প্রকাশ : ০৭ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০
মানবাধিকার : মানবাধিকারের অন্তর্নিহিত বিষয় হচ্ছে ‘মানুষ’ ও ‘অধিকার’। শব্দ দু’টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যমন্ডিত! মানুষের অস্তিত্ব রক্ষা, সহজাত ক্ষমতার সৃজনশীল বিকাশ এবং মর্যাদাপূর্ণ জীবন-যাপনের জন্য একান্তভাবে প্রয়োজনীয় কতিপয় অধিকার হচ্ছে মানবাধিকার। সহজভাবে ‘মানবাধিকার’ বলতে আমরা সেই সব অধিকারকে বুঝি যা নিয়ে মানুষ জন্মগ্রহণ করে এবং যা তাকে পরিপূর্ণ মানুষে বিকশিত করতে সাহায্য করে এবং যা হরণ করলে মানুষ আর মানুষ থাকে না। অধিকারগুলো মানুষের মূল্য ও মর্যাদার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এবং মানুষরূপে জন্মলাভ করার কারণে তার জন্মগত অধিকার। আল্লাহ তা’আলা মানুষকে আশরাফুল মাখলুকাত বা সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে সৃষ্টি করেছেন। আর এ শ্রেষ্ঠত্বের শিখরে উঠতে দরকার মানবাধিকার। এ অধিকার ছাড়া মানুষের পূর্ণতা আসে না, মানুষ পরিপূর্ণরূপে মানুষ হয়ে উঠতে পারে না। মানুষের জীবন-মৃত্যু যেমন মানুষ থেকে অবিচ্ছেদ্য তেমনি তার জন্য কতিপয় এ মৌলিক অধিকারও অপরিহার্য ও অবিচ্ছেদ্য। সমকালীন বিশ্বে দুর্বলদের উপর সবলদের নির্যাতন ও নিপীড়নের কারণে মানবাধিকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। অথচ সপ্তম শতকের শুরুতেই বিশ্ব ইতিহাসের সবচেয়ে প্রবল, সর্বাধিক প্রভাবশালী, সর্বোচ্চ কার্যকর, সামগ্রিক কল্যাণকর মানবাধিকারের ধারণা নিয়ে এ ধরায় আবির্ভূত হয়েছিল ইসলাম। ইসলামে জীবন দর্শন যেমনি পরিপূর্ণ, মানবাধিকারের ধারণাও তেমনি ব্যাপক ও পূর্ণাঙ্গ। এর আলোকে পরবর্তী কয়েকটি দশক বিশ্বমানবতা প্রকৃত মুক্তি, অধিকার ও সম্মানে উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছিল। পৃথিবীর সব দেশ, সব সমাজবিজ্ঞানী ও দার্শনিকদের চিন্তায় মানবাধিকার যেখানে একটি নিছক আদর্শবাদী ধারণা ও প্রত্যয়মাত্র, সেখানে ইসলামে মানবাধিকার হলো বাস্তবতা। নি¤েœ ইসলামে মানবাধিকারের দৃষ্টিভঙ্গি সংক্ষেপে আলোকপাত করা হবে।
ইসলামে মানবাধিকার : ইসলাম সব ধরনের মানবিক অধিকার ভোগ করাকে সকলের জন্য উম্মুক্ত করেছে। মানুষ কী কী অধিকার ভোগ করবে, অধিকারের সীমা কী হবে, অধিকার ভোগ করতে গিয়ে মানুষের আচরণ ও ভূমিকা কী হবে, অন্যের অধিকার বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য মানুষ কী কী পদক্ষেপ নেবে এ সব বিষয়ে ইসলাম সুস্পষ্ট, সুনির্দিষ্ট, সুবিন্যস্ত ও সুসামঞ্জস্যপূর্ণ নির্দেশনা দিয়েছে। যেমন-
