি করে। তারপর কুলকুচি করে দ্রুত অফিসের দিকে চলে যায় সে।
হাসান মাসুদ অফিসে ঢুকতেই লক্ষ্য করে, সহকর্মীরা সবাই কানাকানি করে কথা বলছে। কী নিয়ে কথা হচ্ছে, বুঝার বাকি থাকে না আর। সে তার রুমে ঢুকে যায়। সাথে সাথেই কলিংবেল বেজে ওঠে। অনুমতি পেয়ে ক্লিনার রুমে ঢুকে। ঢুকেই একটা পুরাতন ছয় ইঞ্চি লম্বা নোটবুক দেখায় হাসান মাসুদকে।
স্যার, সকালে আপনার রুমে ঝাড়ু দেয়ার সময় এই নোটবুকটা পেয়েছি। গতকাল শায়লা ম্যাডাম যে চেয়ারটায় বসেছিলো ঠিক তার নিচেই। ভেতরে ওনার নামও লিখা আছে।
হাসান মাসুদ নোটবুকটি হাতে নেয়। ক্লিনার চলে যায়। সে উৎসুক হয়ে পড়ে। নোটবুকটিতে বিভিন্ন তারিখের কিছু খরচের হিসেব লিখা আছে। সবই পনেরো বছর আগের তারিখ। ছোট ছোট চিরকুটের মতো কিছু চিঠিও লিখা আছে, সে সময়ের।
প্রিয় মাহাতাব
কোথায় আছো জানি না। মোবাইলে পাওয়া যাচ্ছে না তোমাকে। তুমিতো জানো, বাবুর খুব অসুখ। চিকিৎসার জন্য ঢাকায় নেয়ার পরামর্শ দিয়েছে ডাক্তার। আমার কিছু টাকা দরকার। যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব যোগাযোগ করো কেমন।
ইতি : শায়লা
আরেকটি চিঠিতে লিখেছে-‘বাবু নেই’। আমার আর টাকার দরকার নেই। সময় হলে এসো। ঘরে আজকাল আর রান্না হয় না। কবে আসবে জানিও, তোমার পছন্দের খাবার রান্না করবো।
এ ধরণের চিরকুট পড়তে পড়তে হঠাৎ একটি ভাঁজ করা কাগজ দেখতে পায় সে। নোটবুকের শেষ পৃষ্ঠার মলাটের সাথে পিন দিয়ে গাঁথা। পিন খুলে কাগজটা পড়ে।
এটিও একটি চিঠি। রঙিন কাগজে লিখা। চিঠির একটি নামকরণও করা হয়েছে। ‘না পাঠানো চিঠি’
প্রিয় অথবা প্রিয়জন----
ভালো থাকলেই ভালো। অতঃপর স্বাধীন থাকার নামই তো ভালো থাকা, জানিতো, তুমি সদাশয় এক মুক্ত বলাকা! তবু খানিকটা পরাধীন হয়ে যদি চোখ বুলাও এই কালির আঁচড়ে, তবে সার্থক হই পুণ্য জলের মতো। ধন্য হয় জনম জনমের অভিলাষ। শেষবিন্দু সুখের ছোঁয়া লাগে এই বুকের পাঁজরে। তোমার না জানলেও চলে, তবু বলি- ততোটাই ভালো আছি, যতোটা চেয়েছো, যতোটা দিয়েছো ভালো থাকতে, যতোটা সাজিয়ে রেখেছো প্রতিশ্রুতির ভাঙ্গা আরশিতে।
