প্রকাশ : ২৭ ডিসেম্বর ২০২২, ০০:০০
ছেলে-মেয়েদের ভালো মানুষ বানাতে হবে। খুব ভালো মানুষ। পড়াশোনায়ও তাদের ভালো করতে হবে। সাহানার এই ইচ্ছা অনেক দিনের। রোদেলা হওয়ার পর থেকে শুরু হয় তার এই চেষ্টা। সারাক্ষণ চোখে চোখে রাখা। পান থেকে চুন খসলেই রাগ করা, বকাবকি করা সাহানার নিত্যদিনের অভ্যাস হয়ে ওঠে। আর সারাক্ষণ বারণ এবং মানা। করবে না, যাবে না, বলবে না, ধরবে না, দেখবে না- শুধু না না না। সেই ছোট বেলা থেকে রোদেলা শুনে এসেছে শুধু ‘না’। আর ওর খাওয়া-খাদ্য নিয়ে, স্বাস্থ্য নিয়ে, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা নিয়ে, রোগ-ব্যাধি নিয়ে সাহানার দুশ্চিন্তার অন্ত নেই। ফলে সারাক্ষণ না আর বারণের উপর রাখে রোদেলাকে।
এক সময় এই ‘না’ ভর করে রোদেলার মধ্যে। কিছুই তার ভালো লাগে না। পড়তে ভালো লাগে না। স্কুলে যেতে ভালো লাগে না। খেলতে ভালো লাগে না। কেমন যেনো হয়ে যায় রোদেলা। একেবারেই অন্যরকম। এখন সে কারো কথা শুনে না। নিষেধ-বারণ মানে না। বরং যা করতে মানা তাই করে। যা বলতে মানা তাই বলে। আর সরাক্ষণ টেলিভশনের সামনে বসে থাকে। টেলিভিশনে কী চলছে তাও হয়তো সে অনেক সময় বলতে পারবে না। তবুও সে বসে থাকে। সবাই ওর উপর বিরক্ত- মহা বিরক্ত।
রোদেলা সিক্সে পড়ে। আর ছোট ভাই রবিন পড়ে থ্রিতে। কিন্তু বিষয়টা যেন উলটো। যেন রবিন বড় আর রোদেলা ছোট। সিক্সের একটি মেয়ে- নিশ্চয় বড় না। কিন্তু রবিনের চেয়ে তো বড়। অবশ্যই। যত বাজে কাজ আছে, বাজে চিন্তা আছে, বাজে কথা আছে তার সব কিছুতেই সে রবিনের চেয়ে বড়।
মা বললেন, রবিন, শুতে যাবে। দাঁত মাজ। রবিন মা-র দিকে তাকিয়ে কিছু না বলেই দাঁত মেজে আসে।
রোদেলাকে মা বলে, ‘রোদেলা দাঁত মেজে শুতে যাও।’ রোদেলা কিন্তু দাঁত মাজতে চাইবে না। শুতে যেতেও চাইবে না। সে টেলিভিশন দেখবে।
মা আবার বলে, ‘রোদেলা, তোমাকে কী বলছি, শুনতে পাচ্ছ?’
রোদেলা তখন মহা বিরক্ত হয়ে বলে, ‘শুনব না কেন? আমি কি বয়রা?’
মাও তখন রেগে যায়। বলে, ‘বেয়াদব মেয়ে। তোমাকে বয়রা বলেছে কে? তোমার এখন টেলিভিশন দেখার সময় না - ঘুমানোর সময়। তুমি এখন দাঁত মেজে ঘুমোতে যাও।’
রোদেলা তখন আরও রেগে যায়। বলে, ‘আমি দাঁতও মাজব না। ঘুমাবও না। আমি এখন টেলিভিশন দেখব।’
সাহানার মেজাজ তখন তুঙ্গে। নিজেই ব্রাশে পেস্ট লাগিয়ে মেয়ের কাছে নিয়ে আসে এবং দু-একটি চড়-থাপ্পর লাগিয়ে টেলিভিশনের সামনে থেকে উঠিয়ে দেয় রোদেলাকে।
রেগেমেগে বলে, ‘এক্ষণ দাঁত মেজে ঘুমোতে যাবে। নইলে আস্ত রাখব না।’
রোদেলা ঝাকি দিয়ে মার হাত থেকে ব্রাশটা নিয়ে ছুড়ে ফেলে। আর চিৎসার করে বলে, ‘আমি দাঁত মাজব না। ঘুমাবো না। কিছুই করব না। আমাকে মেরে ফেল।’ বলতে বলতে সে চলে যায় পিছনের অন্ধকার বারান্দায়।
বাবা লুতফর থাকে বিদেশে। সংসারের এসব ঝক্কি থেকে সে মুক্ত। সব যন্ত্রণা সাহানার। মেয়েটির সঙ্গে যখন সে আর পেরে উঠে না, তখন ঘরের দরজা বন্ধ করে একা একাই কাঁদে।
এই দুটি ছেলে-মেয়ে নিয়ে সাহানার অনেক স্বপ্ন। কত যে স্বপ্ন- তার শেষ নেই। যখন যা ভালো লাগে তখন তাই বানায় ছেলেকে, মেয়েকে- ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, পাইলট আরও কত কী। কিন্তু ইদানীং মেয়েটির রকম-সকম দেখে সাহানা হতাশ। ছেলেটিও যেন অন্য রকম হয়ে যাচ্ছে। সাহানা ভাবে, যাবেই তো। সংসারে সারাক্ষণ যদি অশান্তি থাকে, তাহলে কীভাবে ছেলেটি ভালো থাকবে?
