বুধবার, ২৭ নভেম্বর, ২০২৪  |   ১৯ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   ফরিদগঞ্জে সংবাদকর্মীর কন্যাকে অপহরণ চেষ্টায় অভিযুক্তদের অবিলম্বে গ্রেফতারের দাবি ফরিদগঞ্জ প্রেসক্লাবসহ বিভিন্ন সংগঠনের
  •   লক্ষ্মীপুরে মাদকসহ বাবা ও দুই ছেলে আটক
  •   চাঁদপুর সদর মডেল থানা পুলিশের অভিযানে বিভিন্ন মামলার ৮ আসামী আটক
  •   ফরিদগঞ্জ পাকহানাদার মুক্ত দিবস পালন
  •   যৌথ অভিযানে কচুয়া থানার লুণ্ঠিত পিস্তলের ৮ রাউন্ড গুলি উদ্ধার

প্রকাশ : ২৪ জানুয়ারি ২০২৩, ০০:০০

একটি রৌদ্রস্নাত স্কুল
অনলাইন ডেস্ক

(গত সংখ্যার পর)

আমাকে চরকালিয়া স্কুলে যেতে হবে। আমি বেশ আনন্দেই আছি। হাইস্কুলে পড়তে যাচ্ছি। একটু ভাবসাবও হয়েছে। প্রথম দিনই খায়ের স্যার আমাকে সঙ্গে নিয়ে চললেন। তিনি আমাদের বাড়ির পাশ দিয়েই চরকালিয়া যেতেন। আমি তার পিছু পিছু হাঁটতে শুরু করলাম। শীতের সকাল। কুয়াশা এখনো আছে। তবে রোদের সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে না পেরে খুব অনিচ্ছায় ধীরে ধীরে নিষ্ক্রান্ত হচ্ছে। তার মধ্যেই নানা কাজে বেরিয়ে গেছে শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে কৃষক ও খেত-খামারের শ্রমিকগণ। দীর্ঘ ফসলের মাঠ অতিক্রম করে এই আমার প্রথম কোনো স্কুলে যাওয়া। কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম অপরিচিত জনপদে। অবশ্য এর আগে ১৯৭১ সালে বিজয়ের মাসখানেক আগে কোনো এক সকালে ফরাজিকান্দীর এই বিলে একবার এসেছিলাম। আমি একা নই। অনেক গ্রামের অনেক লোক এসেছিল। ৪ নভেম্বর ১৯৭১ সালে দক্ষিণ এখলাসপুর আমবাগান বরাবর মেঘনায় পাকিস্তানি রসদ ও অস্ত্রবাহী জাহাজ এম.ভি. স্বামী, এবং ৭ই নভেম্বর এখলাসপুর বাজারের কাছে খালের মুখে নোঙর করা জাহাজ এম.ভি. লিলি (পরবর্তীতে বেঙ্গল ওয়াটার) ধ্বংস করে দেয় মুক্তিযোদ্ধাগণ। এবং এই নৌপথ দিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের যাতায়াত ও রসদ পরিবহন বিপজ্জনক করে তোলা হয়েছিল। ১১ নভেম্বর এখলাসপুর মোহনায় পাকিস্তান শিপিং কর্পোরেশনের এমভি সোবান এবং এমভি গফুর নামক দুটি জাহাজ মাইন বিস্ফোরণের মাধ্যমে ডুবিয়ে দেয় মুক্তিযোদ্ধাগণ। আমাদের বাড়িব অদূরে এখলাসপুরের সীমানায় মেঘনা নদীতে ঘটে ওই ঘটনা। হানাদার বাহিনীর সৈন্যদের অনেকের সলিল-সামাধি ঘটে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ সাঁতরিয়ে তীরে এসে ওঠে এবং মুক্তিবাহিনী ও এলাকার সাধারণ মানুষের কাছে ধরা পড়ে। তাদের বেশ কয়েকজনকে জড় করা হয়েছিল ফরাজিকান্দীর এই ফসলের মাঠে। তাদের দেখতে গ্রামের মানুষ দলে দলে এসেছিল এখানে। অনেকের সঙ্গে আমিও এসেছিলাম। তারপর ১৯৭৩ সালের দিকে বিজয় উৎসব ও বিজয়মেলা হওয়ার কথা ছিল এই চরকালিয়া স্কুলে। অনেক শিশুর সঙ্গে আমিও মেলায় আসার জন্য নমজহিরাবাদ (ফসলের মাঠের পূর্ব-পশ্চিমে দুটি গ্রাম। মুসলমানদের জন্য পশ্চিমের গ্রাম দুটির নাম সানকীভাঙ্গা ও জহিরাবাদ এবং ফসলের মাঠ পেরিয়ে পূর্বদিকে বাস করেন সনাতন ধর্মাবলম্বীরা। তাদের গ্রামের নাম নমসানকীভাঙ্গা ও নমজহিরাবাদ) পর্যন্ত অতিক্রম করেছিলাম। কিন্তু কয়েকজন যুবক আমাদের আটকে দেয়। ওরা আমাদের মেলায় যেতে দেয়নি। তাদের হাতে ছিল বস্তায় মোড়ানো অস্ত্র। ওগুলো বের করে আমাদের দেখিয়েছিল। বলেছিল, “কোনো অনুষ্ঠান হবে না, মেলা হবে না। বাড়িতে চলে যাও। ফের যদি আসো, একদম মেরে ফেলব।” আমরা যে খুব একটা ভয় পেয়েছিলাম তা নয়। কারণ ওইসব অস্ত্রের ভয়াবহতা সম্পর্কে আমাদের তেমন কোনো ধারণা ছিল না। বরং একটা চাকু দেখালে আমরা অনেক বেশি ভয় পেতাম- বিশেষ করে বুতাম টিপলে খাপ থেকে দুই-তিনটা চাকু বেরিয়ে পড়ে- এমন। আমাদের মধ্যে একজন জিজ্ঞাসা করেছিল, “আমনের ওইডার মধ্যে কী?” ওরা কোনো উত্তর না দিয়ে হাসতে হাসতে ফরাজিকান্দীর দিকে রওয়ানা দেয়। আমরাও বাড়িতে চলে আসি। বিজয় উৎসব হয়নি। মেলাও হয়নি। পরে জেনেছি, ওরা ছিল জাসদের লোক।

