প্রকাশ : ০৯ নভেম্বর ২০২১, ০০:০০
রাতে খাবার টেবিলে আদনানের মা যখন তাকে প্রশ্ন করলো, “বাবু, কালকে কি তোর স্কুল আছে?” তখন আদনান কোনো উত্তর দিলো না। মায়ের দিকে বেশ গম্ভীর ভাবে তাকিয়ে থাকলো। কারণ সে আর এখন স্কুলে পড়া বাচ্চা নয়! কলেজ করছে এক সপ্তাহ ধরে!
কলেজে উঠার পর প্রথম প্রথম বাসার মানুষেরা এমন ভুল করেই থাকে। এতে মন খারাপ করার কিছু নেই। আস্তে আস্তেই ঠিক হয়ে যাবে সব কিছু। দশ দশটা বছর শেষে নতুন নতুন কলেজে উঠে সবার মধ্যেই একটা “বড় ভাই-বড় ভাই” ধরনের ভাব দেখা যায়। বয়ঃসন্ধিকালের এই পর্যায়ে কলেজ জীবনকে অসম্ভব রঙিন লাগতে থাকে অনেকের কাছে। আর সামনে এসে খুলে যায় হাজারটা রঙিন পথ। রঙিন বলেই যে সব পথ ভালো এমনটা কিন্তু না। নানা রঙের পথের মাঝে আছে শত শত চোরাবালি!
একটু বেশি কঠিন কথা বলে ফেলছি কি? একটু সহজ করে বলি। কলেজ জীবনে যেমন নিজেকে ভালো ভালো কাজের সাথে যুক্ত রাখা যায় তেমনই চাইলে নানা নেতিবাচক বিষয় আছে, যেগুলোর মধ্যে একবার নিজেকে জড়িয়ে ফেললে সেখান থেকে বের হওয়া অনেক সমস্যার ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। অনেকটা চোরাবালির মতন। আটকা পড়ে গেলে তো শেষ!
তাই চলো রঙিন কলেজ জীবনের চলার পথে লুকিয়ে থাকা নানা চোরাবালি সম্পর্কে জেনে নিজেকে সতর্ক করে নেই এখনই!
ফার্স্ট ইয়ার ড্যাম কেয়ার
এসএসসি পরীক্ষার আগে নবম-দশম শ্রেণি হিসেবে ২ বছরের বেশি সময় হাতে পাওয়া যায়। আর এতো সময়ের জন্যে পড়ার পরিমাণ খুবই কম। এই অল্প সিলেবাস শেষ করার জন্যে অনেক ছাত্রই নবম শ্রেণিকে একদমই গুরুত্ব দেয় না। পরবর্তীতে তারা দশম শ্রেণিতে উঠে ভালোমতো পড়ে সিলেবাস কভার করে ফেলে খুব সহজেই।
কলেজে উঠার পরে যদি তুমি তোমার মনে সেই একই রকম ধারণা রেখে দাও, তাহলে এখনই সতর্ক করি, তোমাকে ভয়ংকর বিপদের সম্মুখে পড়তে হবে সেকেন্ড ইয়ারে উঠে। কারণ কলেজে প্রায় প্রতিটা বিষয়েরই দুটি করে পত্র থাকে। আর একেক পত্রের সিলেবাসই থাকে অনেক বড়। যদি সব মিলে যোগ করি নবম-দশম শ্রেণির তুলনায় কলেজের সিলেবাস প্রায় দুই থেকে তিন গুণ বড়! আর সব থেকে কঠিন সত্যি হলো, তুমি ঠিকমতো ২ বছর সময়ও পাবে না সিলেবাস শেষ করার জন্যে!
তাই নবম-দশম শ্রেণিতে যা করার করেছো, কলেজে উঠে যদি ফার্স্ট ইয়ারকে গুরুত্ব না দাও, তাহলে পরবর্তীতে এই সিলেবাস শেষ করা তোমার জন্যে প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। আর এই অসম্ভবকে সম্ভব করার জন্য তোমাকে নায়ক হতে হবে না! ফার্স্ট ইয়ারকে গুরুত্ব দিয়ে পড়ালেখা শুরু করে দাও আজ থেকেই।
দূরে থাকো ড্রাগস থেকে!
