প্রকাশ : ২১ মে ২০২৪, ০০:০০
স্বাধীনতা পুরস্কারপ্রাপ্ত শিক্ষক ওয়ালীউল্লাহ পাটোয়ারী
শিক্ষাই শক্তি। শিক্ষার আলোয় আলোকিত হয় দেশ ও জাতি। তাই শিক্ষকরা হলেন আলোর ফেরিওয়ালা। চাঁদপুরের এমনি একজন আলোকিত মানুষ বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ওয়ালীউল্লাহ পাটোয়ারী। শিক্ষক হিসেবে আমৃত্যু তিনি শিক্ষার প্রসারে কাজ করে গেছেন। বাংলাদেশ সরকার শিক্ষায় অসামান্য অবদানের জন্যে তাঁকে ১৯৮১ সালে স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত করে।
ওয়ালীউল্লাহ পাটোয়ারী ফরিদগঞ্জের পশ্চিম জয়শ্রী গ্রামের সন্তান। জন্ম ১৯০৫ সালের ১৫ মার্চ। গ্রামের স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ শেষে ১৯১৯ সালে বাবুরহাট হাইস্কুলে ভর্তি হন। প্রথম বিভাগ পেয়ে তিনি ১৯২৪ সালে মাধ্যমিক এবং কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে ১৯২৬ সালে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন। এরপর ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এখান থেকে ১৯২৯ সালে বিএসসি পাসের পর শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। তাঁর প্রথম কর্মস্থল ছিল মতলবগঞ্জ জেবিএইচই স্কুল। মাত্র ২৪ দিন তিনি তৃতীয় শিক্ষক পদে কর্মরত ছিলেন। এরপর তাঁকে বিভাগীয় ইন্সপেক্টর স্কুলের প্রধান শিক্ষক পদে নিযুক্ত করেন। কিছু সময়েই প্রধান শিক্ষক হিসেবে তাঁর সুনাম চাঁদপুরের গণ্ডি পেরিয়ে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। খান বাহাদুর আবদুল হাকিম তাঁর সম্পর্কে বলেছেন, ‘পাটওয়ারী শিক্ষক রাজপুত্র। তাঁর জীবন ইতিহাস লিখে রাখার মত’।
ওয়ালীউল্লাহ পাটোয়ারী চারদশক শিক্ষকতা করেছেন। অসংখ্য ছাত্রের প্রিয় শিক্ষক ছিলেন তিনি। শিক্ষার্থীরাই ছিল তাঁর প্রাণ। মতলবের শিশুসংগঠক মাকসুদুল হক বাবলু তাঁর সম্পর্কে লিখেছেন : ‘১৯৩১ সালে যখন তিনি মতলব হাইস্কুলের হাল ধরেন, তখন এটি ছিলো অখ্যাত। তাঁর নেতৃত্বের কারিশমায় শীঘ্রই এটি হয়ে গেল এক বিরাট ইতিহাস। তিনি বাড়ি বাড়ি গিয়ে ছাত্র সংগ্রহ করে আনতেন। গরিব, মেধাবী ছাত্রদের আশপাশের গ্রামে জায়গীর করে নিতেন। প্রয়োজনে বিনা খরচে হোস্টেলে রেখে লেখাপড়ার সুযোগ করে দিতেন।’ ড. গাজী মো. আহসানুল কবীর লিখেছেন, আমরা শুনেছি খ্যাতিমান প্রধান শিক্ষক ওয়ালী উল্লাহ পাটোয়ারী ‘সারা দিন স্কুল পরিচালনার পর সন্ধ্যায় হারিকেন হাতে বাড়ি বাড়ি ঘুরে তার ছাত্ররা, বিশেষ করে স্কলারশিপ ও ম্যাট্রিক পরীক্ষার্থীরা ঠিকমতো লেখাপড়া করছে কি না তা দেখতে বেরোতেন। কাউকে কাউকে তখন পড়াও দেখিয়ে দিতেন।’ বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য শিক্ষাবিদ ড. আবদুল মতিন পাটোয়ারী তাঁর ছাত্র। একই সঙ্গে প্রতিভাবান এবং সৎ মানুষ হিসেবে ওয়ালীউল্লাহ পাটোয়ারী ঈর্ষণীয় সুনাম অর্জন করেন। তৎকালীন বিভাগীয় ইন্সপেক্টর জ্যোতির্ময় লাহিড়ী তাঁর কর্মকাণ্ডে মুগ্ধ ছিলেন। তাঁর মতে, ওয়ালীউল্লাহ পাটোয়ারীর মতো শিক্ষক তিনি কমই দেখেছেন।
ওয়ালীউল্লাহ পাটোয়ারী কর্মজীবনের স্বীকৃতিস্বরূপ স্বাধীনতা পুরস্কার লাভ করেন। পাকিস্তান সরকারের ‘তঘমা-ই-খেদমত’ (১৯৬২), ইস্ট পাকিস্তান বেস্ট টিচার অ্যাওয়ার্ড (১৯৬৩), কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক স্বর্ণপদক (১৯৬৭), কুমিল্লা ফাউন্ডেশন প্রদত্ত স্বর্ণপদক (১৯৮১) লাভ করেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি লেখালেখি করতেন। তাঁর রচিত ১৫টি গ্রন্থ রয়েছে। বরেণ্য এ শিক্ষক ১৯৯৯ সালের ২৫ আগস্ট মৃত্যুবরণ করেন। তাঁকে মতলব জেবি পাইলট উচ্চবিদ্যালয় মসজিদ প্রাঙ্গণে দাফন করা হয়। তাঁর নামে ‘মরহুম ওয়ালীউল্লাহ পাটোয়ারী স্মৃতিসংসদ’ রয়েছে।
সূত্র : ১. কুমিল্লা জেলার ইতিহাস, কুমিল্লা জেলা পরিষদ থেকে প্রকাশিত, পৃ. ৪২১-৪২২। ২. রত্নগর্ভা চাঁদপুর, সম্পাদনা : মোহাম্মদ সফিউল আলম, আমাদের চাঁদপুর প্রকাশনী, প্রথম প্রকাশ ২০০৭, পৃ. ২৪-২৫। ৩. নিবন্ধ : একজন শিক্ষক সমাজের ‘বাতিঘর’, ড. গাজী মোঃ আহসানুল কবীর। ৪. শতবর্ষে মতলব হাইস্কুল ও শ্রেষ্ঠ শিক্ষক ওয়ালী উল্লাহ পাটোয়ারী, মো. মাকসুদুল হক বাবলু; দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠ, ১১ জুন, ২০১৭।