মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২১ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   ফরিদগঞ্জ পাকহানাদার মুক্ত দিবস পালন
  •   যৌথ অভিযানে কচুয়া থানার লুণ্ঠিত পিস্তলের ৮ রাউন্ড গুলি উদ্ধার
  •   দৈনিক ইনকিলাবের প্রশাসনিক কর্মকর্তা শহীদুল্লাহ্ মিজির দাফন সম্পন্ন
  •   শনিবার চাঁদপুরে ৪ শতাধিক নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে ম্যারাথন প্রতিযোগিতা

প্রকাশ : ১৩ ডিসেম্বর ২০২২, ০০:০০

বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় মডেল : চলছে ভুল পথে
অনলাইন ডেস্ক

শেষ পর্ব

বিশ্ববিদ্যালয় মডেল নিয়ে লেখার এর এই পর্বে থাকছে বিশ্ববিদ্যালয়কে কীভাবে স্বনির্ভর, ব্যবসাসফল ও আন্তর্জাতিক মানের বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে গড়ে তোলা যায়।

১. সরকারি টাকায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর সিস্টেম বদলাতে হবে

আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা অতি সামান্য টাকা ফি দিয়ে পড়াশোনা করে। যার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব আয় বলতে কিছু নেই এবং তাদেরকে প্রতি বছর সরকারের কাছে হাত পাততে হয় অর্থ বরাদ্দের জন্য। এই জন্য বিশ্ববিদ্যালগুলোতে জবাবদিহিতা, স্বনির্ভরতা, মোটিভেশন ও ডেডিকেশন কোনোটাই আসে না। যে কোনো সমস্যার ক্ষেত্রেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন মনে করে সরকার তাদের সমস্যার সমাধান করবে। এর ফলে প্রতি বছর সরকারের হাজার হাজার কোটি টাকা শুধু বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে দিতে হয় যেখান থেকে সরকারের কাছে এক টাকাও ফেরত আসে না। সেই সাথে এতো টাকা খরচ করেও সরকার শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত করতে পারে না। এটা সম্পূর্ণ ভুল সিস্টেম। পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশ এই নিয়ম থেকে সরে এসে চমৎকার বিকল্প পদ্ধতি তৈরি করেছে। এই বিকল্প পদ্ধতিতে বিশ্ববিদ্যালয়কে নিজস্ব আয়ে চলতে হয় অর্থাৎ সরকারের কাছ থেকে তারা কোনো বরাদ্দ পায় না। তাহলে এতো টাকা বিশ্ববিদ্যালয় আয় কোথা থেকে করবে? এই আয়ের প্রধান উৎস হলো টিউশন ফি। বিশ্ববিদ্যালয়ের টিউশন ফি এমনভাবে নির্ধারণ করতে হবে যাতে সেই আয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় সম্পূর্ণরূপে স্বনির্ভর হতে পারে এবং শিক্ষার অতি উচ্চ মান নিশ্চিত করতে পারে। এখন একটি স্বনির্ভর বিশ্ববিদ্যালয়ের টিউশন ফি নিশ্চই অনেক বেশি হবে এবং স্বল্প আয়ের পরিবারের শিক্ষার্থীদের জন্য নিশ্চই এতো বেশি টাকা দিয়ে পড়া সম্ভব হবে না। এর সমাধান হলো সরকারের পক্ষ থেকে শিক্ষা লোন চালু করা, যাতে স্বল্প আয়ের শিক্ষার্থীরা ব্যাংক থেকে শিক্ষা লোন নিয়ে টিউশন ফি পরিশোধ করতে পারে। এতে একটা ব্যালেন্স তৈরি হবে। এখন দেখা যায় সচ্ছল পরিবারের শিক্ষার্থীরাও ন্যূনতম টিউশন ফি দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। নতুন পদ্ধতিতে যাদের পরিবার সচ্ছল তারা উচ্চ টিউশন ফি দিয়েই পড়বে অথবা চাইলে স্বল্প পরিমাণ লোন নিয়েও পড়তে পারবে। এই লোন শিক্ষার্থীরা পরিশোধ শুরু করবে পড়াশোনা শেষ করে ভালো বেতনের চাকরি পাওয়ার পর থেকে। চাকুরি পাওয়ার পর তাদের বেতনের ছোট একটা অংশ সরকার কেটে নিবে লোন এর ইনস্টলমেন্ট হিসেবে। এর ফলে সরকারের হাজার হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় হবে প্রতি বছর। একই সাথে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্বনির্ভর হয়ে শিক্ষার উচ্চ মান নিশ্চিত করতে পারবে।

২. বিশ্ববিদ্যালয়কে নিজস্ব আয়ের মাধ্যমে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে হবে

