প্রকাশ : ৩১ আগস্ট ২০২১, ০০:০০
গত ক’দিন পূর্বে কোনো এক জরুরি কাজে অটোরিকশায় করে উপজেলায় যাচ্ছিলাম। যাত্রী তিনজন আর দুজন সম্ভবত স্কুলছাত্র। সেটা তাদের কথাবার্তায় বুঝলাম। তাদের কথাবার্তাগুলো আমার কাছে যৌক্তিক মনে হয়েছিলো। তাদের কথায় কোনো রকম যোগ না দিয়ে শুনে যাচ্ছিলাম। তারা একজন আরেকজনকে শুধু আমাদের বেলায় যতো নিষেধাজ্ঞা, বিধিনিষেধ। করোনার আক্রমণ চলছে। শিল্প-কারখানা খোলা, দোকানপাট-হাটবাজার খোলা, শপিংমল খোলা, মাদ্রাসা খোলা, গণপরিবহন চালু, খেলাধুলা চলছে, অফিস-আদালত চলছে।
সংক্রমণের ভয় যেখানে বেশি তার সবগুলোই চলছে ঠিকঠাক মতো। গণপরিবহণ থেকে শুরু করে শিল্প-কারখানা, অফিস-আদালত, হাটবাজর, শপিংমল, রাস্তাঘাট কোথাও স্বাস্থ্যবিধি মানার কোনো চিত্র আমরা গণমাধ্যমে দেখতে পাই না। অথচ আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো খোলার সময় যতো বিপত্তি। আমারা অনলাইন ক্লাসের জন্যে বাবা-মায়ের কাছ থেকে যে মোবাইল নিলাম তার কতটুকু সদ্ব্যবহার আমরা করছি। করোনাকালীন সময়ে এই মোবাইল ফোন আমাদেরকে বিশেষ করে গ্রামের শিক্ষার্থীদেরকে অনেক পিছিয়ে দিয়েছে। মোবাইলের পেছনেই আমরা দিনের অর্ধেকে বেশি সময় ব্যয় করছি। আসলে আমাদেরকে নিয়ে তাদের ভাবনাগুলো যথেষ্ট নয়, বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারা নয়।
ধরে নিলাম আমরা যারা শিক্ষার্থী তারা সবাই বসায় আছি, কিন্তু আমাদের অভিভাবকরাতো কেউ বাসায় থাকেন না। তারা জীবন এবং জীবিকার তাগিদে কাজের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে যান। শুধু বাসায় থাকলেই কি আমরা নিরাপদ? আমারা আমাদের অভিভাবকদের দ্বারাও সংক্রমিত হতে পারি। অভিভাবকরা যখন নিয়মিত বাইরে বিভিন্ন জনের সাথে মিলেমিশে কাজ করছেন তখন আমরা ঘরে কতটা নিরাপদ? শুধু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখে শিক্ষার্থীদেরকে করোনা মুক্ত রাখা যাবে এই ভাবনাটা কতটুকু বৈজ্ঞানিক প্রায় গত দুই বছরের করোনার সংক্রমণ এবং মৃত্যুর পরিসংখ্যান যদি আমরা দেখি বয়স্ক এবং চল্লিশোর্ধ্ব ব্যক্তিরা বেশি সংক্রমিত হচ্ছেন এবং মৃত্যুবরণ করছেন। এর প্রধান কারণ হচ্ছে যারা সংক্রমিত হচ্ছেন এবং মৃত্যুবরণ করছেন তাদের শরীরে ইউমিউনিটি (রোগ প্রতিরোধ) ক্ষমতা কম এবং তারা ডায়োবেটিসসহ অন্যান্য অসুখে আক্রান্ত ছিলেন। চল্লিশ থেকে শিশুদের করোনায় সংক্রমিত কম হওয়ার কারণ তাদের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি। তারা অনেক পরিশ্রমী ও পর্যাপ্ত পরিমাণ খাদ্য গ্রহণ করে এবং তাদের হজমশক্তি বেশি। সেক্ষেত্রে আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো খুলে না দেয়ার কোনো যৌক্তিক কারণ থাকতে পারে না।
