শুক্রবার, ২৯ নভেম্বর, ২০২৪  |   ১৬ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   ফরিদগঞ্জে সংবাদকর্মীর কন্যাকে অপহরণ চেষ্টায় অভিযুক্তদের অবিলম্বে গ্রেফতারের দাবি ফরিদগঞ্জ প্রেসক্লাবসহ বিভিন্ন সংগঠনের
  •   লক্ষ্মীপুরে মাদকসহ বাবা ও দুই ছেলে আটক
  •   চাঁদপুর সদর মডেল থানা পুলিশের অভিযানে বিভিন্ন মামলার ৮ আসামী আটক
  •   ফরিদগঞ্জ পাকহানাদার মুক্ত দিবস পালন
  •   যৌথ অভিযানে কচুয়া থানার লুণ্ঠিত পিস্তলের ৮ রাউন্ড গুলি উদ্ধার

প্রকাশ : ০৯ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০

আমাদের শিক্ষার পথ ও বিপথ

সরকার আবদুল মান্নান
আমাদের শিক্ষার পথ ও বিপথ

মানুষের কর্মের সঙ্গে তার মূল্যবোধের সম্পর্ক সবচেয়ে গভীর ও তাৎপর্যময়। দক্ষতা, সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে মানুষ যদি কোনো কাজ সম্পন্ন করতে পারে এবং সব ধরনের বৈধ কাজের প্রতি মানুষের যদি শ্রদ্ধাবোধ থাকে, তাহলে বুঝতে হবে, তার মধ্যে নাগরিক হিসেবে মূল্যবোধ তৈরি হয়েছে। যখন প্রতিজন নাগরিকের মধ্যে এই মূল্যবোধ তৈরি হয়, তখন বুঝতে হবে যে, সমাজ অনেকটা পথ এগিয়ে গেছে এবং আধুনিক ও বিজ্ঞানমনস্কতা অর্জন করেছে। পড়শুনা না-জানা মানুষের কথা বাদ দিই। আমাদের দেশের শিক্ষিত নাগরিকগণ কি এখনো এই মানসিকতা অর্জন করতে পেরেছে? অনেকেই পারেননি। পারেন যে নি, এইটুকু বুঝতেও আমরা পারি না। আমাদের মানসিক দৈন্য এতটাই প্রকট।

প্রাণিজগতে একমাত্র মানুষের ক্ষেত্রেই শিক্ষার প্রসঙ্গ ওঠে। এই প্রসঙ্গটি চির প্রাচীন এবং চির নতুন। প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ বুঝতে পেরেছে যে, অন্য ৮-১০ টি প্রাণীর মতো মানুষ নয়। জন্মের পর থেকে অন্য প্রাণীদের মতো মানুষ বেড়ে ওঠে বটে, কিন্তু তার সেই বেড়ে উঠা পরিপূর্ণতা লাভ করে ভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। সেই ভিন্ন প্রক্রিয়াটির নাম শিক্ষা। মানুষ মানুষের এই শেখার সম্ভাবনা আবিষ্কার করতে পেরেছিল সেই আদিকাল থেকেই। মানুষের মধ্যে সৃষ্টিশীলতা আছে, নতুন নতুন ভাবনা সে ভাবতে পারে। নতুন কাজ সে করতে পারে। সে উৎপাদন এবং পুনরোৎপাদন করতে পারে। বস্তুকে সে পরিবর্তন করতে পারে। নানা রকম প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে জীবন ও জগৎকে সে পালটাতে পারে। মানুষের মধ্যে এই অফুরন্ত সম্ভাবনা রয়েছে। মানুষ বুঝতে পারে যে, এই সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন হতে পারে একমাত্র শিক্ষার মাধ্যমে। শিক্ষা ব্যক্তি-মানুষটিকে যেমন পরিবর্তন করতে পারে, তেমনি পরিবেশ-পরিস্থিতিকেও পরিবর্তন করতে পারে। একজন সুশিক্ষিত মানুষ পরিবার-পরিজন থেকে শুরু করে সমাজ-সংস্কৃতি-সভ্যতা, অর্থনীতি ইত্যাকার বিচিত্র উপাত্তগুলোর মধ্যেও পরিবর্তন সাধন করতে পারে। সুতরাং কোনো না কোনোভাবে মানুষের এই শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষাপদ্ধতি চালু হয়েছিল প্রাচীনকাল থেকেই। আজ অবধি মানবীয় ভাবনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় শিক্ষা। বিশ্বজুড়ে শিক্ষার এই যে দীর্ঘ যাত্রাপথ, সেই যাত্রা পথের কত যে পরিবর্তন সাধন হয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই। সম্ভবত শিক্ষা নিয়ে মানুষ যত ভেবেছে, যত কথা বলেছে, যত লেখালেখি ও গবেষণা করেছে, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছে আর কোথাও তেমনটি হয়নি।

