প্রকাশ : ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০
রাষ্ট্র সংস্কার শুরু হোক শিক্ষাঙ্গনে সংস্কার দিয়ে
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালে ২০১০ সালে লিখেছিলাম, ছাত্র রাজনীতি চালু করতে হবে। অর্থাৎ ছাত্র রাজনীতির নামে এতদিন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যা চালু ছিল, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা ছাত্র রাজনীতি ছিল না। ছাত্র ও শিক্ষক রাজনীতির নামে দলবাজির কারণে শুধু শিক্ষাঙ্গনে পড়াশোনার পরিবেশই বিঘ্নিত হয়নি; একই সঙ্গে উচ্চশিক্ষার মূল উদ্দেশ্যও ব্যাহত হয়েছে। আবাসিক হলগুলো ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের পুনর্বাসন কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। গত ১৫ বছরে অন্তত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজে দেখেছি কীভাবে ছাত্রলীগ আবাসিক হলগুলোতে প্রশাসনের সহায়তায় সিট বাণিজ্য করে শিক্ষার্থীদের জিম্মি করে রেখেছিল। ছাত্রলীগ নেতাদের গণরুম সংস্কৃতি আর টর্চার সেলে নিরপরাধ শিক্ষার্থীরা নির্যাতনের শিকার হতেন নিয়মিত। তাদের রাজনীতি না করলে এবং তাদের মিছিল-মিটিংয়ে যাওয়া ছাড়া হলে সিট মিলত না।
উপাচার্য ও শিক্ষক নিয়োগ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যোগ্যতার চাইতে দলীয় বিবেচনাই প্রধান হয়ে দাঁড়িয়েছিল। যে কারণে ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সরকার পরিবর্তনের পর হয়তো পরিণতির কথা ভেবেই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক উপাচার্য নিজ থেকে পদত্যাগ করেছেন। আবার অনেকে পদত্যাগ করেছেন বিক্ষোভের মুখে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পদত্যাগের এ ধারা অন্তত এ সময়ে আরও চলতে থাকবে। দলীয় বিবেচনায় শিক্ষক নিয়োগের কারণে মেধার মূল্যায়ন হয়নি।
হলগুলোতে ছাত্রলীগের দৌরাত্ম্য কতটা ভয়ংকর ছিল, তার উদাহরণ বুয়েটের শহীদ আবরার ফাহাদ। গত দেড় দশকে ছাত্র রাজনীতির নির্মম শিকারে পরিণত হয়ে আরও অনেক শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন, অনেক শিক্ষার্থীর স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে এবং অনেক শিক্ষার্থীকে হলছাড়া করা হয়েছে। ২০১৯ সালে ছাত্রলীগের নির্যাতনে আবরার ফাহাদ নিহত হওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়ে নিপীড়নের কিছু চিত্র সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ হয় বটে। শিক্ষার্থী নিপীড়নের সঙ্গে ছাত্রলীগের সহযোগী যেমন শিক্ষকরা ছিলেন, তেমনি পুলিশ বাহিনীর ভূমিকাও কম নয়।
বলা বাহুল্য, এসব নিপীড়নের কারণেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে শিক্ষার্থীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ দেখা গেছে। জনরোষের ভয়ে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশত্যাগের পর তো বটেই, তার কয়েক দিন আগেই আমরা দেখেছি কীভাবে শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্রলীগ নেতাদের তাড়িয়েছিলেন। ক্যাম্পাস এখন ফ্রাঙ্কেনস্টাইনমুক্ত বলেই শিক্ষার্থীরা উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে লেজুড়বৃত্তির ছাত্র রাজনীতি বন্ধের দাবি জানাচ্ছেন।
এতদিনের লেজুড়বৃত্তির ছাত্র ও শিক্ষক রাজনীতির কারণে উচ্চশিক্ষা বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে, তা থেকে সহজে উত্তরণ সম্ভব নয়। ইতোমধ্যে অনেক অযোগ্য শিক্ষকের নিয়োগ হয়েছে, যোগ্যরা বঞ্চিত হয়েছেন। ক্ষমতাসীন রাজনীতি যারা করতেন, তারা হেন অনিয়ম নেই যে করেননি। তারপরও সত্যিকার অর্থে যদি ন্যায়ের চর্চা শুরু হয়, তবে পরিস্থিতির বদল দূরের বিষয় নয়। সে জন্য শুরুতেই হাত দিতে হবে উপাচার্য নিয়োগে।