বয়ঃসন্ধিকালের এমন এক সময়ে তুমি কলেজে উঠেছো যখন তোমার মনে থাকে নানা বিষয়ের কৌতূহল। আর দুর্ভাগ্যজনকভাবে অনেকেই এই কৌতূহলের বসে ঝুঁকে পড়ে মাদকের দিকে!
একটা বিষয় মাথায় রেখো, শুধু কলেজ জীবনের জন্যে না, মাদক তোমার সারাজীবনের জন্যেই চোরাবালির মতো। যেদিন থেকে তুমি নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়বে সেদিন থেকে তোমার পড়ালেখা, ব্যবহার, স্বাস্থ্য সব কিছু তার স্বাভাবিক গতি হারিয়ে ফেলবে এবং দিন শেষে মাদক তোমার ক্ষতি ছাড়া আর কিছুই করবে না।
শুধু কৌতূহলের কারণে নয়, তুমি যদি সঠিক সঙ্গ নির্বাচনে ব্যর্থ হও তাহলে তাদের পাল্লায় পড়েও অনেক সময় তুমি মাদকাসক্ত হয়ে উঠতে পারো। তাই বরাবরের মতোই সঠিক বন্ধু নির্বাচনে মনোযোগী হবার পরামর্শ থাকছে তোমাদের জন্য। আর নিজেকে মাদকদ্রব্য থেকে সব সময় দূরে রেখো।
নিজেকে পড়ার সময় দাও
নতুন নতুন কলেজে অনেক অনেক বই দেখতে হয় চোখে। আমি যখন প্রথম শুনেছিলাম তখন বলেছিলাম “কেমিস্ট্রিতেও সেকেন্ড পেপার! এতোগুলো বই পড়তে হবে!” এমন চিন্তা করে অনেকে ভয় পেয়ে যায় খুব। তারা তখন শুরু করে দেয় বিভিন্ন কোচিং-এর পেছনে দৌড়ানো। এই ব্যাপারটা পরবর্তীতে এমন হয়ে দাঁড়ায় যে, অনেকে প্রায় ৬-৭টা করে প্রাইভেট পড়া শুরু করে একই সাথে! বিষয়টা সত্যিই ভয়ংকর।
সারাদিনের কলেজ শেষে এতগুলো করে প্রাইভেট পড়ে যখন তুমি রাতে পড়তে বসবে তখন নিজেকে ক্লান্ত মনে হবে খুব। আর তারপর পড়ালেখায় মনযোগী হয়ে ওঠা তোমার জন্যে অনেক কষ্টকর একটা বিষয়ে পরিণত হবে। তাই যতোটা পারো নিজে নিজে পড়ার চেষ্টা করো। প্রাইভেট কিংবা কোচিং সেন্টারে সময় বেশি না দিয়ে নিজেকে পড়ার জন্যে বেশি সময় দাও। কলেজ জীবনে সব কিছুর উপরে তোমার প্রায়োরিটি হওয়া উচিত ব্যক্তিগত পড়াশোনা। আর ব্যক্তিগত পড়াশোনার সময় সাহায্যের জন্যে ১০ মিনিট স্কুলের ভিডিও, লাইভ ক্লাসগুলো তোমাকে সাহায্য করবে অনেক।
সোশ্যাল মিডিয়াতে সারাবেলা!
