মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২৪ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   ফরিদগঞ্জ পাকহানাদার মুক্ত দিবস পালন
  •   যৌথ অভিযানে কচুয়া থানার লুণ্ঠিত পিস্তলের ৮ রাউন্ড গুলি উদ্ধার
  •   দৈনিক ইনকিলাবের প্রশাসনিক কর্মকর্তা শহীদুল্লাহ্ মিজির দাফন সম্পন্ন
  •   শনিবার চাঁদপুরে ৪ শতাধিক নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে ম্যারাথন প্রতিযোগিতা

প্রকাশ : ১০ জানুয়ারি ২০২৩, ০০:০০

চাঁদপুর কলেজ লাইব্রেরি ও রতন দা
অনলাইন ডেস্ক

তেত্রিশ বছর আগে চাঁদপুর কলেজ লাইব্রেরিতে আমি রতন দাকে দেখি। মাথাভর্তি চুল, পাতলা-লম্বা, মায়াময় দুটি চোখ আমাকে মন্ত্রমুগ্ধ করেছিলো। লাইব্রেরি কার্ডের জন্যে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দেয়ার পর রতন দা আমাকে কলেজ ছুটির পর আসতে বললেন। ছুটির পর কলেজ লাইব্রেরিতে গেলাম। রতন দা আমাকে দেখে বললো, ‘কী বই তুমি নেবে’ আমি বললাম, ‘ক্লাসের বই নেবো। আমাকে দুটো বই দিন’। কলেজ লাইব্রেরি থেকে দুটো বই নিয়ে বাসায় আসলাম। কলেজেভর্তি হওয়ার পর আমি কোনো বই কিনতে পারিনি। সামর্থ্যবান সহপাঠীদের লাইব্রেরি কার্ড ব্যবহার করে বই ধার নিতাম। আমার এই অবস্থা থেকে উদ্ধার করতে রতন দা এগিয়ে এলেন। গম্ভীর প্রকৃতির রতন দা একদিন হাসতে হাসতে বললেন, ‘তোমাকে এত কষ্ট করে বই নিতে হবে না। তোমার কার্ড দিয়েই যে কয়টা বই লাগে নিও।’ কলেজে ভর্তি হওয়ার আগে পাঠ্যবইয়ের বাইরে মোকছেদুল মোমিন নামক বইটি শুধু পড়েছিলাম। কলেজ লাইব্রেরির বিশাল বইয়ের ভাণ্ডার আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকলো। আর সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিলেন আমার প্রিয় রতন দা। লাইব্রেরি থেকে শরৎ, বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, মানিক, তারাশংকর, বিভূতি ভূষণের বই গোগ্রাসে গিলতে লাগলাম। বই পড়া আমার নেশা হয়ে দাঁড়ালো। প্রথম দিকেই শেষ করলাম শরৎ রচনাবলি তারপরই বঙ্কিম রচনাবলি। এসব বই পড়ার ক্ষেত্রে একটি যুক্তি হলো, আমি খুব মজা পেতাম। ছাত্র সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ায় আমার পরিচিতি কিছুটা বাড়লো। রতন দা আমাকে লাইব্রেরির ভেতর পর্যন্ত ঢুকতে দিতেন। বই নিয়ে টিচারদের রিডিং রুমে পড়তে দিতেন। কারণ লাইব্রেরির টেবিলগুলো আড্ডা দেয়ার জন্য উপযুক্ত। বই পড়ার অনুকূলে ছিলো না। শুধু পত্রিকা পড়ার সুবিধা ছিলো। কারণ পত্রিকা দাঁড়িয়ে পড়তে হতো। রতন দার দিকে মাঝে মধ্যে এক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকতাম। যথেষ্ট ধৈর্য্য আর আন্তরিকতা নিয়ে বই দিতেন এবং জমা নিতেন। গলার স্বরটি যথেষ্ট শান্ত। তাঁর মুখে বিরক্তির চিহ্ন দেখতাম না। আমি ভাবতাম রতন দা বুঝি আমাকেই বেশি ভালোবাসে। কিন্তু দেখলাম যেসব ছাত্র বই পড়ে তাদেরকেও আমার মতই ভালবাসেন। তিনি ছিলেন আমাদের বড় ভাইয়ের মতো।