ঠাকুরপাড়া-ফরাজিকান্দী সীমানার খালের উপর ছিল একটি কাঠের পুল। এখানে আমি বহুবার এসেছি। ওই খালটা যেমন রহস্যময় ছিল, পুলটাও ছিল সম্মোহনের মতো ভয় আর আকর্ষণের এক যুগল ডাকিনী। এতবড় কাঠের পুল এই এলাকায় আর কোথাও ছিল না। মাঝেমধ্যে পাটাতন ছিল না- ফাঁকা । খুব ভয়ে ভয়ে সতর্কতার সঙ্গে পার হতে হতো। তারপরেও কেন যে বারবার ওই পুলটা পার হতে ইচ্ছে হতো, তার রহস্য আজও উদ্ঘাটন করতে পারিনি।

আমার উচ্চতাভীতি আছে। চিরকালই ছিল। ওই পুলটা ছিল খুব উঁচু। বিশেষ করে শীতকালে খালের পানি যখন কমে যেত তখন পুলটিকে মনে হতো আকাশ সমান উঁচু। উঁচু ঠিক আছে, তো নিচে তাকানোর দরকার কী? সামনের দিকে তাকিয়ে সোজা পার হয়ে গেলেই তো হয়। কিন্তু না। পুলের মাঝে গিয়ে নিচে তাকানো খুব জরুরি হয়ে পড়ত। বার বার নিচে তাকিয়ে ভয়ের আনন্দটা বেশ উপভোগ করে খাল পার হতাম।