বর্তমানে বিভিন্ন কলেজের ব্যাচভিত্তিক ফেসবুক পেইজ থাকে। ধরো তোমার কলেজের নাম অইঈ, ফেসবুকে বিভিন্ন পেইজ থাকবে অইঈ ইধঃপয-২০, অইঈ ইধঃপয-২০ ঃৎড়ষষং!, অইঈ ইধঃপয-২০ ঈৎঁংয ধহফ পড়হভবংংরড়হং! ইত্যাদি হরেক রঙের ফেসবুক পেইজ খুলে “কোন ছাত্র কী করলো, কোন স্যার কী বললো” এসব নিয়ে ট্রল তৈরি করে ফেসবুকে আপলোড করা হয়।
বিষয়টা বেশ মজার ও গা গরম করার মতো মনে হলেও শেষ পর্যন্ত নিজের মূল্যবান সময় নষ্ট করা ছাড়া আর কিছুই হয় না। কলেজে পড়া লেখার বদলে ট্রল তৈরি করে তুমি খুব সহজেই যে সময়গুলোকে নিশাদলের দানার মতো বাতাসে উড়িয়ে দিচ্ছো, সেই সময়গুলোর জন্যে পরবর্তীতে আফসোস করতে হবে তোমাকেই।
তাই সোশ্যাল মিডিয়াতে এসব পেইজ বা গ্রুপকে অ্যাভয়েড করে নিজের ভালোর জন্যে বিভিন্ন শিক্ষণীয় গ্রুপে যুক্ত থাকতে পারো। ফলে, তুমি সোশ্যাল মিডিয়াতে সময় পার করবে নানা ধরনের নতুন জিনিস শেখার মাধ্যমে। আর তার জন্যে আছে বাংলাদেশের সব থেকে বড় এডুকেশনাল গ্রুপ ১০ মিনিট স্কুল লাইভ! যেখানে প্রায় ১১ লাখ শিক্ষার্থী তাদের নোট এবং পড়ালেখার টিপস্ শেয়ার করে প্রতিনিয়ত!
গ্রুপে জয়েন করতে ভিজিট করো [যঃঃঢ়ং://িি.িভধপবনড়ড়শ.পড়স/মৎড়ঁঢ়ং/১০৪৪৬৩৭৩২২২৮৮৬০৪/]
কালো স্রোতেকে এড়িয়ে সাদা স্রোতে ঝাপিয়ে পড়ো!
কী? পয়েন্ট থেকে তেমন কিছু বোঝা যাচ্ছে না তাইতো? চলো বুঝে নেই।
কলেজে উঠার পর অনেকে দেখা যায় অন্যের অনুকরণ করা শুরু করতে থাকে। বিষয়টা বেশ দুঃখজনক যে, ভালো জিনিস অনুকরণের তুলনাতে খারাপ জিনিস অনুকরণের দিকে শিক্ষার্থীরা বেশি ঝুঁকে পড়ে।
“আমার অমুক বন্ধু এত দামের স্মার্টফোন ব্যবহার করছে, আমারও চাই স্মার্টফোন”; “সবাই প্রেম করছে! গার্লফ্রেন্ড নিয়ে ঘুরছে! আমিও করি”; “সবাই টাকা খরচ করে কনসার্টে যাচ্ছে, আমিও যাবো”; “সবাই মুভি দেখে ফেসবুকে ওয়াচিং লিখে পোস্ট দিচ্ছে, আমাকেও মুভিটা দেখতে হবে। এক্ষণই!” এই ধরনের স্রোতে থেকে নিজেকে দূরে রাখার চেষ্টা করো। এসব স্রতে তোমার সময় নষ্ট করবে প্রচুর পরিমাণে আর তোমাকে নিয়ে যাবে ভুল পথে। এমন না যে তুমি কনসার্ট কিংবা মুভি দেখতে পারবে না। অবশ্যই পারবে কিন্তু আরেক জন করছে দেখে আমাকেও করতে হবে এমন পন্থাকে এড়িয়ে চলো। কালো স্রোতে পড়লে তোমাকে ভুগতে হবে অনেক!
তাহলে সাদা স্রোতে কোনগুলো?