পদ্ম পাতায় জলময়ূরের গল্প শুনে যেদিন প্রথমবার বিমোহিত হয়েছিলে কিংবা মুগ্ধতার ভান করেছিলে, সেদিন তোমার একেক প্রশ্নের উত্তরে একেক ডজন বাক্যের ফুলঝুরি বেরিয়ে এসেছিলো আমার মুখ থেকে। বুক থেকে কণ্ঠনালী চিরেই বেরিয়েছিলো সে বাক্যবাণ, এক জলময়ূরের না ফুরানো অরণ্যের গল্প চর্চিত হয়েছিলো শেষ প্রহরের আলো আঁধারীতে। আর তুমি সহসাই বুঝে নিয়েছিলে, পিপাসিত মরুদ্যানে আষাঢ়ের বর্ষণ কতোটা সময়োপযোগী! তোমার ধর্ম অধর্মের বিশ্বাস মেলে ধরলে আমার চোখের সামনে। মেলে ধরলে প্রেমের ছলে প্রয়োজন অপ্রয়োজনের গল্প কিংবা অযাচিত অবারিত দিনের ফিরিস্তি। এভাবেই একদিন বৈশিষ্ট্যের কোমল অনুভূতিতে, তোমার প্রতি আমার বিশ্বাস হিমালয়ের চূড়ায় উঠে গেলো, আটলান্টিকের অতলান্তে মুক্তো কুড়াতে যুদ্ধ শুরু হলো ঊর্মিমালায়, দুঃস্বপ্নের কালিমা ভেদ করে হ্যালির ধূমকেতু ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে হলো নীল আসমানে! লোভাতুর হলাম আমি কিংবা লোভাতুর করে তুললে আমায়। এসবের কিছুই আজ হয়তো তোমার মনে নেই, কিংবা না মনে থাকাই তোমার বৈশিষ্ট্য! ঘটনার ঘনঘটায় তুমি এরই নাম দিলে প্রেম, নিখাদ প্রতিশ্রুতির একপশলা বৃষ্টি এলো আমার আকাশপাতাল ছাড়িয়ে। নতুন জীবনের স্বপ্নে বিভোর, আমি হলাম পৃথিবীর সুখি মানুষদের একজন!
তারপর একদিন মোহ কেটে গেলে, তুমি আর প্রতিদিনের গোলাপ মঞ্জুরি হয়ে ফুটলে না আমার প্রিয় আঙ্গিনায়। ভালোবাসলে না আমার দুঃসময়কে। সমতাবিহীন ছেঁড়াপালে দিগ্বিদিক ভেসে গেলো মনপবনের নাও। তোমার প্রিয়জন হয়ে ওঠা হলো না আমার। হুম, আবারও বসন্তে দেখা দিলো অযাচিত শ্রাবণধারা! এরই নাম বুঝি ভুল বসন্ত। নিজেকে প্রয়োজনের এক মহাপাত্র হিসেবেই তুলে ধরলাম তোমার দুয়ারে। তুমিও কি আমার প্রয়োজনের উপকরণ ছিলে? ছিলে হয়তো তোমারই ভুলে কিংবা আমার! কিছু ভুল সয়ে গেলো, কিছুটা রয়ে গেলো, কিছুটা ভেসে গেলো নীলাদ্রির সীমানায়। তবু বাঁচি, ভালো থাকি বা না থাকি। এ চিঠি তোমার হাতে পৌঁছবে না জানি, তবু লিখলাম নিজের কাছে নিজেরই দায় এড়াতে। তোমার খেলার ছলে খুন হলো আমার রঙিন প্রজাপতি, তাতে কার কী এলো গেলো! অভিকের আত্মা আমায় ক্ষমা করবে না জানি, তবু তুমি ভালো থেকো, অনন্তকাল।
ইতি : তোমার কেউ নয়, শায়লা!