আমার বই পড়ার আগ্রহ দেখে তৎকালীন লাইব্রেরিয়ান মান্নান স্যার আমাকে সহযোগিতা করতে শুরু করলেন। তিনি আমাকে ধারণা দিলেন কারা বড় লেখক এবং কোন্ বইগুলো পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে। আমি লাইব্রেরি থেকে সে সব বই নিয়ে পড়তে থাকলাম। স্বল্পভাষী রতন দা একদিন আমাকে জ্যা পল সাঁত্রের একটি বই দিলেন পড়তে। এই প্রথম আমি জ্যা পল সাঁত্রের নাম শুনলাম। রতন দা বললেন, ‘ইনি নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন কিন্তু নেননি।’ এতে আমার কৌতূহল আরো বেড়ে গেলো। পরবর্তী সময়ে রতন দা আমাকে সমাজ বিবর্তনবাদের জনক লুইস হেনরী মর্গানের আদিম সমাজ বইটি পড়তে দিয়েছিলেন। এই বইটি আমার চিন্তার জগতে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। আদিম সমাজ কীভাবে গড়ে উঠেছে, কীভাবে পরিবার-রাষ্ট্র গড়ে উঠেছে তার যুক্তিসঙ্গত বিজ্ঞানভিত্তিক ব্যাখ্যা পেলাম। লুইস মর্গান সমাজতান্ত্রিক বিশ্বে যথেষ্ট মর্যাদা পেয়েছেন।

অপরদিকে আমেরিকাসহ পুঁজিবাদী দেশগুলোর বুদ্ধিজীবীদের তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছেন। যদিও তিনি মোটেই সমাজতন্ত্রী ছিলেন না। বিশ্বাস করতেন সমাজ বিকাশে পুঁজিবাদই সর্বোচ্চ স্তর। চাঁদপুর সরকারি কলেজকে আমি মনেপ্রাণে ভালোবাসি। ভালোবাসি কলেজ লাইব্রেরি আর প্রিয় রতন দাকে। যাঁর সীমাহীন প্রশ্রয়ে আমি অবাধে লাইব্রেরি ব্যবহার করার সুযোগ পেয়েছিলাম। রতন দা কথা বলতেন কম। বই সম্পর্কে পরিস্কার ধারণা রাখতেন। দু-তিন বাক্যে বইয়ের বিষয় বস্তু বলতে পারতেন। চাঁদপুর কলেজ বার্ষিকীতে আমার লেখা পড়ে দারুণ খুশি হয়েছিলেন। হাসতে হাসতে বলেছেন, ‘তোমার অনেক গুণ আছে আর দোষ হলো অস্থির’।

সেই কবেকার কথা! এখনও আমি নির্দিষ্ট কোনো পেশায় স্থির হতে পারিনি। বিচিত্র রকমের কাজে অংশ নিয়েছি। কাজ করে আনন্দ পেয়েছি। কী হতে পারতাম এ নিয়ে কোনো বিলাপ নেই। আমি প্রথমদিকে ভেবেছিলাম রতন দা বোধ হয় হিন্দু। পরে জানতে পারলাম তাঁর পুরো নাম মিজানুর রহমান রতন। পরিচিত জনদের কাছে রতন দার খোঁজ-খবর রাখি। তিনি সরকারি চাকুরি থেকে অবসর নিয়েছেন। বিয়ে করেননি, ভাইয়ের সংসারে থাকেন। মাঝে মধ্যে তাঁকে কলেজ লাইব্রেরিতে দেখা যায় বলে শুনেছি। আমার এক বন্ধু জানালো রতন দা দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন। খবরটা শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেলো। আত্মপ্রচারবিমুখ রতন দা দীর্ঘ দিন ছাত্র-ছাত্রীদের নিরলস সেবা দিয়েছেন। অনেক যোগ্য দক্ষ মানুষ গড়ে উঠেছে তাঁর স্নেহ-মমতাণ্ডভালোবাসা আর সহযোগিতায়। প্রিয় রতন দা আপনি ভালো থাকুন। এটা আপনার একজন ভক্তের একান্ত প্রার্থনা।

(২০১০ সালের। রতন মারা গেছেন। একযুগ আগে রতন দার সম্পর্কে আমার অনূভূতি অবিকৃত রাখতে লেখাটি অবিকল পাঠকের কাছে তুলে ধরলাম)

হাসান আলী : উন্নয়নকর্মী ও কলাম লেখক।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়