“আমার বন্ধুরা ডিবেট শেখা শুরু করেছে, আমিও শিখবো”; “আমার বন্ধুরা ত্রিকোণমিতি ২টা অনুশীলনী আগে আগে শেষ করে ফেলেছে, আমিও করবো”; “আমার বন্ধুরা নিয়মিত কলেজে আসে, আমিও আসবো”। হয়তো এতোক্ষণে বুঝেই ফেলেছো কীসের কথা বলছি। যেদিক থেকে ভালো স্রোতে আসছে, শেখার আছে অনেক কিছু, সেই স্রোতকে আপন করে নাও। ভেসে যাও সেই সাদা স্রোতে। একটা কথা মাথায় রেখো,
“ঊধমষবং উড়হ’ঃ ঋষু ডরঃয চরমবড়হং”
হাজার কবুতরের ঝাঁক দেখে তাদের পিছে পিছে উড়ে যাওয়ার মতো ভুল কখনোই করো না।
গাইডবুক : কিছু জিনিস দূর থেকেই সুন্দর
তোমাদেরকে একটা কথা তো বলাই হয়নি! স্কুল জীবনে বছরের শুরুতে যখন ক্লাস করতে যেতে, সরকার থেকে বোর্ডের নতুন চকচকে বই নিয়ে বাসায় ফেরা হতো। কত মজার ছিলো সেই দিনগুলো! কিন্তু কলেজ শুরুর পর থেকে আর সেই মজা নেই, ভারি ভারি বই কেনা লাগবে নিজের পকেট থেকেই। তার উপর বড় সমস্যা হলো, কোন নির্দিষ্ট বিষয়ের জন্যে নির্দিষ্ট কোন বই নেই। বাজারে অনেক লেখকের অনুমোদিত বই পাওয়া যায়, তাদের বই ফলো করেই পড়তে হয়।
সবসময় চেষ্টা করো কলেজে যে বই পড়ানো হয় সেগুলোর সাথে বিখ্যাত লেখকদের বই পড়তে। কোন বিষয়ের জন্যে নামকরা ২টা বই পড়াই যথেষ্ট। আর আমাদের দেশে প্রতি বিষয়েই একাধিক ভালো ভালো বই আছে। যে বইগুলো অনেক পরিপূর্ণ এবং সহজ ভাষায় রচিত।
তারপরেও দেখা যায় অনেকে বই পড়তে যেয়ে হিমশিম খেয়ে শরণাপন্ন হয় নানা ধরনের গাইড বইয়ের। গাইড বই ব্যবহার করতে পারো পদার্থবিজ্ঞানের অংক করার জন্যে, অথবা মাঝে মাঝে নির্দিষ্ট বিষয় সম্পর্কে জ্ঞান নেয়ার জন্যে। কিন্তু গাইডকে প্রাধান্য দিয়ে মূলবই না পড়া অনেক বড় ধরনের ভুল। তাই রংচঙে সব গাইড বইয়ের পেছনে দৌড়ে নিজের পড়ার বইকে ভুলে যেও না কখনোই।
প্র্যাক্টিক্যাল জমিয়ে রেখো না
এর আগেও তোমাদেরকে বলেছি, স্কুল জীবনের ব্যবহারিক আর কলেজ জীবনে ব্যবহারিকের মাঝে বেশ পার্থক্য রয়েছে। এখানে সায়েন্সের সবগুলো সাবজেক্টে দুই পত্রেই আছে ২৫ নম্বরের ব্যবহারিক।
কলেজে রেগুলার ক্লাসের সাথে ল্যাবরেটরিতে যা যা কাজ করেছো তার ল্যাব রিপোর্ট সাবমিট করতে হয় নির্দিষ্ট দিন পরপর। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় ছাত্ররা ফার্স্ট ইয়ারে যা কাজ করেছে তার ল্যাব রিপোর্ট নিয়মিত শেষ করে ল্যাবরেটরি ইন্সট্রাকটরের স্বাক্ষর নিয়ে রাখেনি। পরবর্তীতে সেকেন্ড ইয়ারে তাদের পড়ার চাপের সাথে বাড়তিভাবে যুক্ত হয় ফার্স্ট ইয়ারের প্র্যাক্টিকাল খাতা লেখার কাজ। সেই খাতা সম্পন্ন করতে গিয়ে ব্যাপকভাবে পড়ালেখার ক্ষতি হয়।
তাই প্রতিদিনের ল্যাব রিপোর্ট প্রতিদিন লিখে আগে থেকেই স্বাক্ষর নিয়ে রাখলে দিন শেষে আর তোমাকে অতিরিক্ত চাপের মুখে পড়তে হবে না।
শিক্ষাজীবনে যে কোন ছাত্রের কলেজে পার করা ২ বছর সময় অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এই সময়কে তুমি যত সুন্দর এবং প্রোডাক্টিভভাবে ব্যবহার করবে পরবর্তীতে তুমি ততোই লাভবান হবে। তাই এরকম চোরাবালি থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রেখে সামনে এগিয়ে যাও প্রতিনিয়ত। দেখবে সকলের জন্যেই ভালো কিছু অপেক্ষা করছে।
স্বত্ব : ১০ মিনিট স্কুল।