বিস্ময়কর হলেও সত্য, দেশের চারটি স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়– ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উপাচার্য নিয়োগের নির্দিষ্ট কোনো নিয়ম নেই। এমনকি স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নিয়ম থাকলেও রাজনৈতিক পরিচয়ই মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৭৩ সালের আইন অনুসারে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সিনেট তিনজন শিক্ষাবিদকে মনোনীত করবে। সেখান থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য বা রাষ্ট্রপতি একজনকে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেবেন। অথচ এই নিয়োগের ব্যত্যয় ঘটিয়েই সরাসরি উপাচার্য নিয়োগ দিয়েছেন আচার্য। অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনেক ক্ষেত্রে সরকারের আস্থাভাজন শিক্ষক নেতারা পুরস্কার হিসেবে উপাচার্য পদে নিয়োগ পেয়েছেন। ২০২২ সালে প্রকাশিত ডয়চে ভেলের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আওয়ামী লীগপন্থি শিক্ষকরা ১৩টি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। উপাচার্য নিয়োগের ক্ষেত্রে যেমন সংস্কার আনতে হবে, তেমনি ছাত্রদের কল্যাণে যাতে ছাত্র রাজনীতি পরিচালিত হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। আমরা দেখেছি ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সরকার বদলে রাষ্ট্র সংস্কারের দাবি যেমন উঠেছে, শিক্ষা সংস্কারের কথাও বলছেন অংশীজন। রাষ্ট্র সংস্কার হলে নিশ্চয় সব খাতেরই সংস্কার জরুরি হবে। বর্তমানে শিক্ষাক্ষেত্রে মোটাদাগে দুটি ধারা চলছে। এর মধ্যে প্রথমটি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা, দ্বিতীয়টি উচ্চশিক্ষা।
ওপরে উচ্চশিক্ষা নিয়ে কথা বলেছি। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় বিগত সরকার নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন শুরু করেছিল; ২০২৬ সালে যার পূর্ণতা পাওয়ার কথা। সরকার বদলের কারণে অনেকেই নতুন শিক্ষাক্রম বাতিলের দাবি জানিয়েছেন। ইতোমধ্যে গুজবও উঠেছিল এবং বাতিলের দাবিতে আগে যেমন প্রতিবাদ হয়েছে, সম্প্রতিও তা দেখেছি। নতুন শিক্ষাক্রমের নানা সমস্যা আছে। নিজেও গত মাসে এর মূল্যায়ন পদ্ধতির সংকটের জায়গাগুলো চিহ্নিত করে লিখেছি। আমি মনে করি, ইতোমধ্যে বাস্তবায়নাধীন এ শিক্ষাক্রম একেবারে বাতিল না করে বরং এর সমস্যার জায়গাগুলো চিহ্নিত করে সেখানে সংশোধনী আনা দরকার। ফিনল্যান্ডের চিন্তা বাদ দিয়ে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে দেশের অধিকাংশ বিদ্যালয়ের অবকাঠামো, শিক্ষকদের যোগ্যতা ও দক্ষতার কথা মাথায় রেখে নতুন শিক্ষাক্রম সাজানো কঠিন হবে না। এ শিক্ষাক্রম একেবারে বাতিল করে অতীতে বারবার শিক্ষানীতি প্রণয়নের মতো খারাপ দৃষ্টান্ত স্থাপন করা ঠিক হবে না।
দেড় মাস ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ থাকার পর রোববার থেকে খোলার নির্দেশ দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। স্থগিত হওয়া এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা পুনরায় শুরু হচ্ছে ১১ সেপ্টেম্বর থেকে। প্রায় এক মাস পর প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের শ্রেণি কার্যক্রম চালু হয়েছে। এতদিন বন্ধ থাকার কারণে শিক্ষার যে ক্ষতি হয়েছে, তা নিরূপণ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হোক।
এটাও বলা দরকার, সারাদেশে শিক্ষার্থীরা যেভাবে স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনে যোগ দিয়ে অভ্যুত্থান ঘটিয়েছেন, তা অভূতপূর্ব। এরপর সড়কে ট্রাফিকের দায়িত্ব পালন, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অভিযানসহ নানা জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজ তারা করেছেন। তাদের প্রাথমিক বিজয় অর্জিত হয়েছে। কিন্তু ভবিষ্যৎ রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তুতির স্বার্থেই শিক্ষার্থীদের শ্রেণিকক্ষে ফিরতে হবে। প্রত্যাশা করি, সরকার বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার পরিবেশ ফেরাতে প্রতিষ্ঠানগুলোতে দ্রুত যোগ্য উপাচার্য ও প্রতিষ্ঠানপ্রধান নিয়োগ দেবে এবং ছাত্র সংগঠনগুলো প্রকৃতই ছাত্রদের কল্যাণের রাজনীতি শুরু করবে।