সাহানা ভাবে, ‘নাহ্, মেয়ে যাই করুক, ওর সঙ্গে আর রাগ করব না। বকাণ্ডঝকা করব না। আর মারা তো একেবারেই ঠিক না। শুধু আদর করব, শুধু আদর করব।’
সাহানা আরও ভাবে, ‘কী সুন্দর মেয়েটি আমার। দুই বেনী করে যখন লাল ফিতা বাঁধে চুলে, তখন কি যে সুন্দর লাগে মেয়েটিকে। আর ওই যে নিচের মারির সামান্য উচু গেজ দাঁতটুকুর সামান্য অংশ যখন হাসতে গেলে দেখা যায়, তখন মেয়েটিকে কী যে সুন্দর লাগে। পরীর মতো।’ এই সব ভেবে সাহানা সুখ পেতে চায়। কিন্তু মেয়েটির সঙ্গে কথা বলতে গেলে প্রতিবারই কোথায় যেন সেই সুখ উভে যায়। তখন মনে হয়, এমন বজ্জাত মেয়ে কী করে তার পেটে এলো।
বাবা লুতফর ওমান থেকে ফোন করে। রবিন-রোদেলার খোঁজ খবর নেয়। মা রোদেলার বিরুদ্ধে অভিযোগ করে। অভিযোগ শুনে শুনে সেও বিরক্ত। রোদেলার সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে সেও খুব বকাবকি করে।
রোদেলার খুব মন খারাপ হয়। সে বুঝতে পারে না, কী করা দরকার। মা বকে, বাবা বকে, রবিন মন খারাপ করে থাকে।
থাকবেই তো। ওর সঙ্গে কি সে ভালো কিছু করে? করে না। ছোট ভাইকে সেও তো আদর করে না। সে-ই বা আদর করবে কীভাবে? তার কি আদর করার মন আছে?
রোদেলা খুব কষ্টে আছে। ওর কষ্ট যেন কেউ বোঝে না।
এমন সময় ওদের বাসায় আসে কণা। কণা ওদের ছোট ফুপি। ইডেনে অনার্স ভর্তি হয়েছে। থাকবে এ বাসায়। কণা কয়েক দিনের মধ্যেই লক্ষ করে বাসার পরিস্থিতি ভালো নয়। ভাবী যেভাবে ছেলে-মেয়েকে শাসন করে সেটা ঠিক না। বিষয়টি নিয়ে সে ভাবীর সঙ্গে কথা বলে। সাহানা হাফ ছেড়ে বাঁচে। বলে, ‘কণা, তুমি যা ইচ্ছে করো। আমি আর পারছি না।’
কণা বাসায় নতুন আইন জারি করে। বলে, ‘ভাবি, এই বাসা চলবে দুই জনের ইচ্ছামতো।’ রোদেলা ভাবছে, নিশ্চয়ই মা আর ফুপির কথা বলা হচ্ছে। রোদেলা জিজ্ঞাসা করল, ‘কাদের কথা বলছ ফুপি? মা আর তোমার ইচ্ছায়?’ কণা রোদেলাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘না সোনা। তোমার মার কথায় না - আমার কথায় তো নয়ই। তুমি আর রবিন যা বলবে তাই হবে। বুঝেছ?’ অনেক দিন পর রোদেলা খুব মজা পায়। দীর্ঘ হতাশার মধ্যে সামান্য আনন্দ অনুভব করে। রোদেলা বলে, ‘আমরা কী বলব, ফুপি। আমরা কী বলব, আর কী হবে?’ কণা হাসে। বলে, ‘কেন? সব তো তোমরাই বলবে। তোমরা কী খেতে পছন্দ কর, ঘরে তা-ই রান্না হবে। তোমাদের ইচ্ছা মতো পোশাক-পরিচ্ছদ কেনা হবে। তোমরা পড়তে চাইলে পড়বে। ইচ্ছে না করলে পড়বে না। টেলিভিশন দেখতে চাইলে দেখবে। ইচ্ছে না করলে দেখবে না। স্কুলে যেতে চাইলে যাবে। যেতে না চাইলে না যাবে। তোমরা যা ভালো মনে কর তাই হবে। তোমার মা আর আমার কাজ হলো তোমাদের আদেশ-নির্দেশ পালন করা।’ ছোট্ট রবিন বলে, ‘বাহরে! আমরা কি তোমাদের মা-বাপ হয়ে গেলাম নাকি?’
রবিনের কথায় সাবই হেসে ওঠে। প্রাণখোলা হাসি। সাহানা অনুভব করে, সংসারে অনেক দিন জমে থাকা একটি ঘুমুট হাওয়া দরজা-জানালা দিয়ে বেরিয়ে পড়ল। আর ঘরে ঢুকল অনেক আলো, অনেক বাতাস। কন্যার মুখ দেখে তাই মনে হলো সাহানার।