জীবনের নিরাপত্তা লাভের অধিকার : ইসলাম মানবজীবনকে একান্তই সম্মানের বস্তু হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে এবং একটি মানুষের জীবন সংহারকে সমগ্র মানবগোষ্ঠী হত্যার সমতুল্য সাব্যস্ত করে জীবনের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছে, যার নজীর পৃথিবীর কোন ধর্মীয়, নৈতিক কিংবা আইন শাস্ত্রীয় সাহিত্যে কোথাও পাওয়া যায় না। আল্লাহ তা’আলা বলেন, “নরহত্যা বা পৃথিবীতে ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপের অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তি ব্যতিরেকে কেউ কাউকে হত্যা করলে সে যেন পৃথিবীর সমগ্র মানব গোষ্ঠীকে হত্যা করল, আর কেউ কারো প্রাণ রক্ষা করলে সে যেন পৃথিবীর সমগ্র মানব গোষ্ঠীকে প্রাণে রক্ষা করল।” (আল কুরআন: সূরা আল মায়িদা-৩২) আল্লাহ তা’আলা আরো বলেছেন, “আল্লাহ যে প্রাণ হত্যা নিষিদ্ধ করেছেন যথার্থ কারণ ব্যতিরেকে তাকে হত্যা কর না।” (আল কুরআন: সূরা বনী ইসরাঈল-৩৩) আল্লাহ তা’আলা আরো বলেছেন, “এবং কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে কোন মুমিন ব্যক্তিকে হত্যা করলে তার শাস্তি জাহান্নাম, যেখানে সে স্থায়ী হবে এবং তার প্রতি আল্লাহর গযব ও অভিসম্পাত এবং তিনি তার জন্য মহাশাস্তি প্রস্তুত রেখেছেন।”(আল কুরআন: সূরা আন নিসা-৯৩) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “হে মানবজাতি! নিশ্চয়ই তোমাদের জীবন, সম্পদ এবং সম্ভ্রম আজকের দিনের (বিদায় হজ্বের ভাষণের দিন) মতই পবিত্র।” (সহীহ আল বুখারী) বিদায় হজ্জ্বের ভাষণে রাসূল (সাঃ) জাহিলী যুগের সকল হত্যার প্রতিশোধ রহিত করে বললেন, “জাহিলী যুগের যাবতীয় হত্যা রহিত হল। প্রথমে যে হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণ আমি রহিত করলাম তা হচ্ছে আমার বংশের রবীআ ইবনুল হারিস এর দুগ্ধপোষ্য শিশু হত্যার প্রতিশোধ, যাকে হুযাইল গোত্রের লোকেরা হত্যা করেছিল। আজ আমি তা ক্ষমা করে দিলাম।” (সহীহ আল বুখারী)
এমনকি ইসলামি রাষ্ট্রে বসবাসকারী কোন অমুসলিম নাগরিককে অন্যায়ভাবে হত্যা করলে হত্যাকারীর জন্য জান্নাত হারাম হয়ে যাবে। রাসূল (সাঃ) বলেছেন, “যে ব্যক্তি কোন জিম্মিকে (অমুসলিম নাগরিক) হত্যা করবে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাত হারাম করে দিবেন।” (সুনানে নাসাঈ) তিনি আরো বলেছেন, “যে ব্যক্তি চুক্তিবদ্ধ কোন অমুসলিমকে হত্যা করল সে কখনো জান্নাতের সুগন্ধিও পাবে না।” (সহীহ আল বুখারী) এভাবে কুরআন ও সুন্নাহ্-তে মানুষ হত্যাকে এক জঘন্য পাপ ও আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে এবং হত্যাকারীকে হুদুদ (হুদুদ হচ্ছে আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে বর্ণিত অপরাধের নির্ধারিত শাস্তি। এর বিপরীতে রয়েছে তাযির-এর শাস্তি যা ইসলামী আদালত অবস্থাভেদে নির্ধারণ করে থাকে) পর্যায়ের শাস্তি ‘কিসাস’ দণ্ডে দণ্ডিত করা হয়েছে। যেমন কুরআনে আল্লাহ তা’আলা বলেছেন, “হে বিশ্বাসিগণ! হত্যার ব্যাপারে তোমাদের ওপর কিসাস ফরয করা হয়েছে; স্বাধীনের পরিবর্তে স্বাধীন, দাসের পরিবর্তে দাস এবং নারীর পরিবর্তে নারী।” (আল কুরআন: সূরা আল বাকারা-১৭৮)
(চলবে)