খাল পার হয়ে ঢুকে যেতে হতো বিপুল বৃক্ষরাজি পরিবেষ্টিত একটি নির্জন রাস্তায়। ওই মনোরম পথটুকু হেঁটে যেতে খুব ভালো লাগত। গাছের ফাঁকফোকর গলিয়ে যে আলোটুকু রাস্তায় এসে পড়ত তার আলো-আঁধারে কত নকশা, কত ছবি, কত চিত্রকলা যে তৈরি করত, তার ইয়ত্তা ছিল না। আলো-আঁধারের ওইসব চিত্রকলার মধ্যে আবার সামান্য বাতাসেই সৃষ্টি হতো কম্পন। রাস্তার উপরে ছড়িয়ে থাকা আলোর সিকি-আদলি মাড়িয়ে মাড়িয়ে, হাতি-ঘোড়ার লেজে মাথায় বুকে পিঠে পা দিয়ে দিয়ে অতিক্রম করে যেতাম ওই নির্জন জনপদ। সকালের ছড়িয়ে থাকা মিষ্টি আলো, ঝলমলে রোদ আর শীতের তিরতিরে বাতাস এবং ওই বাতাসে কম্পন রেখে কিছু প্রজাপতি কেন এই রাস্তার আলো-আঁধারে টইটই করে বেড়াত তার কারণ বুঝতাম না। মাঝেমধ্যে ওরা আমার পিছু নিত। আজব! কই আমি ওদের পিছু নেবো, না ওলটো ওরা আমার পিছু নেয়। ওদের এই সঙ্গ আমি কিন্তু স্বপ্নে দেখিনি। সত্যি ছিল।

চার.

স্কুল সংলগ্ন বাজার। উত্তর দিকে। বিশাল বাজার। স্কুলের সামনে দিয়ে যে রাস্তাটি দক্ষিণে কোথায় চলে গিয়েছে সেই রাস্তাটিই বাজারের মাঝ দিয়ে উত্তর দিকে ফরাজিকান্দী হয়ে নিরুদ্দেশ। বাজারে ঢুকার আগেই ওই রাস্তাটির একটি অংশ চলে গেছে আমাদের গ্রামের দিকে। আমাদের গ্রামের দিকে বললাম বটে, কিন্তু বিষয় ওরকম নয়। পাড়াবেড়ানো মহিলাদের মতো এই রাস্তাটি টো টো করে বেড়িয়েছে নানা দিকে। ওই নিয়ে আমার আগ্রহ আছে। কিন্তু আমার কাছে স্বপ্নের মতো মনে হতো ওই বাজারটিকে। ঢুকতেই বিশাল একটি বটগাছের নিচে বাজারের দক্ষিণ অংশ। তারপর দুই রাস্তার উভয় দিকে চার সারি দোকানের এই বাজরটি রহস্যের আকর। বাজার বলে যে খুব হৈচৈ ছিল তা কিন্তু নয়, বিস্তৃত বাজারটিতে এক ধরনের নির্জনতা ছিল, মনে হতো চুপিসারে কোলাহলের বিস্তৃত পরিসর।