গুরুকুল থেকে শুরু করে টোল, চতুষ্পাটি, মক্তব, মাদরাসার আশ্রয়ে যে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়েছিল ভারতবর্ষে, তার মূল্যায়ন পদ্ধতির সঙ্গে আজকের মূল্যায়ন পদ্ধতি কোনো সম্পর্ক নেই। প্রাচীন সেই শিক্ষাব্যবস্থায় স্কুল-কলেজ ছিল না, পাঠ্যপুস্তক ছিল না, খাতাণ্ডকলম ছিল না, খাতাণ্ডকলমের মাধ্যমে পরীক্ষা দেওয়ার কোনো সুযোগও তখন ছিল না। সমগ্র ব্যবস্থাটি ছিল গুরু বা শিক্ষকের ইচ্ছানুযায়ী। তিনি শিক্ষার্থীদের নানা রকম কাজে নিয়োগ করতেন। তার পরিবারের কাজ থেকে শুরু করে ক্ষেত-খামারের কাজ, ব্যবসা-বাণিজ্যের কাজ, অতিথি আপ্যায়ন ও শ্রাদ্ধাদির কাজ করতে হতো শিক্ষার্থীদের। এইসব কাজের ভেতর দিয়ে শিক্ষার্থীর মধ্যে এক ধরনের সুশৃংখল জীবনবোধ, দায়িত্ববোধ, আনুগত্যবোধ, বিনয়, শ্রদ্ধাবোধ, সম্মানবোধ, নিয়মানুবর্তিতা ধীরে ধীরে তৈরি করা হতো। সুতরাং গুরুগৃহে শিক্ষার্থীর কাজ শুধু কাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। অধিকন্তু প্রতিটি কাজের মাধ্যমে শিক্ষার্থীকে কোনো না কোনো পাঠের, কোনো না কোনো জ্ঞানের, কোনো না কোনো অনুসন্ধিৎসার মুখোমুখি করা হতো। গুরু তীক্ষœভাবে তার সেই কাজকর্ম, দায়-দায়িত্ব ও নিয়মানুবর্তিতার প্রতি খেয়াল রাখতেন। এই সব কাজে নিরাপত্তা বিধানে শিক্ষার্থী কতটা যত্নশীল, সেসব বিষয়ও গুরুর বিবেচনায় থাকত। ফলে শিক্ষার্থীকে পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলাই ছিল সেই সময়ের গুরুকুলভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থার উদ্দেশ্য।

ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষে অর্থাৎ উনিশ শতকের শুরু থেকে যে শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয় তার সঙ্গে গুরুকুল, টোল, চতুষ্পাটি, মক্তক ও মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থার কোনো সম্পর্কই থাকেনি। পাশ্চাত্য রীতি ও কাঠামোর পথ ধরে আস্তে আস্তে গড়ে উঠতে থাকে আধুনিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান- স্কুল, কলেজ এবং মাদ্রাসা। শিক্ষা হয়ে ওঠে পাঠপুস্তক ও পেপার-পেনসিল পরীক্ষা নির্ভর। ব্যক্তি শিক্ষার্থীর বিকাশের পরিবর্তে কাগজে-কলমে পরীক্ষায় তার কৃতিত্ব হয়ে ওঠে শিক্ষার মূল বনিয়াদ। বিশ শতকের শুরু থেকে এই পদ্ধতি সমাজের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে এবং একুশ শতকে এসে আমরা দেখতে পাচ্ছি, শিক্ষা আর শিক্ষার্থীর মনোদৈহিক বিকাশের মাধ্যম থাকল না। শিক্ষা হয়ে উঠল পরীক্ষা এবং শিক্ষার্থীরা হয়ে উঠল পরীক্ষার্থী। সত্যিকার অর্থে শিক্ষার্থী বলে আর কিছু থাকল না। “এসেসমেন্ট ফর লার্নিং” এর স্থলে “এসেসমেন্ট অফ লার্নিং”-এর মধ্যে আটকে যায় আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাকার্যক্রম। আর এই অন্তঃসারশূন্য শিক্ষাব্যবস্থা শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবক এবং সমাজের অন্য অংশীজনদের গ্রাস করে ফেলে। এখন শিক্ষা মানে এই সংজ্ঞার্থ আর থাকল না যে, শিক্ষার্থী কতটা জ্ঞান অর্জন করল; কতটা মানবিক মানুষ হয়ে উঠল; শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে কতটা উপযুক্ত হয়ে উঠল; অসাম্প্রদায়িক জীবনবোধে কতটা যোগ্য হয়ে উঠল; মানুষ ও প্রকৃতিকে কতটা সে শ্রদ্ধা, ভক্তি ও ভালোবাসতে পারল; তার মধ্যে দেশপ্রেম ও দেশের মানুষের প্রতি দায়-দায়িত্ববোধ কতটা তৈরি হলো; কতটা নিষ্ঠা, সততা, একাগ্রতা ও আন্তরিকতার সঙ্গে শিক্ষার্থী জীবনযাপন করতে শিখল; সত্য-মিথ্যা, ন্যায়-অন্যায়, সুন্দর-অসুন্দর ইত্যাদি মূল্যবোধ তার মধ্যে কতটা জাগ্রত হলো; গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, বাকস্বাধীনতা, অধিকার সচেতনতা ইত্যাদি তাকে কতটা প্রভাবিত করল; শিক্ষার্থী কতটা বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ হয়ে উঠল; তার মধ্যে শৃঙ্খলাবোধ, নিয়মানুবর্তিতা, সময়ানুবর্তিতা কতটা জাগ্রত হলো। যারা শিক্ষার্থী, যারা তাদের অভিভাবক, যারা তাদের শিক্ষক এবং অন্যান্য শুভাকাঙ্ক্ষী তাদের মধ্যেও এই বোধ আর থাকল না যে, আসলে শিক্ষার মানেটা কী; শিক্ষা কি শুধুই পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করা, ভালো চাকরি-বাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য করা? নাকি এর অন্য কোনো অর্থময়তা আছে? এই জিজ্ঞাসা এখন আর মানুষের মধ্যে জাগ্রত হয় না। জীবন ও জগৎ নিয়ে তাদের মধ্যে কোনো জিজ্ঞাসারও উদ্রেক করে না। সন্তান-সন্ততিরা কেমন মানুষ হচ্ছে- এই নিয়ে এখন আর অভিভাবকদের কোনো ভাবনা নেই। তাদের একমাত্র ভাবনা হলো, তাদের পোষ্যরা পরীক্ষায় কতটা ভালো রেজাল্ট করছে। তারপর কোনো প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে পারছে। সেই প্রতিষ্ঠান ভালো রেজাল্টের নিশ্চয়তা দিতে পারছে কতটা। ওই প্রতিষ্ঠান শিক্ষার্থীকে বিচিত্র কৌশলে কতটা দলাই-মোচড়াই করে তার দেহ ও আত্মার প্রাণ হরণ করে ভালো রেজাল্ট করিয়ে দিতে পারছে, তার উপর নির্ভর করছে ওই প্রতিষ্ঠানে ভালত্ব। এইসব বিবেচনার মধ্যেই অভিভাবকদের ভাবনা ঘুরপাক খাচ্ছে। তারা গর্ব করে বলতে পারছে, তার সন্তান উমক স্কুল বা কলেজে পড়ছে। অনেক ক্ষেত্রে তাকে জিজ্ঞাসা না করলেও কোনো না কোনো উপায়ে তার সন্তান-সন্ততির শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নাম তাকে বলতেই হবে। এাঁ তার কাছে মর্যদার বিষয়। শিক্ষার্থীরা যেহেতু নবীন তারাও এই ভাবনার মধ্যে নিজেদের নিমজ্জিত করে ফেলে। এই প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে আমাদের শিক্ষা হয়ে উঠেছে পাঠ্যপুস্তক নির্ভর, কোচিং সেন্টার নির্ভর, প্রাইভেট টিউটর নির্ভর এবং সর্বোপরি পরীক্ষা নির্ভর। আর পরীক্ষায় গোল্ডেন এ প্লাস পাওয়া হয়ে উঠেছে আমাদে শিক্ষার একমাত্র মাপকাঠি।

কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এই যে, ১৯৭৪ সালে কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশনের যে রিপোর্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল, সেই রিপোর্টের মধ্যে পরীক্ষানির্ভর বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার চিহ্নমাত্রও ছিল না। এমনকি পরবর্তী পর্যায়ে যতগুলো শিক্ষা কমিশন তৈরি হয়েছে এবং তাদের যতগুলো রিপোর্টের সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটেছে, সেখানে আমরা দেখেছি পরীক্ষানির্ভর এমন শিক্ষাব্যবস্থার কথা কোথাও নেই। আর শিক্ষত্রম যেহেতু তৈরি করা হয় শিক্ষানীতির আলোকে সেহেতু শিক্ষাক্রমের কোথাও মূল্যায়ন মানেই পরীক্ষা- এমন কথা কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। অধিকন্তু প্রতিটি শিক্ষানীতি ও শিক্ষাক্রমে শিক্ষার্থীদের সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার কথা আছে। শিক্ষার্থীদের দক্ষতাসম্পন্ন, মূল্যবোধসম্পন্ন ও যোগ্য মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার কথা আছে। কিন্তু শিক্ষাক্রমের ওই সব নির্দেশনার কোনো রকম বাস্তবায়ন ছিল না কখনোই। কিন্তু ২০১০ সালে জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এর আলোকে যে কারিকুলাম পরিমার্জন করা হয়, তার মধ্যে ধারাবাহিক মূল্যায়নকে বা শিখনকালীন মূল্যায়নকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হয়েছিল। তার পূর্বে ৫৩টি স্কুলে ধারাবাহিক মূল্যায়নের পাইলটিং, পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও গবেষণা হয়েছিল। পরে এর নাম হয়েছিল স্কুলভিত্তিক মূল্যায়ন বা এসবিএ। কিন্তু কিছুতেই স্কুলভিত্তিক মূল্যায়নব্যবস্থা চালু করা যায়নি। সেই সময় অর্থাৎ ২০১০ সাল থেকে এসবিএ সারাদেশে বিপুল আলাপ-আলোচনা ও বিরূপ সমালোচনার অবতারণা করেছিল। এখনকার মতো না বুঝেই লোকজন সমালোচনায় মুখর হয়ে উঠেছিল। ফলে সরকার ওই ব্যবস্থাটি বাস্তবায়ন করার মতো কোনো সহযোগিতা পায়নি। ২০১০ সাল থেকে পুরো এক দশক নানা রকমের চেষ্টা থাকা সত্ত্বেও ধারাবাহিক মূল্যায়ন বা শিখনখালীন মূল্যায়ন বাস্তবায়ন করা যায়নি। কিন্তু ২০২১ সালে প্রণীত পরিমার্জিত শিক্ষাক্রম এই মূল্যায়ন ব্যবস্থাটিকে বাস্তবায়নের জন্য সর্বোতমুখী ব্যবস্থা গ্রহণ করে।

দেশীয় ও বৈশ্বিক পটভূমিতে একবিংশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য শুধু পেপার-পেনসিল টেস্ট-নির্ভর পরীক্ষাব্যবস্থা যে কিছুতেই কার্যকর হতে পারে না, সেই বাস্তবতা থেকে ২০২১ সালে শিক্ষাক্রম পরিমার্জন করা হয় এবং পরিমার্জিত শিক্ষাক্রমের সঙ্গে সমন্বয় বিধান করে পাঠ্যপুস্তক ও শিক্ষক নির্দেশিকা প্রণয়ন করা হয় এবং মূল্যায়ন ব্যবস্থায় লক্ষণীয় পরিবর্তন সাধন করা হয়। এই ব্যবস্থার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের শুধু মুখস্থনির্ভর পরীক্ষা থেকে মুক্তি দিয়ে একটি কার্যকর, আনন্দিত ও জীবনমুখী মূল্যায়ন ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়।