হাসান মাসুদ খুব দ্রুত বেরিয়ে যায় অফিস থেকে। বরই তলায় গিয়ে দেখে, পুলিশের কর্মযজ্ঞ চলছে পুরোদমে। মাহাতাব আছে তখনও। মোটরবাইকে হেলান দিয়ে আয়েস করে সিগারেট টানছে সে। পুলিশ পিন্টু দাসকে জেরা করছে। একটা ভ্যানে তোলা হয়েছে শায়লার লাশ। আরও কয়েকজন সন্দেহভাজন লোককে পুলিশের গাড়িতে তোলা হয়েছে। শায়লার ব্যবহৃত তেল চিটচিটে কাঁথা কম্বল জব্দ করা হয়েছে, হত্যাকা-ের আলামত হিসেবে। জব্দ করা হয়েছে ‘দ্য গড অফ স্মল থিংস’ আলামত হিসেবে শায়লার নোটবুকটিও পুলিশের হাতে তুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় হাসান মাসুদ। আবার পরক্ষণেই মত পালটায় সে। সাব-ইন্সপেক্টর হাঁক দেয়, শায়লার লাশ নিয়ে ভ্যানগাড়িটি চলতে শুরু করে। পুলিশের গাড়িটি ভ্যানগাড়িকে কর্ডন করে নিয়ে যেতে থাকে। লোকজন যে যার মতো চলে যায়। মাহাতাব সিগারেট শেষ করে মোটরবাইক স্টার্ট দেয়। সামনে গিয়ে দাঁড়ায় হাসান মাসুদ।
এটা শায়লার নোটবুক। চাইলে পুলিশকেও দিতে পারতাম। মাহাতাবের হাতে গুঁজে দিতে দিতে ক্ষোভে, ঘৃণায় ফেটে পড়ে সে।
তো, আমাকে দিচ্ছেন কেনো? ঠাণ্ডা মাথায় বাইকের স্টার্ট বন্ধ করে, মাহাতাব স্বভাবসুলভ ভাবেই প্রশ্ন ছুড়ে দেয়।
পড়ে দেখবেন কেমন, পুলিশের হাতে পড়লে হয়তো অনেক অপ্রিয় সত্য বেরিয়ে আসতে পারে। তার চেয়ে বরং আপনার কাছেই নিরাপদে থাকুক শায়লার শেষ চিহ্নটুকু। অক্ষয় হোক তার একতরফা প্রেম। মাহাতাব নোটবুকটি হাতে নেয়। তারপর পুনরায় বাইক স্টার্ট দিয়ে চলে যেতে উদ্ধত হয়।
শায়লা গতকাল পর্যন্তও আপনাকে ভালোবাসতো। হাসান মাসুদের এই ক্ষীণ শব্দের তীব্র আর্তনাদে প্রতিধ্বনিত হয় যেনো শায়লারই শেষ সংলাপ। মাহাতাব শুনলো কি শুনলো না, বুঝা যায় না। ঘাড় ঘুরিয়ে নির্বিকার তাকিয়ে থাকে হাসান মাসুদের মুখের দিকে। সে দৃষ্টিতে কোনো রূঢ়তার প্রকাশ নেই কিন্তু শব্দহীন পৈশাচিকতায় লিখা আছে, শায়লার পরিণতির পুনরাবৃত্তি এই শহরে ঘটতেই পারে। এই প্রথমবার নিজেকে অনেকটা নির্বোধ মনে হয় হাসান মাসুদের, পরাজিত মনে হয়, অসহায় বোধ হয় শহরের আলো বাতাসের কাছে। শায়লার না পাঠানো চিঠির সংলাপে এতটুকু বিবেক যন্ত্রণা হবে না মানুষটির, বুঝা যায় তার অক্ষিগোলকের জ্বলজ্বলে আভায়। তবে আর কতোটা কী ঘটলে মানুষের অনুভূতিকে নাড়া দেয়া যায়, জানা নেই তার। ঠোঁটের কোণে একটুকরো বিজয়ের হাসি নিয়ে ছুটে চলে মাহাতাবের দুরন্ত মোটরবাইক। পৃথিবীর সকল নিস্তব্ধতা বুকে নিয়ে নির্বাক তাকিয়ে থাকে হাসান মাসুদ। বরইতলা থেকে ভেসে আসে শায়লার কণ্ঠস্বর-"They all broke the rules. They all crossed into forbidden territory. They all tampered with the laws that lay down who should be loved, and how. And how much"