প্রথম দিন স্কুলে গিয়ে আমি খুব অবাক হয়েছিলাম, তা নয় বরং বিস্মিত ও হতাশই হয়েছিলাম। বিশাল দীঘি, দীঘির পার ঘেষে প্রশস্ত ভূমি, তার পাশে স্কুল আর সেই স্কুলের পেছনে ফসরের বিস্তৃত মাঠ এবং চারদিকে শুধু গাছ আর গাছ- কত রকমের ফলের গাছ যে তাদের সকল দক্ষিণা আমাদের জন্য উজার করে বিছিয়ে রেখেছিল, সেই সানকিভাঙ্গা প্রইমারি স্কুল থেকে এই স্কুলে গিয়ে হতাশ না হওয়ার কোনো কারণ ছিল না। দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত খালের মোড়টি ঘেষে চরকালিয়া স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। মনে হলো স্কুলটি খুব অভিমান করে বাজারের সঙ্গে আড়ি দিয়ে সে পুবে-পশ্চিমে দাঁড়িয়ে আছে বাজরটিকে পিছনে ফেলে। দক্ষিণমুখো স্কুলটি বন্ধ করে দিয়েছে বাজারে আলো-বাতাস ঢুকার সব পথ। প্রথমে দেখে তাকে আমার স্কুল মনে হতো না, মনে হতো যেন বাজারেরই একটি আলাদা অংশ- যেন বাজারের জায়গা ছেড়ে দিয়ে স্কুল বানানো হয়েছে। বাজারটির নাম গৌরাঙ্গ বাজার। কিন্তু চরকালিয়া বাজার বলেই আমি চিনতাম।

বাজারে কোলাহল হয়, স্কুলেও কোলাহল হয়। কিন্তু দুই কোলাহল কি এক? নিশ্চয়ই নয়। বাজারের কোলাহল প্রয়োজনের, স্বার্থের, দরদামের, কেনাকাটার এবং কোলাহল যারা করেন তারা পৃথিবীর অনেক কিছু বুঝে শেষ করেছেন। তারা অধিকাংশই সংসারী, গৃহী- প্রবীণ। আর স্কুলের কোলাহল নতুন প্রাণের। ওই কোলাহল নরম কণ্ঠে মধুর। ওই কোলাহলের অন্তরে আলোর হাতছানি। ঘণ্টা পড়ে যখন ক্লাস শুরু হয় তখন জ্ঞান দানকারী শিক্ষকের কণ্ঠ সবার উপরে। শিক্ষার্থীরা গুরুর সামনে বিনম্র ও বিনয়বাচনে সলজ্জ। পুরো স্কুল জুড়ে তখন মধুর নির্জনতার ভেতরে বিদ্যাচর্চার বেহাগ ধ্বনি। তার মধ্যে বাজারের বিচিত্র শব্দে ছন্দপতন।

ক্লাস শেষ হওয়ার ঘণ্টা বেজে উঠলে অন্য রকম কোলাহলে মুহূর্তের মধ্যে স্কুল প্রাঙ্গণটি মুখর হয়ে ওঠে। ক্লাস চলার নির্জনতার সুযোগে ওই দিকে তখন বাজারের শব্দ প্রবল হয়ে ওঠে। কিন্তু প্রকৃতি আপনা থেকে কিছু নিরাময় তৈরি করে। ওই নিরাময় তৈরি না হলে মানুষ কেন, কোনো কিছুই টিকত না। আর তা হলো ভেতরগত ঐক্য ও সংহতি। ওই ঐক্য ও সংহতির জন্য শেষ পর্যন্ত বাজার ও স্কুলের মধ্যে বৈরিতার অবসান ঘটে এবং তৈরি হয় বন্ধুত্ব। শত বছর ধরে চরকালিয়া বাজার ও স্কুলের মধ্যে বন্ধুত্বের বন্ধন বিরাজমান আছে। যদি তা না হতো তা হলে হয় উঠে যেতে হতো বাজার অথবা স্কুল। কিন্তু কোনোটিই উঠে যায়নি। দুটিই টিকে আছে প্রবলভাবে। অধিকন্তু সমৃদ্ধি ঘটেছে স্কুলের এবং উন্নয়ন ঘটেছে বাজারের।

পাঁচ.