এই মূল্যায়ন ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়েছে পাঠসংশ্লিষ্ট নানা রকমের কাজের উপর ভিত্তি করে। শিক্ষার্থীরা যেন নিজেদের দক্ষ, যোগ্য ও মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে পারে, এই মূল্যায়ন ব্যবস্থায় সেই সুযোগ আছে। এখানে পেপার-পেনসিল টেস্ট যে নেই, তা নয়। সেই ব্যবস্থাও আছে। তবে তা মূলত ধারাবাহিক মূল্যায়নেরই অংশ। এখানেও ষান্মাসিক ও বার্ষিক পরীক্ষা আছে। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ মূল্যায়নগুলো হবে বছরব্যাপী। প্রতিটি বিষয়ের সঙ্গেই ধারাবাহিক মূল্যায়ন অনুষ্ঠিত হবে সঙ্গে কাগজে-কলমে পরীক্ষা। এছাড়া শিক্ষার্থীরা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে, খেলাধুলা ও অন্যান্য সহশিক্ষাক্রমিক কার্যক্রমের ভেতর দিয়ে নিজেদের দক্ষতা, যোগ্যতা ও মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ হয়ে উঠার পরিচয় রাখতে পারবে।

এই মূল্যায়ন ব্যবস্থা যে সমালোচনার ঊর্ধ্বে তা বলার কোনো সুযোগ নেই। আসলে কোনো ব্যবস্থাই সমালোচনা ও ত্রুটি-বিচ্যুতির ঊর্ধ্বে নয়। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে শুরু করে অন্যান্য মাধ্যমে এই মূল্যায়ন ব্যবস্থাটিকে যেভাবে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে, তা মোটেই সঠিক নয়। এমনকি পাঠ্যপুস্তক সম্পর্কে অভিভাবক ও অন্যান্য অংশীজন যেসব কথা বলছেন, তাও যথার্থ নয়।

মানুষের কর্মের সঙ্গে তার মূল্যবোধের সম্পর্ক সবচেয়ে গভীর ও তাৎপর্যময়। দক্ষতা, সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে মানুষ যদি কোনো কাজ সম্পন্ন করতে পারে এবং সব ধরনের বৈধ কাজের প্রতি মানুষের যদি শ্রদ্ধাবোধ থাকে, তাহলে বুঝতে হবে তার মধ্যে নাগরিক হিসেবে মূল্যবোধ তৈরি হয়েছে। যখন প্রতিজন নাগরিকের মধ্যে এই মূল্যবোধ তৈরি হয়, তখন বুঝতে হবে যে সমাজ অনেকটা পথ এগিয়ে গেছে, আধুনিক ও বিজ্ঞানমনস্ক মানসিকতা অর্জন করেছে। আমাদের সমাজে যারা পড়াশুনা করেননি তাদের কথা বাদ দিই, যারা শিক্ষিত নাগরিক তাদের মধ্যে কি এখনো এই মানসিকতা তৈরি হয়েছে?

প্রাণিজগতে একমাত্র মানুষের ক্ষেত্রেই শিক্ষার প্রসঙ্গে ওঠে এবং এই প্রসঙ্গটি চির প্রাচীন এবং চির নতুন। সুপ্রাচীনকাল থেকেই মানুষ বুঝতে পেরেছে যে, অন্য প্রাণীর মতো নয় মানুষ। জন্মের পর থেকে অন্য প্রাণীদের মতো মানুষ বেড়ে ওঠে বটে, কিন্তু তার সেই বেড়ে উঠা পরিপূর্ণতা লাভ করে ভিন্ন কোনো প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। সেই ভিন্ন প্রক্রিয়াটির নাম হলো শিক্ষা। মানুষের শেখার এই সম্ভাবনা আবিষ্কৃত হয়েছিল সেই আদিকালেই। মানুষের মধ্যে সৃষ্টিশীলতা আছে, নতুন নতুন ভাবনা সে ভাবতে পারে, নতুন কাজ সে করতে পারে, সে উৎপাদন এবং পুনরুৎপাদন করতে পারে, বস্তুকে সে পরিবর্তন করতে পারে এবং নানা রকম প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে জীবন ও জগৎকে সে পরিবর্তন করতে পারে, তার মধ্যে এই অফুরন্ত সম্ভাবনা রয়েছে। আর এই সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন হয় একমাত্র শিক্ষার মাধ্যমে। শিক্ষা ব্যক্তি-মানুষটিকে যেমন পরিবর্তন করতে পারে, তেমনি পরিবেশ-পরিস্থিতিকেও বদলাতে পারে। একইভাবে তার পরিবার-পরিজন থেকে শুরু করে সমাজ সংস্কৃতি সভ্যতা অর্থনীতি ইত্যাকার বিচিত্র উপাত্তগুলোর মধ্যেও পরিবর্তন সাধিত হতে পারে। এই জন্যই মানবীয় ভাবনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো শিক্ষা। শিক্ষার যে দীর্ঘ যাত্রাপথ, সেই যাত্রাপথের কত যে পরিবর্তন সাধিত হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। সম্ভবত শিক্ষা নিয়ে মানুষ যত ভেবেছে, যত কথা বলেছে, যত লেখালেখি ও গবেষণা করেছে, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছে আর কোথাও তেমনটি হয়নি।