এতোক্ষণ তো বললাম, শুধু স্বনির্ভর হওয়ার কথা। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়কে যুগের সাথে তাল মিলিয়ে বিশ্বে মর্যাদাপূর্ণ স্থানে নিতে হলে চলমান উন্নয়ন দরকার এবং সেজন্যে অনেক টাকাও দরকার। পৃথিবীর বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাই শুধু স্বনির্ভরই হয়নি, বরং এই খাতকে একটি লাভজনক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছে। অবশ্যই এ লাভ কারো পকেটে না গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন ও গবেষণায় ব্যয় হয়। সারা পৃথিবীতেই শিক্ষা হলো সবচেয়ে বড় ব্যবসা খাতগুলোর একটি। অস্ট্রেলিয়াতে মাইনিং ও ট্যুরিজমের পরে সরকারের সবচেয়ে বেশি আয় হয় উচ্চশিক্ষা খাত থেকে। তাহলে এই লাভ কোথা থেকে আসে? এই লাভ আসে বিদেশি শিক্ষার্থীদের টিউশন ফির টাকা থেকে। বিভিন্ন দেশের মেধাবী শিক্ষার্থীরা ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার জন্যে প্রচুর টাকা টিউশন ফি দিয়ে পড়তে আসে। আর সেটা যদি ইংলিশ কারিকুলামে হয় তাহলে তো সারা পৃথিবীতেই এর কদর আছে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের কারিকুলাম যেহেতু ইংলিশ, আমরা খুব সহজেই এই সুযোগ কাজে লাগাতে পারি এবং আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত করতে পারি। সঠিকভাবে পরিচালনা করতে পারলে নেপাল, ভুটান, শ্রীলংকা, মালদ্বীপ, আফগানিস্তান, উজবেকিস্তান, কাজাখস্তান থেকে শুরু করে থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম এবং লাওসের মতো দেশগুলো থেকে আমরা প্রচুর শিক্ষার্থী আকৃষ্ট করতে পারবো। এর ফলে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দিন দিন রেঙ্কিংয়ে উন্নতি করতে থাকবে এবং সেই সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ও দেশ অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসার আরো আরো একটি উৎস হলো ব্যবসাভিত্তিক গবেষণার প্যাটেন্ট এবং সেই গবেষণার পণ্য বাজারজাত হলে সেখান থেকে আয়। কোনো একটি পণ্য যদি সফলভাবে বাজার জাত করা যায় তাহলে সেখান বিশ্ববিদ্যালয় বিপুল পরিমাণ আয় করতে পারে। এই কারণেই আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ব্যবসাভিত্তিক গবেষণা, প্যাটেন্ট করা, স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠা করা এবং গবেষণার পণ্য বাজারজাত করার জন্য শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের ব্যাপক সহায়তা দিয়ে থাকে।

৩. বিশ্ববিদ্যালয়কে আধুনিক করতে হবে

আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কিছু কিছু ক্ষেত্রে ভয়াবহ রকমের অ্যানালগ সিস্টেমে চলছে। আধুনিক যুগের সাথে তাল মিলিয়ে আমরা যদি আন্তর্জাতিক মানের বিশ্ববিদ্যালয় বানাতে চাই এবং বিদেশি শিক্ষার্থী আকৃষ্ট করতে চাই তাহলে আমাদের নিচের উল্লেখিত বিষয়গুলোতে উন্নতি করতে হবে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইট

আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওয়েবসাইটগুলো অত্যন্ত হাস্যকর। ওয়েবসাটগুলোতে কাজের চেয়ে অকাজের ইনফরমেশন বেশি। এই ওয়েবসাইট দেখে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাব্যবস্থা বোঝার কোনো উপায় নেই। দেশের শিক্ষার্থীরা কোচিং সেন্টার আর সিনিয়রদের কাছ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি ও শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে আইডিয়া পায়। কিন্তু বিদেশি শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করতে হলে আমাদের অবশ্যই উন্নত মানের ওয়েবসাইট করতে হবে যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি প্রক্রিয়া, ফ্যাকাল্টি, ডিপার্টমেন্ট, প্রোগ্রাম, সিলেবাস, সুবিধা, টিউশন ফি, সংশ্লিষ্ট ইনস্টিটিউট এবং গবেষণা সম্বন্ধে বিস্তারিত বর্ণনা থাকবে। ওয়েবসাইটটি এমন হতে হবে যাতে একজন ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থী ওয়েবসাইট দেখে বিশ্ববিদ্যালয় সম্বন্ধে সম্পূর্ণ ধারণা পেতে পারে।