আবারও বলি, স্কুলটিতে গিয়ে আমি খুই বিস্মিত হয়েছিলাম। স্কুলে ফলের বাগান নেই, পুকুর নেই, ঝোপঝাড় নেই, নির্জনতা নেই, আড়াল-আবডাল নেই। সবদিকে খোলা- একটি রৌদ্রস্নাত স্কুল। ক্লাসে চল্লিশ থেকে পঁয়তাল্লিশ জন ছাত্র-ছাত্রী। ছাত্রীদের সংখ্যা অতি সামান্য- পাঁচণ্ডছয়জন। কিন্তু পরে যখন স্যার রোল কল করছিলেন তখন দেখি শিক্ষার্থীদের সংখ্যা ষাটের বেশি। কিন্তু কারো সঙ্গেই আমার কোনো কথা হয়নি। মাত্র কয়েক দিনের ওই স্কুল-জীবনের কারো কথাই আমার মনে নেই। পরবর্তী জীবনে ওইসব সহপাঠী করো সঙ্গে আমার যোগাযোগ হয়েছে বা পরিচয় হয়েছে তাও নয়। ফলে চরকালিয়া স্কুলের অধ্যায়টি সম্পূর্ণ বিস্মৃতির অতলে চলে গেছে। তবে কয়েকজন শিক্ষকের কথা মনে আছে। এদের মধ্যে বভূতিভূষণ স্যারের সঙ্গে আমার যোগাযোগ ছিল বরাবরই।

আমাদের পাশের গ্রামের নমসানকিভাঙ্গার মানুষ ছিলেন বিভূতিভূষণ স্যার। তাদের বাড়িতে আমাদের খুব যাওয়া-আসা ছিল। তিনি আমার বড় ভাই রুহুল আমিনেরও শিক্ষক ছিলেন। সম্ভবত ১৯৭৫ সালের ওই সময় চরকালিয় স্কুলের প্রধান শিক্ষকও ছিলেন তিনি। আমার বাবার সঙ্গে তাঁর ছিল হৃদ্যতার সম্পর্ক। সম্ভবত বিভূতিভূষণ স্যারের সঙ্গে সলাপরামর্শ করে বাবা আমাকে এই স্কুলে ভর্তি করেছিলেন। তিনি আমাকে খুব ভালোবাসতেন। স্কুলে যাওয়ার পর থেকে তিনি আমার খোঁজখবর রাখতেন। হালকাণ্ডপাতলা একহাড়া গড়নের লম্বা এই মানুষটিকে দেখলে আমার মনে হতো খুব ভালো মানুষ, পৃথিবীর কাউকে সামান্য কষ্ট দেওয়ার কষ্ট তিনি কখনোই নিতে পারেন না। আমাকে সব সময় ‘বাবা’ সম্বোধন করতেন। বলতেন “মান্নান, কেমন আছ বাবা? পড়াশোনা ঠিক মতো হচ্ছে তো?” যখন আমি কলেজে অধ্যাপনা করতে শুরু করি, তখনো বিভূতি স্যারের সঙ্গে এমন সম্পর্কই ছিল। স্কুলে তিনি আমাদের সিক্সে কোনো ক্লাস নিয়েছিলেন কি না এখন আর মনে করতে পারছি না। তবে মনতোষ স্যারের কথা বেশ মনে আছে। তিনি ইংরেজি পড়াতেন। মনে আছে নিতাই স্যারের কথা। তিনি বাংলা পড়াতেন। বদিউল আলম স্যারও কি বাংলা পড়াতেন? মনে নেই। মনে আছে বিজ্ঞার পড়াতেন সোহরাব স্যার। ভুলও হতে পারে। আর সেরাজুল হক মৌলভি স্যার পড়াতেন গণিত। ওই স্কুলের আর কোনো শিক্ষকের কথা মনে করতে পারাছি না। কিন্তু যে বিষয়টি কখনো ভুলব না তা হলো, স্কুলের শৃঙ্খলার কথা। যে কটা দিন স্কুলে ছিলাম সে দিনগুলোতে কখনে কোনো শিক্ষকে বিলম্বে ক্লাসে আসতে দেখিনি, শিক্ষার্থীদের বেত্রাঘাত করতে দেখিনি কাউকে, অপমান-অপদস্তও করেননি কেউ। শিক্ষার এই পরিবেশ আমাকে মুগ্ধ করেছিল।