গুরুগৃহ থেকে শুরু করে টোল, চতুষ্পাটি, মক্তব, মাদ্রাসায় যে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়েছিল তখনকার ভারতবর্ষে তার মূল্যায়ন পদ্ধতির সঙ্গে পেপার-পেনসিল নির্ভর মূল্যায়ন পদ্ধতির কোনো সম্পর্ক ছিল না। প্রাচীন সেই শিক্ষাব্যবস্থায় পাঠ্যপুস্তক ছিল না, খাতাণ্ডকলম ছিল না, পরীক্ষা দেওয়ার কোনো রেওয়াজও তখন ছিল না। সমগ্র ব্যবস্থাটি ছিল গুরু বা শিক্ষকের ইচ্ছানুযায়ী। গুরু শিক্ষার্থীদের নানা রকম কাজে নিয়োগ করতেন, তার পরিবারের কাছ থেকে শুরু করে ক্ষেত-খামারের কাজ, ব্যবসা-বাণিজ্যের কাজ, অতিথি আপ্যায় ও শ্রাদ্ধাদির কাজ করতে হতো শিক্ষার্থীকে। এইসব কাজের ভেতর দিয়ে শিক্ষার্থীর মধ্যে এক ধরনের সুশৃংখল জীবনবোধ, দায়িত্ববোধ, আনুগত্য বিনয় ও শ্রদ্ধাবোধ, সম্মানবোধ এবং নিয়মানুবর্তিতা শিক্ষা দেওয়া হতো। শিক্ষার্থী যেসব কাজ করত সেসব কাজ শুধু কাজ হিসেবে বিবেচিত হতো না। অধিকন্তু প্রতিটি কাজের মাধ্যমে শিক্ষার্থীকে কোনো না কোনো পাঠের, কোনো না কোনো জ্ঞানের, কোনো না কোনো অনুসন্ধিৎসার এবং অভিজ্ঞতার মুখোমুখি করা হতো। গুরু তীক্ষèভাবে তার সেই কাজকর্মের প্রতি, দায়-দায়িত্বের প্রতি ও নিয়মানুবর্তিতার প্রতি খেয়াল রাখতেন। নিরাপত্তা বিধানে শিক্ষার্থী কতটা যত্নশীল, সেসব বিষয়ও গুরুর বিবেচনায় থাকত। ফলে শিক্ষার্থীকে পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলাই ছিল সেই সময়ের গুরুকুলভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা উদ্দেশ্য। কিন্তু ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষে অর্থাৎ উনিশ শতকের শুরু থেকে যে শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়, তার সঙ্গে গুরুকুল টোল চতুষ্পাটি মক্তক মাদ্রাসা ইত্যাদির শিক্ষা ব্যবস্থার কোনো সম্পর্কই থাকেনি। তখন থেকেই শিক্ষা হয়ে উঠল পাঠপুস্তক নির্ভর ও পেপার-পেনসিল পরীক্ষা নির্ভর। ব্যক্তি- শিক্ষার্থীর বিকাশের পরিবর্তে কাগজে-কলমে পরীক্ষায় তার কৃতিত্ব হয়ে উঠল শিক্ষার মূল বনিয়াদ। বিশ শতকের শুরু থেকে এই পদ্ধতি সমাজের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে এবং একবিংশ শতকে এসে আমরা দেখতে পাচ্ছি, শিক্ষা আর শিক্ষার্থীর মনোদৈহিক বিকাশের মাধ্যম থাকল না, শিক্ষা হয়ে উঠল ব্যবসায় এবং শিক্ষার্থীরা হয়ে উঠল পরীক্ষার্থী। সত্যিকার অর্থে শিক্ষার্থী বলে আর কিছু থাকল না। “এ্যাসেসমেন্ট অফ লার্নিং”- এর স্থলে শিক্ষা হয়ে উঠল “এ্যাসেসমেন্ট ফর লার্নিং”। এই বোধ শিক্ষার্থী শিক্ষক অভিভাবক এবং সমাজের অন্য অংশীজনদের গ্রাস করে ফেলল। এখন শিক্ষা মানে শিক্ষার্থী কতটা জ্ঞান অর্জন করল; কতটা মানবিক মানুষ হয়ে উঠল; শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে কতটা উপযুক্ত হয়ে উঠল; অসাম্প্রদায়িক