ছাত্ররা অনেক বেশি সুশৃঙ্খল, রুটিনমাফিক। তাই কর্তৃপক্ষ আরেকটু আন্তরিক এবং সচেষ্ট হলেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দিতে পারেন। করোনায় ভয় যেহেতেু আছে তাই নির্দিষ্ট কিছু নিয়ম মেনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দেয়া যেতে পারে। যদি সম্ভব হয় প্রতিটি ক্লাসের জন্যে সপ্তাহে দুদিন খোলা রাখা আর তা না হলে সপ্তাহে একদিন করে প্রতিটি ক্লাসের জন্যে বরাদ্দ করে পূর্ণাঙ্গ স্বাস্থ্যবিধি মেনে আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দেয়া যেতে পারে এবং এর মধ্য দিয়ে শিক্ষা কার্যক্রমকে নিয়মিত করা যায়। বাকি ৫ দিন বা ৬ দিনের জন্যে বহুনির্বাচনীভিত্তিক অ্যাসাইনমেন্ট দিয়ে দেয়া এবং পরবর্তী ক্লাসে প্রশ্ন ধরে ধরে উত্তর নিয়ে নেয়া যেতে পারে। গত দেড় বছরে শিক্ষার যে ক্ষতি হয়েছে তবে তা কিছুটা হলেও পুষিয়ে নেয়া যাবে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে অ্যাসাইনমেন্ট পদ্ধতি পড়াশোনা একটি সঠিক উপায় হলেও এর মধ্যে কিছু পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। অ্যাসাইনমেন্টগুলো বহুনির্বাচনী ভিত্তিক হলে তুলনামূলকভাবে ছাত্র-ছাত্রীরা বেশি উপকৃত হতো। এতে ছাত্র-ছাত্রীরা প্রশ্ন এবং উত্তর দুটোই পড়তো। আর এখন ছাত্র-ছাত্রীরা না পড়ে না বুঝে শুধু দেখে দেখে লিখে নিয়ে যায়। এতে কাজের কাজ কিছুই হয় না। অনেকটা এই প্রবাদের মতো, ‘দাদায় কইছে বানতে ধান, বাইনদা আনছি ওদা ধান।’
যে কোনো কার্যকরী উপায়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দেয়া প্রয়োজন। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শিক্ষিার্থীদের টিকার আওতায় নিতে আসা প্রয়োজন। শিক্ষার্থীদের কথার সাথে আমিও একমত হয়ে বলতে চাই সম্পূর্ণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা সম্ভব না হলে আংশিকভাবে প্রতিটি শ্রেণির জন্যে আলাদা আলাদাভাবে দৈনিক শ্রেণিরুটিনের ভিত্তেতে শিক্ষাকার্যক্রম চালিয়ে রেখে শিক্ষার্থীদেরকে পড়াশোনামুখী রাখা প্রয়োজন।
শহরের অবস্থা একটু ভালো থাকলে গ্রামের শিক্ষার্থীদের অবস্থা খুবই নাজুক। গ্রামের শিক্ষার্থীর শিক্ষার পরিবেশ এবং শিক্ষার যে ক্ষতি সাধিত হয়েছে তা পুষিয়ে নিতে নতুন পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। শিক্ষার্থীদের জীবন এবং পড়াশোনা দুটোকেই নিরাপদ রেখে দ্রুতগতিতে এগিয়ে যেতে হবে। অভিভাবকদের কর্মপরিবেশও নিরাপদ রাখতে এবং সেখানেও স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করতে হবে তাহলেই আমরা শিক্ষার্থীরা নিরাপদ থাকবো।
ঘরের দেয়াল ছাড়া দরজা যেমন মূল্যহীন ঠিক তেমনি আমাদের অবস্থা। তবে শেষ কথা এইটুকু দ্রুততম সময়ের মধ্যে টিকা নিশ্চিত করার মধ্য দিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দিয়ে আমাদেরকে প্রাণের স্পন্দন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাওয়ার সুযোগ করে দিবেন।
সুধীর বরণ মাঝি : শিক্ষক, হাইমচর সরকারি মহাবিদ্যালয়, হাইমচর, চাঁদপুর।