শীতের সকালে সেই স্কুলযাত্রা যে খুব খারাপ লাগত, তা নয়- দু-একদিন ভালোই লেগেছে। অপরিচিত দূরের এলাকায় একটি শিশু সঙ্গীসাথিহীন একাকী স্কুলে যাচ্ছে, এই নিয়ে কার-ই বা কী অভিযোগ থাকতে পারে! দলে-বলে স্কুলে যেতে হবে, এমন কোনো নিয়ম তো ধরা নেই। কিন্তু তবুও কয়েক দিনের মধ্যেই বুঝতে পারলাম, সর্বনাশ হয়েছে। বন্ধুদের সঙ্গে স্কুলে যাওয়ার যে আনন্দ, তার কিছুই নেই। মনে হচ্ছিল, খায়ের স্যার ভুলেই যেতেন যে, একটি শিশু তার সঙ্গে আছে। আপন মনে তিনি হেঁটে যেতেন। আমি অনেকটা রোবটের মতো তার সঙ্গে হেঁটে হেঁটে স্কুলে গিয়ে পৌঁছতাম। চার-পাঁচ দিন ওভাবেই স্কুলে গেলাম। ক্লাসে তো নয়-ই এমনকি পুরো স্কুলে আমার পরিচিত তেমন কেউই নেই। আমার এক চাচাত বোনের দেবররা উপরের কোনো ক্লাসে পড়ত। তারা একদিন আমার সঙ্গে দেখা করে আমাকে বল-ভরসা দিয়ে গেছে। তারপর আর দেখা নেই।

স্কুল ছুটি হওয়ার পর খায়ের স্যারকে আর পাওয়া যায় না। অবিবাহিত যুবক। কোথায় চলে যান তার খোঁজ কে রাখে। তিনি না থাকলে আমার বরং ভালোই হয়। নিজের মতো করে ফিরতে পারি। স্কুলে আসার সময়ও তিনি অনেক সময় আমাদের বাড়ি লাগোয়া পথে আসেন না- অন্য কোনো পথে চলে যান। সেদিন আমার আর স্কুলে যাওয়া হয় না। সুতরাং ভেতরে ভেতরে স্কুল ছাড়ার পরিকল্পনা করছি। খুব জুতসই একটি কারণ দাঁড় করাতে না পারলে তো বাবা রাজি হবেন না। স্কুলের দোষ দেওয়া যাবে না, শিক্ষকদের দোষ দেওয়া যাবে না। ওরকম কিছু বললে উলটো ফল ফলবে। এমন কিছু বললে বাবা বলবেন “তোমাকে এই স্কুলেই পড়তে হবে, এই শিক্ষকদের কাছেই পড়তে হবে।” সুতরাং কিছু না বলে স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিলাম। খায়ের স্যার দু-একদিন আমার খোঁজ নিয়েছেন। তারপর তিনিও আর কিছু বলেননি। আমি মহানন্দে ঘুরে বেড়াতে লাগলাম। মাছ ধরা, পাখির বসা খুঁজে বেড়ানো, গ্রামময় হৈহৈ করে ঘুরে বেড়ানো- ভালোই যাচ্ছিল সময়। এভাবে দুই-তিন মাস চলে যায়। বাবা বিষয়টা টের পেয়েছেন এবং বুঝতে পেরেছেন চরকালিয়া স্কুলে ভর্তি করা ঠিক হয়নি। তিনি এখন বিকল্প ভাবছেন। সুতরাং আমার কোনো অজুহাত দাঁড় করাতে হয়নি। মে মাসের দিকে আমাকে এখলাসপুর উচ্চবিদ্যালয়ে ভর্তি করা হয় এবং এই স্কুল থেকে ১৯৮০ সালে আমি এসএসসি পাস করি।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়