ই-মেইল যোগাযোগ ব্যবস্থা

আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সত্যিকার অর্থে কোনো ই-মেইল যোগাযোগব্যবস্থা নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের ই-মেইল কেউ কেউ খুলেও দেখে না। তারপরেও যদি কেউ ই-মেইল করে তাহলে ফোন দিয়ে বলে দিতে হয় যে আপনাকে ই-মেইল করেছি, একটু চেক করেন প্লিজ। ই-মেইল ব্যবস্থা কার্যকর না থাকায় আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বার্তা প্রেরণ করা করা হয় পৌরাণিক নিয়মে। কোন একটি বিভাগ থেকে যদি কোন বার্তা প্রেরণ করতে হয় তাহলে বিভাগীয় প্রধান প্রথমে অফিস সহকারীকে মৌখিকভাবে বার্তাটি বলে সেটি চিঠি আকারে ড্রাফট করতে বলেন। সেই ড্রাফট আবার ক’বার কারেকশন করে ফাইনাল করতে এক-দুই দিন লেগে যায়। তারপর সেই বার্তার চিঠি প্রিন্ট করে দেয়া হয় ডিপার্টমেন্টের পিয়নের কাছে। পিয়ন সেটা হেঁটে হেঁটে পৌঁছে দেয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল দফতরে। কখনো কখনো চিঠি ভুল দফতরে চলে গেলে সেই চিঠির আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায় না। সময় আর শ্রমের কী ভয়াবহ রকমের অপচয়? এই সামান্য একটি বার্তা প্রেরণে কখনো সপ্তাহ লেগে যায় অথচ ই-মেইল ব্যবস্থার সঠিক প্রয়োগ থাকলে কাজটি করতে কয়েক মিনিট লাগতো মাত্র। সারা পৃথিবীতেই মাইক্রোসফট আউটলুকের ই-মেইল সিস্টেম ব্যবহার করে সবাই এবং আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অতিস্বত্বর আউটলুকের ই-মেইল সিস্টেম চালু করে এর যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করা দরকার।

অনলাইন লার্নিং ম্যানেজম্যান্ট সিস্টেম

এখন নামকরা সব বিশ্ববিদ্যালয় অনলাইন লার্নিং ম্যানেজম্যান্ট সফটওয়্যার ব্যবহার করে। ব্ল্যাকবোর্ড হলো এই ধরনের একটি সফটওয়্যার যেটা আমি অস্ট্রেলিয়াতে শিক্ষকতার সময়ে ব্যবহার করেছি। এই সফটওয়্যারে একজন শিক্ষক ক্লাসের লেকচার আপলোড করা থেকে শুরু করে, কোর্সের মার্কিং রুব্রিক, টার্ম টেস্টের রেজাল্ট, ফিডব্যাক, এবং ফাইনাল পরীক্ষার রেজাল্ট ইত্যাদি সমস্ত কিছু এই সফটওয়্যারের মাধ্যমে করতে পারে। তেমনি শিক্ষার্থীরা এই সফটওয়ার ব্যবহার করে সব ইনফরমেশন পেয়ে যায়। কেউ ক্লাস মিস করলে এখানে ঢুকে লেকচার ডাউলোড করে দেখে নিতে পারে। আবার শিক্ষার্থীদের অনলাইন ডিসকাশন ফোরাম আছে এই প্রোগ্রামে এবং সেখানে তারা ক্লাসের যে কোনো টপিক নিয়ে অনলাইনে আলাপ করতে পারে, প্রবলেম সল্ভ করতে পারে। মোদ্দা কথা, এই সফটওয়্যার হলো একটা টোটাল প্যাকেজ যেটা অনেক আমলাতান্ত্রিক জটিলতাকে সহজ করে দেয়। তাছাড়া কোভিডপরবর্তী বিশ্বে অনলাইন শিক্ষা এখন সর্বজনস্বীকৃত। সেই জন্য আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অতিসত্বর ব্ল্যাকবোর্ডের মতো লার্নিং ম্যানেজম্যান্ট সফটওয়্যার চালু করা দরকার।

কর্মচারী নিয়োগ বন্ধ করা

বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হয়ে আছে ভিসি, প্রোভিসি, প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও শিক্ষকদের কম শিক্ষিত আত্মীয় বা এলাকার লোকজনের জন্যে কর্মচারী/পিয়ন হিসেবে নিয়োগের স্থল। এদের নিয়োগ ব্যবস্থায় প্রচুর দুর্নীতিও হয়। এই কর্মচারীদের কাজ হইলো চিঠি আদান-প্রদান করা এবং অতিথিদের চা-নাস্তা দেয়া। অথচ ই-মেইল যোগাযোগ ব্যবস্থা সঠিকভাবে চালু হলে এদের কাজ অর্ধেক কমে যাবে। আর আপ্যায়নের মতো কাজ উন্নত বিশ্বে সাধরণত থার্ড পার্টি দিয়ে করানো হয়। এই কর্মচারীনির্ভর হওয়ার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের গতি অত্যন্ত মন্থর হয়ে যায়। অতএব, সরকারের কাছে অনুরোধ থাকবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ঢালাওভাবে কর্মচারী নিয়োগ বন্ধ করার জন্যে।

আশা করি, তিন পর্বের এই লেখার মাধ্যমে কর্তৃপক্ষ আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় মডেল ত্রুটি এবং সেগুলো শোধরানোর জন্য কী কী পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন সে সম্বন্ধে পরিষ্কার ধারণা পাবেন।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়