জীবনবোধে কতটা যোগ্য হয়ে উঠল; মানুষ ও প্রকৃতিকে কতটা সে শ্রদ্ধা ভক্তি ও ভালোবাসতে পারল; তার মধ্যে দেশপ্রেম ও দেশের মানুষের প্রতি দায়দায়িত্ববোধ কতটা তৈরি হলো; কতটা নিষ্ঠা, সততা, একাগ্রতা ও আন্তরিকতার সঙ্গে শিক্ষার্থী জীবনযাপন করতে শিখল; সত্য-মিথ্যা, ন্যায়-অন্যায়, সুন্দর-অসুন্দর ইত্যাদি মূল্যবোধ তার মধ্যে কতটা প্রোথিত হলো; গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, বাকস্বাধীনতা ও অধিকার সচেতনতা ইত্যাদি তাকে কতটা প্রভাবিত করল; শিক্ষার্থী কতটা বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ হয়ে উঠল; তার মধ্যে শৃঙ্খলাবোধ, নিয়মানুবর্তিতা, সময়ানুবর্তিতা কতটা জাগ্রত হলো- এইসবের মূল্যায়ন ও বিকাশের কোনো সুযোগ আর শিক্ষা ব্যবস্থা থাকল না। যারা শিক্ষার্থী, যারা তাদের অভিভাবক, যারা তাদের শিক্ষক এবং অন্যান্য শুভাকাঙ্ক্ষী তাদের মধ্যেও এই বোধ আর থাকল না যে, আসলে শিক্ষার মানেটা কী? শিক্ষা কি শুধুই পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করা, ভালো চাকরি-বাকরি করা, ব্যবসা-বাণিজ্য করা, নাকি এর অন্য কোনো অর্থময়তা আছে? এই প্রশ্ন এখন আর মানুষের মধ্যে নেই। জীবন ও জগৎ নিয়ে কোনো জিজ্ঞাসা মানুষের মধ্যে জাগে না। সন্তান-সন্ততিরা কেমন মানুষ হচ্ছে- এই নিয়ে এখন আর অভিভাবকদের কোনো ভাবনা নেই। তাদের একমাত্র ভাবনা হলো তাদের পোষ্যরা পরীক্ষায় কতটা ভালো রেজাল্ট করতে পারছে। তারপর কোন প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে পারছে। কোনো প্রতিষ্ঠানে ভালো রেজাল্ট হচ্ছে। কোন প্রতিষ্ঠান কতটা সাফল্যের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের পাঠ গলাদকরণ করাতে পারছে। এইসব বিবেচনার মধ্যেই অভিভাবকদের ভাবনা ঘুরপাক খাচ্ছে। শিক্ষার্থীরা যেহেতু নবীন, তারাও স্বাভাবিকভাবেই এই ভাবনার মধ্যে নিজেদের নিমজ্জিত রাখছে। ফলে শিক্ষা হয়ে উঠছে পাঠ্যপুস্তকনির্ভর, কোচিং সেন্টার নির্ভর, প্রাইভেট টিউটর নির্ভর এবং সর্বোপরি পরীক্ষা নির্ভর।

এখন জাতিগত ও বৈশ্বিক পটভূমিতে একবিংশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য শুধু পেপার-পেনসিল টেস্ট নির্ভর পরীক্ষা যে কিছুতেই কার্যকর হতে পারে না, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। পরিমার্জিত শিক্ষাক্রমের আলোকে শিখন-শেখানো কার্যক্রম ও মূল্যায়ন ব্যবস্থাপনায় যে পরিবর্তন সাধন করা হয়েছে, তার মধ্যে অনেক ত্রুটি-বিচ্যুতি ও সীমাবদ্ধতা থাকতে পারে। কিন্তু এই পদ্ধতির ভেতর দিয়ে শিক্ষার্থীদের সুনাগরিক করে গড়ে তোলার সম্ভাবনা অনেক বেশি। সুতরাং সকল অংশীজনের সহযোগিতার মাধ্যমে এই ব্যবস্থাটিকে সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়ন করা জরুরি।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়